হেরো অন্ধকার মরুময়ী নিশা —
আমার পরান হারায়েছে দিশা ,
অনন্ত এ ক্ষুধা অনন্ত এ তৃষা
করিতেছে হাহাকার ।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে ।
এ ঘোর পিপাসা যুগ-যুগান্তরে
মিটিবে কি কভু আর ।
বুকের ভিতরে ছুরির মতন ,
মনের মাঝারে বিষের মতন ,
রোগের মতন , শোকের মতন
রব আমি অনিবার ।
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে ,
আশার পশ্চাতে ভয় —
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরণীময় ।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া
এই তো নিয়ম ভবে ,
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই
এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে!
সুখস্বপ্ন
ওই জানালার কাছে বসে আছে
করতলে রাখি মাথা ।
তার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে ,
সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা ।
শুধু ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় ,
তার কানে কানে কী যে কহে যায় ,
তাই আধো শুয়ে আধো বসিয়ে
কত ভাবিতেছে আনমনে ।
উড়ে উড়ে যায় চুল ,
কোথা উড়ে উড়ে পড়ে ফুল ,
ঝুরু ঝুরু কাঁপে গাছপালা
সমুখের উপবনে ।
অধরের কোণে হাসিটি
আধখানি মুখ ঢাকিয়া ,
কাননের পানে চেয়ে আছে
আধমুকুলিত আঁখিয়া ।
সুদূর স্বপন ভেসে ভেসে
চোখে এসে যেন লাগিছে ,
ঘুমঘোরময় সুখের আবেশ
প্রাণের কোথায় জাগিছে ।
চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায় ,
উড়ে উড়ে যায় পাখি ,
সারাদিন ধরে বকুলের ফুল
ঝরে পড়ে থাকি থাকি ।
মধুর আলস , মধুর আবেশ ,
মধুর মুখের হাসিটি ,
মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে
বাজিছে মধুর বাঁশিটি ।
সুখের স্মৃতি
চেয়ে আছে আকাশের পানে
জোছনায় আঁচলটি পেতে ,
যত আলো ছিল সে চাঁদের
সব যেন পড়েছে মুখেতে ।
মুখে যেন গলে পড়ে চাঁদ ,
চোখে যেন পড়িছে ঘুমিয়ে ,
সুকোমল শিথিল আঁচলে
পড়ে আছে আরামে চুমিয়ে ।
একটি মৃণাল-করে মাথা ,
আরেকটি পড়ে আছে বুকে ,
বাতাসটি বহে গিয়ে গায়
শিহরি উঠিছে অতি সুখে ।
হেলে হেলে নুয়ে নুয়ে লতা
বাতাসেতে পায়ে এসে পড়ে ,
বিস্ময়ে মুখের পানে চেয়ে
ফুলগুলি দুলে দুলে নড়ে ।
অতি দূরে বাজে ধীরে বাঁশি ,
অতি সুখে পরান উদাসী ,
অধরেতে স্খলিতচরণা
মদিরহিল্লোলময়ী হাসি ।
কে যেন রে চুমো খেয়ে তারে
চলে গেছে এই কিছু আগে ;
চুমোটিরে বাঁধি ফুলহারে
অধরেতে হাসির মাঝারে ,
চুমোতে চাঁদের চুমো দিয়ে
রেখেছে রে যতনে সোহাগে ।
তাই সেই চুমোটিরে ঘিরে
হাসিগুলি সারা রাত জাগে ।
কে যেন রে বসে তার কাছে
গুন গুন করে বলে গেছে
মধুমাখা বাণী কানে কানে ।
পরানের কুসুমকারায়
কথাগুলি উড়িয়ে বেড়ায় ,
বাহিরিতে পথ নাহি জানে ।
অতি দূর বাঁশরির গানে
সে বাণী জড়িয়ে যেন গেছে ,
অবিরত স্বপনের মতো
ঘুরিয়ে বেড়ায় কাছে কাছে ।
মুখে নিয়ে সেই কথা কটি
খেলা করে উলটি , পালটি ,
আপনি আপন বাণী শুনে
শরমে সুখেতে হয় সারা ।
কার মুখ পড়ে তার মনে ,
কার হাসি লাগিছে নয়নে ,
স্মৃতির মধুর ফুলবনে
কোথায় হয়েছে পথহারা!
