যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার
যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার
বন্ধ রহে গো কভু
দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে,
ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
যদি কোনদিন এ বীণার তারে
তব প্রিয়নাম নাহি ঝংকারে
দয়া ক’রে তুমি ক্ষণেক দাঁড়ায়ো,
ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
তব আহ্বানে যদি কভু মোর
নাহি ভেঙে যায়ে সুপ্তির ঘোর
বজ্রবেদনে জাগায়ো আমায়,
ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
যদি কোনোদিন তোমার আসনে
আর-কাহারেও বসাই যতনে
চিরদিবসের হে রাজা আমার,
ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।
যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্
যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্,
তারা তো পাবে না জানিতে
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ
আমার হৃদয়খানিতে।
যারা কথা বলে তাহারা বলুক,
আমি কাহারেও করি না বিমুখ–
তারা নাহি জানে ভরা আছে প্রাণ
তব অকথিত বাণীতে।
নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার
নীরব হৃদয়খানিতে।
তোমার লাগিয়া কারেও, হে প্রভু,
পথ ছেড়ে দিতে বলিব না কভু–
যত প্রেম আছে সব প্রেম মোরে
তোমা-পানে রবে টানিতে।
সকলের প্রেমে রবে তব প্রেম
আমার হৃদয়খানিতে।
সবার সহিতে তোমার বাঁধন,
হেরি যেন সদা এ মোর সাধন,
সবার সঙ্গ পারে যেন মনে
তব আরাধনা আনিতে।
সবার মিলনে তোমার মিলন
জাগিবে হৃদয়খানিতে।
যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে
যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে,
মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে
ভাবোন্মাদমত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা
উদ্ভ্রান্ত উচ্ছলফেন ভক্তিমদধারা
নাহি চাহি নাথ।
দাও ভক্তি শান্তিরস,
স্নিগ্ধ সুধা পূর্ণ করি মঙ্গলকলস
সংসারভবনদ্বারে। যে ভক্তি-অমৃত
সমস্ত জীবনে মোর হইবে বিস্তৃত
নিগূঢ় গভীর, সর্ব কর্মে দিবে বল,
ব্যর্থ শুভ চেষ্টারেও করিবে সফল
আনন্দে কল্যাণে। সর্ব প্রেমে দিবে তৃপ্তি,
সর্ব দুঃখে দিবে ক্ষেম,সর্ব সুখে দীপ্তি
দাহহীন।
সম্বরিয়া ভাব-অশ্রুনীর
চিত্ত রবে পরিপূর্ণ অমত্ত গম্ভীর।
শক্তি মোর অতি অল্প, হে দীনবৎসল
শক্তি মোর অতি অল্প, হে দীনবৎসল,
আশা মোর অল্প নহে। তব জলস্থল
তব জীবলোক-মাঝে যেথা আমি যাই
যেথায় দাঁড়াই আমি সর্বত্রই চাই
আমার আপন স্থান। দানপত্রে তব
তোমার নিখিলখানি আমি লিখি লব।
আপনারে নিশিদিন আপনি বহিয়া
প্রতি ক্ষণে ক্লান্ত আমি। শ্রান্ত সেই হিয়া
তোমার সবার মাঝে করিব স্থাপন
তোমার সবারে করি আমার আপন।
নিজ ক্ষুদ্র দুঃখ সুখ জলঘটসম
চাপিয়াছে দুর্ভর ভার মস্তকেতে মম।
ভাঙি তাহা ডুব দিব বিশ্বসিন্ধুনীরে,
সহজে বিপুল জল বহি যাবে শিরে।
শক্তিদম্ভ স্বার্থলোভ মারীর মতন
শক্তিদম্ভ স্বার্থলোভ মারীর মতন
দেখিতে দেখিতে আজি ঘিরিছে ভুবন।
