বাদল
একলা ঘরে বসে আছি , কেউ নেই কাছে ,
সারাটা দিন মেঘ করে আছে ।
সারাদিন বাদল হল ,
সারাদিন বৃষ্টি পড়ে ,
সারাদিন বইছে বাদল-বায়!
মেঘের ঘটা আকাশভরা ,
চারি দিকে আঁধার-করা ,
তড়িৎ-রেখা ঝলক মেরে যায় ।
শ্যামল বনের শ্যামল শিরে
মেঘের ছায়া নেমেছে রে ,
মেঘের ছায়া কুঁড়েঘরের’পরে ,
ভাঙাচোরা পথের ধারে
ঘন বাঁশের বনের ধারে
মেঘের ছায়া ঘনিয়ে যেন ধরে ।
বিজন ঘরে বাতায়নে
সারাটা দিন আপন মনে
বসে বসে বাইরে চেয়ে দেখি ,
টুপুটুপু বৃষ্টি পড়ে ,
পাতা হতে পাতায় ঝরে ,
ডালে বসে ভেজে একটি পাখি ।
তালপুকুরে জলের’পরে
বৃষ্টিবারি নেচে বেড়ায় ,
ছেলেরা মেতে বেড়ায় জলে ,
মেয়েগুলি কলসী নিয়ে
চলে আসে পথ দিয়ে ,
আঁধারভরা গাছের তলে তলে!
কে জানে কী মনেতে আশ ,
উঠছে ধীরে দীর্ঘনিশাস ,
বায়ু উঠে শ্বসিয়া শ্বসিয়া ।
ডালপালা হা হা করে ,
বৃষ্টিবিন্দু ঝরে পড়ে ,
পাতা পড়ে খসিয়া খসিয়া ।
বিদায়
সে যখন বিদায় নিয়ে গেল ,
তখন নবমীর চাঁদ অস্তাচলে যায় ।
গভীর রাতি নিঝুম চারি দিক ,
আকাশেতে তারা অনিমিখ ,
ধরণী নীরবে ঘুমায় ।
হাত দুটি তার ধরে দুই হাতে
মুখের পানে চেয়ে সে রহিল ,
কাননে বকুল তরুতলে
একটিও সে কথা না কহিল ।
অধরে প্রাণের মলিন ছায়া ,
চোখের জলে মলিন চাঁদের আলো ,
যাবার বেলা দুটি কথা বলে
বনপথ দিয়ে সে চলে গেল ।
ঘন গাছের পাতার মাঝে আঁধার পাখি গুটিয়ে পাখা ,
তারি উপর চাঁদের আলো শুয়েছে ,
ছায়াগুলি এলিয়ে দেহ আঁচলখানি পেতে যেন
গাছের তলায় ঘুমিয়ে রয়েছে ।
গভীর রাতে বাতাসটি নেই — নিশীথে সরসীর জলে
কাঁপে না বনের কালো ছায়া ,
ঘুম যেন ঘোমটা-পরা বসে আছে ঝোপেঝাপে ,
পড়ছে বসে কী যেন এক মায়া ।
চুপ করে হেলে সে বকুল গাছে ,
রমণী একেলা দাঁড়ায়ে আছে ।
এলোথেলো চুলের মাঝে বিষাদমাখা সে মুখখানি ,
চাঁদের আলো পড়েছে তার’পরে ।
পথের পানে চেয়ে ছিল , পথের পানেই চেয়ে আছে ,
পলক নাহি তিলেক কালের তরে ।
গেল রে কে চলে গেল , ধীরে ধীরে চলে গেল ,
কী কথা সে বলে গেল হায় ,
অতি দূর অশথের ছায়ে মিশায়ে কে গেল রে ,
রমণী দাঁড়ায়ে জোছনায় ।
সীমাহীন জগতের মাঝে আশা তার হারায়ে গেল ,
আজি এই গভীরে নিশীথে ,
শূন্য অন্ধকারখানি মলিন মুখশ্রী নিয়ে
দাঁড়িয়ে রহিল একভিতে ।
পশ্চিমের আকাশসীমায়
চাঁদখানি অস্তে যায় যায় ।
ছোটো ছোটো মেঘগুলি সাদা সাদা পাখা তুলি
চলে যায় চাঁদের চুমো নিয়ে ,
আঁধার গাছের ছায় ডুবু ডুবু জোছনায়
ম্লানমুখী রমণী দাঁড়িয়ে ।
বিরহ
ধীরে ধীরে প্রভাত হল , আঁধার মিলায়ে গেল
উষা হাসে কনকবরণী ,
বকুল গাছের তলে কুসুম রাশির পরে
বসিয়া পড়িল সে রমণী ,
আঁখি দিয়া ঝরঝরে অশ্রুবারি ঝ ‘ রে পড়ে
ভেঙে যেতে চায় যেন বুক ,
রাঙা রাঙা অধর দুটি কেঁপে কেঁপে ওঠে কতো ,
করতলে সকরুণ মুখ ।
অরুণ আঁখির’পরে , অরুণের আভা পড়ে ,
কেশপাশে অরুণ লুকায় ,
দুই হাতে মুখ ঢাকে কার নাম ধরে ডাকে
কেন তার সাড়া নাহি পায় ।
বহিছে প্রভাত-বায় আঁচলে লুটিয়ে যায় ,