চেয়ে তাই সুনীল আকাশে
মুখেতে চাঁদের আলো ভাসে ,
অবসান-গান আশেপাশে
ভ্রমে যেন ভ্রমরের পারা ।
স্নেহময়ী
হাসিতে ভরিয়ে গেছে হাসিমুখখানি —
প্রভাতে ফুলের বনে দাঁড়ায়ে আপন মনে ,
মরি মরি , মুখে নাই বাণী ।
প্রভাতকিরণগুলি চৌদিকে যেতেছে খুলি
যেন শুভ্র কমলের দল ,
আপন মহিমা লয়ে তারি মাঝে দাঁড়াইয়ে
কে তুই করুণাময়ী বল্ ।
স্নিগ্ধ ওই দুনয়ানে চাহিলে মুখের পানে
সুধাময়ী শান্তি প্রাণে জাগে —
শুনি যেন স্নেহবাণী , কোমল ও হাতখানি
প্রাণের গায়েতে যেন লাগে ।
তোরে যেন চিনিতাম , তোর কাছে শুনিতাম
কত কী কাহিনী সন্ধেবেলা ,
যেন মনে নাই কবে কাছে বসি মোরা সবে
তোর কাছে করিতাম খেলা ।
অতি ধীরে তোর পাশে প্রভাতের বায়ু আসে ,
যেন ছোটো ভাইটির প্রায় ,
যেন তোর স্নেহ পেয়ে তোর মুখপানে চেয়ে
আবার সে খেলাইতে যায় ।
অমিয়-মাধুরী মাখি চেয়ে আছে দুটি আঁখি ,
জগতের প্রাণ জুড়াইছে ,
ফুলেরা আমোদে মেতে হেলে দুলে বাতাসেতে
আঁখি হতে স্নেহ কুড়াইছে ।
কী যেন জান গো ভাষা , কী যেন দিতেছ আশা ,
আঁখি দিয়ে পরান উথলে —
চারি দিকে ফুলগুলি কচি কচি বাহু তুলি
‘ কোলে নাও ‘ ‘ কোলে নাও ‘ বলে ।
কারে যেন কাছে ডাক , যেথা তুমি বসে থাক
তার চারি দিকে থাক তুমি —
তোমার আপনা দিয়ে হাসিময়ী শান্তি দিয়ে
পূর্ণ কর চরাচরভূমি ।
তোমাতে পুরেছে বন , পূর্ণ হল সমীরণ ,
তোমাতে পুরেছে লতাপাতা ।
ফুল দূরে থেকে চায় — তোমার পরশ পায় ,
লুটায় তোমার কোলে মাথা ।
তোমার প্রাণের বিভা চৌদিকে দুলিছে কি বা
প্রভাতের আলোকহিল্লোলে ,
আজিকে প্রভাতে এ কী স্নেহের প্রতিমা দেখি ,
বসে আছ জগতের কোলে!
কেহ মুখ চেয়ে থাকে , কেহ তোরে কাছে ডাকে
কেহ তোর কোলে খেলা করে ।
তুমি শুধু স্তব্ধ হয়ে একটি কথা না কয়ে
চেয়ে আছ আনন্দের ভরে ।
ওই যে তোমার কাছে সকলে দাঁড়িয়ে আছে
ওরা মোর আপনার লোক ,
ওরাও আমারি মতো তোর স্নেহে আছে রত
জুঁই বেলা বকুল অশোক ।
বড়ো সাধ যায় তোরে ফুল হয়ে থাকি ঘিরে
কাননে ফুলের সাথে মিশে
নয়ন-কিরণে তোর দুলিবে পরান মোর ,
সুবাস ছুটিবে দিশে দিশে ।
তোমার হাসিটি লয়ে হরষে আকুল হয়ে
খেলা করে প্রভাতের আলো
হাসিতে আলোটি পড়ে , আলোতে হাসিটি পড়ে ,
প্রভাত মধুর হয়ে গেল ।
পরশি তোমার কায় মধুর প্রভাত-বায় ,
মধুময় কুসুমের বাস —
ওই দৃষ্টিসুধা দাও , এই দিক-পানে চাও ,
প্রাণে হোক প্রভাত বিকাশ ।