বুঝি রে এমনি বেলা ছায়ায় করিত খেলা
তপোবনে ঋষিবালিকারা ,
পরিয়া বাকলবাস , মুখেতে বিমল হাস ,
বনে বনে বেড়াইত তারা ।
হরিণশিশুরা এসে কাছেতে বসিত ঘেঁষে ,
মালিনী বহিত পদতলে —
দু-চারি সখীতে মেলি কথা কয় হাসি খেলি
তরুতলে বসি কুতূহলে ।
কারো কোলে কারো মাথা , সরল প্রাণের কথা
নিরালায় কহে প্রাণ খুলি —
লুকিয়ে গাছের আড়ে সাধ যায় শুনিবারে
কী কথা কহিছে মেয়েগুলি ।
লতার পাতার মাঝে , ঘাসের ফুলের মাঝে
হরিণশিশুর সাথে মিলি ,
অঙ্গে আভরণ নাই , বাকল-বসন পরি
রূপগুলি বেড়াইছে খেলি ।
ওই দূর বনছায়া ও যে কী জানে রে মায়া ,
ও যেন রে রেখেছে লুকায়ে —
সেই স্নিগ্ধ তপোবন , চিরফুল্ল তরুগণ ,
হরিণশাবক তরুছায়ে ।
হোথায় মালিনী নদী বহে যেন নিরবধি ,
ঋষিকন্যা কুটিরের মাঝে —
কভু বসি তরুতলে স্নেহে তারে ভাই বলে ,
ফুলটি ঝরিলে ব্যথা বাজে ।
কত ছবি মনে আসে , পরানের আশেপাশে
কল্পনা কত যে করে খেলা —
বাতাস লাগায়ে গায়ে বসিয়া তরুর ছায়ে
কেমনে কাটিয়া যায় বেলা ।
মাতাল
বুঝি রে ,
চাঁদের কিরণ পান করে ওর ঢুলু ঢুলু দুটি আঁখি ,
কাছে ওর যেয়ো না ,
কথাটি শুধায়ো না ,
ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে বসে আছে একাকী ।
ঘুমের মতো মেয়েগুলি
চোখের কাছে দুলি দুলি
বেড়ায় শুধু নূপুর রনরনি ।
আধেক মুদি আঁখির পাতা ,
কার সাথে যে কচ্ছে কথা ,
শুনছে কাহার মৃদু মধুর ধ্বনি ।
অতি সুদূর পরীর দেশে —
সেখান থেকে বাতাস এসে
কানের কাছে কাহিনী শুনায় ।
কত কী যে মোহের মায়া ,
কত কী যে আলোক ছায়া ,
প্রাণের কাছে স্বপন ঘনায় ।
কাছে ওর যেয়ো না ,
কথাটি শুধায়ো না ,
ঘুমের মেয়ে তরাস পেয়ে যাবে ,
মৃদু প্রাণে প্রমাদ গণি
নূপুরগুলি রনরনি
চাঁদের আলোয় কোথায় কে লুকাবে ।
চলো দূরে নদীর তীরে ,
বসে সেথায় ধীরে ধীরে
একটি শুধু বাঁশরি বাজাও ।
আকাশেতে হাসবে বিধু ,
মধুকন্ঠে মৃদু মৃদু
একটি শুধু সুখেরই গান গাও ।
দূর হতে আসিয়া কানে
পশিবে সে প্রাণের প্রাণে
স্বপনেতে স্বপন ঢালিয়ে ।
ছায়াময়ী মেয়েগুলি
গানের স্রোতে দুলি দুলি ,
বসে রবে গালে হাত দিয়ে ।
গাহিতে গাহিতে তুমি বালা
গেঁথে রাখো মালতীর মালা ।
ও যখন ঘুমাইবে , গলায় পরায়ে দিবে
স্বপনে মিশিবে ফুলবাস ।
ঘুমন্ত মুখের’পরে চেয়ে থেকো প্রেমভরে
মুখেতে ফুটিবে মৃদু হাস ।
যোগী
পশ্চিমে ডুবেছে ইন্দু , সম্মুখে উদার সিন্ধু ,
শিরোপরি অনন্ত আকাশ ,
লম্বমান জটাজূটে যোগিবর করপুটে
দেখিছেন সূর্যের প্রকাশ ।
উলঙ্গ সুদীর্ঘকায় , বিশাল ললাট ভায় ,
মুখে তাঁর শান্তির বিকাশ ।
শূন্যে আঁখি চেয়ে আছে , উদার বুকের কাছে
খেলা করে সমুদ্র-বাতাস ।
চৌদিকে দিগন্তমুক্ত , বিশ্বচরাচর সুপ্ত ,
তারি মাঝে যোগী মহাকায় ।
ভয়ে ভয়ে ঢেউগুলি নিয়ে যায় পদধূলি ,
ধীরে আসে , ধীরে চলে যায় ।
মহা স্তব্ধ সব ঠাঁই , বিশ্বে আর শব্দ নাই
কেবল সিন্ধুর মহাতান —
যেন সিন্ধু ভক্তিভরে জলদগম্ভীর স্বরে
তপনের করে স্তবগান ।
আজি সমুদ্রের কূলে , নীরবে সমুদ্র দুলে
হৃদয়ের অতল গভীরে ।
অনন্ত সে পারাবার ডুবাইছে চারি ধার ,
ঢেউ লাগে জগতের তীরে ।
যোগী যেন চিত্রে লিখা — উঠিছে রবির শিখা
মুখে তারি পড়িছে কিরণ ,
পশ্চাতে ব্যাপিয়া দিশি তামসী তাপসী নিশি
ধ্যান করে মুদিয়া নয়ন ।
শিবের জটার ‘পরে যথা সুরধুনী ঝরে
তারাচূর্ণ রজতের স্রোতে ,
তেমনি কিরণ লুটে সন্ন্যাসীর জটাজুটে
পুরব-আকাশ-সীমা হতে ।
বিমল আলোক হেন ব্রহ্মলোক হতে যেন
ঝরে তাঁর ললাটের কাছে ,
মর্তের তামসী নিশি পশ্চাতে যেতেছে মিশি
নীরবে নিস্তব্ধ চেয়ে আছে ।
সুদূর সমুদ্রনীরে অসীম আঁধার-তীরে
একটুকু কনকের রেখা ,
কী মহা রহস্যময় সমুদ্রে অরুণোদয়
