কোথাও পুরাতন শিবালয়
তীরে সারি সারি জেগে রয় ।
সেথায় দু – বেলা সকালে সাঁঝে
পূজার কাঁসর – ঘণ্টা বাজে ।
কত জটাধারী ছাইমাখা
ঘাটে বসে আছে যেন আঁকা ।
তীরে কোথাও বসেছে হাট ,
নৌকা ভরিয়া রয়েছে ঘাট ।
মাঠে কলাই সরিষা ধান ,
তাহার কে করিবে পরিমাণ ।
কোথাও নিবিড় আখের বনে
শালিক চরিছে আপন মনে ।
কোথাও ধু ধু করে বালুচর
সেথায় গাঙশালিকের ঘর ।
সেথায় কাছিম বালির তলে
আপন ডিম পেড়ে আসে চলে ।
সেথায় শীতকালে বুনো হাঁস
কত ঝাঁকে ঝাঁকে করে বাস ।
সেথায় দলে দলে চখাচখী
করে সারাদিন বকাবকি ।
সেথায় কাদাখোঁচা তীরে তীরে
কাদায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফিরে ।
কোথাও ধানের খেতের ধারে
ঘন কলাবন বাঁশঝাঁড়ে
ঘন আম – কাঁঠালের বনে
গ্রাম দেখা যায় এক কোণে ।
সেথা আছে ধান গোলাভরা ,
সেথা খড়গুলা রাশ – করা ।
সেথা গোয়ালেতে গোরু বাঁধা
কত কালো পাটকিলে সাদা ।
কোথাও কলুদের কুঁড়েখানি ,
সেথায় ক্যাঁ কোঁ ক’রে ঘোরে ঘানি ।
কোথাও কুমারের ঘরে চাক ,
দেয় সারাদিন ধরে পাক ।
মুদি দোকানেতে সারাখন
বসে পড়িতেছে রামায়ণ ।
কোথাও বসি পাঠশালা – ঘরে
যত ছেলেরা চেঁচিয়ে পড়ে ,
বড়ো বেতখানি লয়ে কোলে
ঘুমে গুরুমহাশয় ঢোলে ।
হেথায় এঁকে বেঁকে ভেঙে চুরে
গ্রামের পথ গেছে বহু দূরে ।
সেথায় বোঝাই গোরুর গাড়ি
ধীরে চলিয়াছে ডাক ছাড়ি ।
রোগা গ্রামের কুকুরগুলো
ক্ষুধায় শুঁকিয়া বেড়ায় ধুলো ।
যেদিন পুরনিমা রাতি আসে
চাঁদ আকাশ জুড়িয়া হাসে ।
বনে ও পারে আঁধার কালো ,
জলে ঝিকিমিকি করে আলো ।
বালি চিকিচিকি করে চরে ,
ছায়া ঝোপে বসি থাকে ডরে ।
সবাই ঘুমায় কুটিরতলে ,
তরী একটিও নাহি চলে ।
গাছে পাতাটিও নাহি নড়ে ,
জলে ঢেউ নাহি ওঠে পড়ে ।
কভু ঘুম যদি যায় ছুটে
কোকিল কুহু কুহু গেয়ে উঠে ,
কভু ও পারে চরের পাখি
রাতে স্বপনে উঠিছে ডাকি ।
নদী চলেছে ডাহিনে বামে ,
কভু কোথাও সে নাহি থামে ।
সেথায় গহন গভীর বন ,
তীরে নাহি লোক নাহি জন ।
শুধু কুমির নদীর ধারে
সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে ।
বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝাপে ,
ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে ।
কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ ,
তাহার গায়ে চাকা চাকা দাগ ।
রাতে চুপিচুপি আসে ঘাটে ,
জল চকো চকো করি চাটে ।
হেথায় যখন জোয়ার ছোটে ,
নদী ফুলিয়ে ঘুলিয়ে ওঠে ।
তখন কানায় কানায় জল ,
কত ভেসে আসে ফুল ফল ।
ঢেউ হেসে ওঠে খলখল ,
তরী করি ওঠে টলমল ।
নদী অজগরসম ফুলে
গিলে খেতে চায় দুই কূলে ।
আবার ক্রমে আসে ভাঁটা পড়ে ,
তখন জল যায় সরে সরে ।
তখন নদী রোগা হয়ে আসে ,
কাদা দেখা দেয় দুই পাশে ।
বেরোয় ঘাটের সোপান যত
যেন বুকের হাড়ের মতো ।
নদী চলে যায় যত দূরে
ততই জল ওঠে পুরে পুরে ।
শেষে দেখা নাহি যায় কূল ,
চোখে দিক হয়ে যায় ভুল ।
নীল হয়ে আসে জলধারা ,
মুখে লাগে যেন নুন – পারা ।
ক্রমে নীচে নাহি পাই তল ,
ক্রমে আকাশে মিশায় জল ,
ডাঙা কোন্খানে পড়ে রয় —
শুধু জলে জলে জলময় ।
ওরে একি শুনি কোলাহল ,
হেরি একি ঘন নীল জল ।
ওই বুঝি রে সাগর হোথা ,
উহার কিনারা কে জানে কোথা ।
ওই লাখো লাখো ঢেউ উঠে
সদাই মরিতেছে মাথা কুটে ।
ওঠে সাদা সাদা ফেনা যত
যেন বিষম রাগের মতো ।
জল গরজি গরজি ধায় ,
যেন আকাশ কাড়িতে চায় ।
বায়ু কোথা হতে আসে ছুটে ,
ঢেউয়ে হাহা করে পড়ে লুটে ।
যেন পাঠশালা – ছাড়া ছেলে
ছুটে লাফায়ে বেড়ায় খেলে ।
হেথা যতদূর পানে চাই
কোথাও কিছু নাই , কিছু নাই ।
শুধু আকাশ বাতাস জল ,
শুধুই কলকল কোলাহল ,
শুধু ফেনা আর শুধু ঢেউ —
আর নাহি কিছু নাহি কেউ ।
হেথায় ফুরাইল সব দেশ ,
নদীর ভ্রমণ হইল শেষ ।
হেথা সারাদিন সারাবেলা
তাহার ফুরাবে না আর খেলা ।
তাহার সারাদিন নাচ গান
কভু হবে নাকো অবসান ।
এখন কোথাও হবে না যেতে ,
সাগর নিল তারে বুক পেতে ।
তারে নীল বিছানায় থুয়ে
তাহার কাদামাটি দিবে ধুয়ে ।
তারে ফেনার কাপড়ে ঢেকে ,
তারে ঢেউয়ের দোলায় রেখে ,
তার কানে কানে গেয়ে সুর
তার শ্রম করি দিবে দূর ।
নদী চিরদিন চিরনিশি
রবে অতল আদরে মিশি ।
০১.উৎসর্গ (নদী)
পরমস্নেহাস্পদ
শ্রীমান বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তে
তাঁহার শুভপরিণয়দিনে
এই গ্রন্থখানি
উপহৃত
হইল ।
২২ মাঘ
১৩০২