মাথায় ঝরিয়ে পড়ে ফুল ,
ডালপালা দোলে ধীরে কাননে সরসীতীরে
ফুটে ওঠে মল্লিকা মুকুল ।
পা দুখানি ছড়াইয়া পুরবের পানে চেয়ে
ললিতে প্রাণের গান গায়
গাহিতে গাহিতে গান , সব যেন অবসান
যেন সব-কিছু ভুলে যায় ।
প্রাণ যেন গানে মিশে , অনন্ত আকাশ-মাঝে
উদাসী হইয়ে চঞ্চলে যায় ,
বসে বসে শুধু গান গায় ।
মধ্যাহ্নে
হেরো ওই বাড়িতেছে বেলা ,
বসে আমি রয়েছি একেলা ।
ওই হোথা যায় দেখা সুদূরে বনের রেখা
মিশেছে আকাশনীলিমায়;
দিক হতে দিগন্তরে মাঠ শুধু ধূ ধূ করে ,
বায়ু কোথা বহে চলে যায় ।
সুদূর মাঠের পারে গ্রামখানি এক ধারে,
গাছ দিয়ে ছায়া দিয়ে ঘেরা ।
কাননের গায়ে যেন ছায়াখানি বুলাইয়া
ভেসে চলে কোথায় মেঘেরা ।
মধুর উদাস প্রাণে চাই চারি দিক-পানে ,
স্তব্ধ সব ছবির মতন ।
সব যেন চারি ধারে অবশ আলসভারে
স্বর্ণময় মায়ায় মগন ।
গ্রামখানি , মাঠখানি , উঁচুনিচু পথখানি ,
দু-একটি গাছ মাঝে মাঝে ,
আকাশ-সমুদ্রে-ঘেরা সুবর্ণ দ্বীপের পারা
কোথা যেন সুদূরে বিরাজে ।
কনকলাবণ্য লয়ে যেন অভিভূত হয়ে
আপনাতে আপনি ঘুমায় ,
নিঝুম পাদপলতা , শ্রান্তকায় নীরবতা
শুয়ে আছে গাছের ছায়ায় ।
শুধু অতি মৃদু স্বরে গুন গুন গান করে
যেন সব ঘুমন্ত ভ্রমর ,
যেন মধু খেতে খেতে ঘুমিয়েছে কুসুমেতে
মরিয়া এসেছে কণ্ঠস্বর ।
নীল শূন্যে ছবি আঁকা রবির-কিরণ-মাখা ,
সেথা যেন বাস করিতেছি ।
জীবনের আধখানি যেন ভুলে গেছি আমি ,
কোথা যেন ফেলিয়ে এসেছি ।
আনমনে ধীরি ধীরি বেড়াতেছি ফিরি ফিরি
ঘুমঘোর ছায়ায় ছায়ায় —
কোথা যাব কোথা যাই সে কথা যে মনে নাই ,
ভুলে আছি মধুর মায়ায় ।
মধুর বাতাসে আজি যেন রে উঠিছে বাজি
পরানের ঘুমন্ত বীণাটি ,
ভালোবাসা আজি কেন সঙ্গীহারা পাখি যেন
বসিয়া গাহিছে একেলাটি ।
কে জানে কাহারে চায় , প্রাণ যেন উভরায়,
ডাকে কারে ‘এসো এসো ‘ ব’লে ,
কাছে কারে পেতে চায় , সব তারে দিতে চায় ,
মাথাটি রাখিতে চায় কোলে ।
স্তব্ধ তরুতলে গিয়া পা দুখানি ছড়াইয়া
নিমগন মধুময় মোহে ,
আনমনে গান গেয়ে দূর শূন্যপানে চেয়ে
ঘুমায়ে পড়িতে চায় দোঁহে ।
দূর মরীচিকা-সম ওই বন-উপবন ,
ওরি মাঝে পরান উদাসী —
বিজন বকুলতলে পল্লবের মরমরে
নাম ধরে বাজাইছে বাঁশি ।
সে যেন কোথায় আছে সুদূর বনের পাছে
কত নদী-সমুদ্রের পারে ,
নিভৃত নির্ঝরতীরে লতায় পাতায় ঘিরে
বসে আছে নিকুঞ্জ-আঁধারে ।
সাধ যায় বাঁশি করে বন হতে বনান্তরে
চলে যাই আপনার মনে ,
কুসুমিত নদীতীরে বেড়াইব ফিরে ফিরে
কে জানে কাহার অন্বেষণে ।
সহসা দেখিব তারে , নিমেষেই একেবারে
প্রাণে প্রাণে হইবে মিলন
এই মরীচিকাদেশে দুজনে বাসরবেশে
ছায়ারাজ্যে করিব ভ্রমণ ।
বাঁধিবে সে বাহুপাশে , চোখে তার স্বপ্ন ভাসে ,
মুখে তার হাসির মুকুল —
কে জানে বুকের কাছে আঁচল আছে না আছে ,
পিঠেতে পড়েছে এলো চুল ।
মুখে আধখানি কথা , চোখে আধখানি কথা ,
আধখানি হাসিতে জড়ানো —
দুজনেতে চলে যাই , কে জানে কোথায় যাই
পদতলে কুসুম ছড়ানো ।