আভাসের মতো যায় দেখা ।
চরাচর ব্যগ্র প্রাণে পুরবের পথপানে
নেহারিছে সমুদ্র অতল —
দেখো চেয়ে মরি মরি , কিরণমৃণাল-‘পরি
জ্যোতির্ময় কনককমল ।
দেখো চেয়ে দেখো পুবে কিরণে গিয়েছে ডুবে
গগনের উদার ললাট —
সহসা সে ঋষিবর আকাশে তুলিয়া কর
গাহিয়া উঠিল বেদপাঠ ।
রাহুর প্রেম
শুনেছি আমারে ভালো ই লাগে না ,
নাই-বা লাগিল তোর ,
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর ।
তুই তো আমার বন্দী অভাগিনী
বাঁধিয়াছি কারাগারে ,
প্রাণের শৃঙ্খল দিয়েছি প্রাণেতে
দেখি কে খুলিতে পারে ।
জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি ,
যেথায় বসিবি , যেথায় দাঁড়াবি ,
কি বসন্ত শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণ প্রাণ অনন্ত শৃঙ্খল
চরণ জড়ায়ে ধরে ।
এক বার তোরে দেখেছি যখন
কেমনে এড়াবি মোরে ।
চাও নাই চাও , ডাক নাই ডাক ,
কাছেতে আমার থাক নাই থাক ,
যাব সাথে সাথে , রব পায় পায় ,
রব গায় গায় মিশি —
এ বিষাদ ঘোর , এ আঁধার মুখ ,
হতাশ নিশ্বাস , এই ভাঙা বুক ,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি ।
অনন্ত কালের সঙ্গী আমি তোর
আমি যে রে তোর ছায়া —
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে ,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে ,
কখনো সমুখে কখনো পশ্চাতে ,
আমার আঁধার কায়া ।
গভীর নিশীথে একাকী যখন
বসিয়া মলিন প্রাণে ,
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে ।
যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান ,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার
আঁধার মুরতি আঁকা ।
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে ,
জগৎ পড়িবে ঢাকা ।
দুঃস্বপ্নের মতো , দুর্ভাবনা-সম ,
তোমারে রহিব ঘিরে —
দিবস-রজনী এ মুখ দেখিব
তোমার নয়ননীরে ।
বিশীর্ণ-কঙ্কাল চিরভিক্ষা-সম
দাঁড়ায়ে সম্মুখে তোর
‘ দাও দাও ‘ বলে কেবলি ডাকিব
ফেলিব নয়নলোর ।
কেবলি সাধিব , কেবলি কাঁদিব ,
কেবলি ফেলিব শ্বাস —
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে
করিব রে হা-হুতাশ ।
মোর এক নাম কেবলি বসিয়া
জপিব কানেতে তব ,
কাঁটার মতন দিবস রজনী
পায়েতে বিঁধিয়ে রব ।
পূর্বজনমের অভিশাপ-সম
রব আমি কাছে কাছে ,
ভাবী জনমের অদৃষ্টের মতো
বেড়াইব পাছে পাছে ।
ঢালিয়া আমার প্রাণের আঁধার
বেড়িয়া রাখিব তোর চারি ধার
নিশীথ রচনা করি ।
কাছেতে দাঁড়ায়ে প্রেতের মতন
শুধু দুটি প্রাণী করিব যাপন
অনন্ত সে বিভাবরী ।
যেন রে অকূল সাগর-মাঝারে
ডুবেছে জগৎ-তরী —
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি ,
যুঝিস ছাড়াতে , ছাড়িব না তবু
সে মহাসমুদ্র- ‘ পরি ।
পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ ,
পলে পলে তোর বাহু বলহীন ,
দুজনে অনন্তে ডুবি নিশিদিন —
তবু আছি তোরে ধরি ।
রোগের মতন বাঁধিব তোমারে
নিদারুণ আলিঙ্গনে —
মোর যাতনায় হইবি অধীর ,
আমারি অনলে দহিবে শরীর ,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর
কিছু না রহিবে মনে ।
গভীর নিশীথে জাগিয়া উঠিয়া
সহসা দেখিবি কাছে ,
আড়ষ্ট কঠিন মৃত দেহ মোর
তোর পাশে শুয়ে আছে ।
ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি ,
কেবল দেখিবি মোরে ,
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি
চাহিয়া দেখিছে তোরে ।
নিশীথে বসিয়া থেকে থেকে তুই
শুনিবি আঁধারঘোরে ,
কোথা হতে এক কাতর উন্মাদ
ডাকে তোর নাম ধরে ।
সুবিজন পথে চলিতে চলিতে
সহসা সভয় গণি ,
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি
আমার হাসির ধ্বনি ।