দেশ হেতে দেশান্তরে স্পর্শবিষ তার
শান্তিময় পল্লী যত করে ছারখার।
যে প্রশান্ত সরলতা জ্ঞানে সমুজ্জ্বল,
স্নেহে যাহা রসসিক্ত, সন্তোষে শীতল,
ছিল তাহা ভারতের তপোবনতলে।
বস্তুভারহীন মন সর্ব জলে স্থলে
পরিব্যাপ্ত করি দিত উদার কল্যাণ,
জড়ে জীবে সর্বভূতে অবারিত ধ্যান
পশিত আত্মীয়রূপে। আজি তাহা নাশি
চিত্ত যেথা ছিল সেথা এল দ্রব্যরাশি,
তৃপ্তি যেথা ছিল সেথা এল আড়ম্বর,
শান্তি যেথা ছিল সেথা স্বার্থের সমর।
শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী
ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী
তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে
ঘটেছে সংগ্রাম–প্রলয়মন্থনক্ষোভে
ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি
পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি
জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়
ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।
কবিদল চিৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি
শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি-গীতি।
সংসার যবে মন কেড়ে লয়
সংসার যবে মন কেড়ে লয়,
জাগে না যখন প্রাণ,
তখনো, হে নাথ, প্রণমি তোমায়
গাহি বসে তব গান।
অন্তরযামী, ক্ষমো সে আমার
শূন্যমনের বৃথা উপহার
পুষ্পবিহীন পূজা-আয়োজন
ভক্তিবিহীন তান–
সংসার যবে মন কেড়ে লয়,
জাগে না যখন প্রাণ।
ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে,
আশা করি প্রাণপণে
নিবিড় প্রেমের সরস বরষা
যদি নেমে আসে মনে।
সহসা একদা আপনা হইতে
ভরি দিবে তুমি তোমার অমৃতে
এই ভরসায় করি পদতলে
শূন্য হৃদয় দান–
সংসার যবে মন কেড়ে লয়,
জাগে না যখন প্রাণ।
সংসারে মোরে রাখিয়াছ যেই ঘরে
সংসারে মোরে রাখিয়াছ যেই ঘরে
সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া।
করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে
রেখে দিয়ো তার একটি দুয়ার খুলিয়া।
মোর সব কাজে মোর সব অবসরে
সে দুয়ার রবে তোমারি প্রবেশ-তরে,
সেথা হতে বায়ু বহিবে হৃদয়-‘পরে
চরণ হতে তব পদরজ তুলিয়া।
সে দুয়ার খুলি আসিবে তুমি এ ঘরে,
আমি বাহিরিব সে দুয়ারখানি খুলিয়া।
আর যত সুখ পাই বা না পাই, তবু
এক সুখ শুধু মোর তরে তুমি রাখিয়ো।
সে সুখ কেবল তোমার আমার প্রভু,
সে সুখের ‘পরে তুমি জাগ্রত থাকিয়ো।
তাহারে না ঢাকে আর যত সুখগুলি,
সংসার যেন তাহাতে না দেয় ধূলি,
সব কোলাহল হতে তারে তুমি তুলি
যতন করিয়া আপন অঙ্কে ঢাকিয়ো।
আর যত সুখে ভরুক ভিক্ষাঝুলি,
সেই এক সুখ মোর তরে তুমি রাখিয়ো।
যত বিশ্বাস ভেঙে ভেঙে যায়, স্বামী,
এক বিশ্বাস রহে যেন চিতে লাগিয়া।
যে অনলতাপ যখনি সহিব আমি
দেয় যেন তাহে তব নাম বুকে দাগিয়া।
দুখ পশে যবে মর্মের মাঝখানে
তোমার লিখন-স্বাক্ষর যেন আনে,
রুক্ষ বচন যতই আঘাত হানে
সকল আঘাতে তব সুর উঠে জাগিয়া।
শত বিশ্বাস ভেঙে যদি যায় প্রাণে
এক বিশ্বাসে রহে যেন মন লাগিয়া।