আবছায়া
তারা সেই ধীরে ধীরে আসিত
মৃদু মৃদু হাসিত ,
তাদের পড়েছে আজ মনে ।
তারা কথাটি কহিত না ,
কাছেতে রহিত না ,
চেয়ে রইত নয়নে নয়নে ।
তারা চলে যেত আনমনে ,
বেড়াইত বনে বনে ,
আনমনে গাহিত রে গান ।
চুল থেকে ঝরে ঝরে
ফুলগুলি যেত পড়ে ,
কেশপাশে ঢাকিত বয়ান ।
কাছে আমি যাইতাম ,
গানগুলি গাইতাম ,
সাথে সাথে যাইতাম পিছু—
তারা যেন আনমনা ,
শুনিত কি শুনিত না
বুঝিবারে নারিতাম কিছু ।
কভু তারা থাকি থাকি
আনমনে শূন্য আঁখি ,
চাহিয়া রহিত মুখপানে ,
ভালো তারা বাসিত কি ,
মৃদু হাসি হাসিত কি ,
প্রাণে প্রাণ দিত কি , কে জানে!
গাঁথি ফুলে মালাগুলি
যেন তারা যেত ভুলি
পরাইতে আমার গলায় ।
যেন যেতে যেতে ধীরে
চায় তারা ফিরে ফিরে
বকুলের গাছের তলায় ।
যেন তারা ভালোবেসে
ডেকে যেত কাছে এসে ,
চলে যেতে করিত রে মানা—
আমার তরুণ প্রাণে
তাদের হৃদয়খানি
আধো জানা আধেক অজানা ।
কোথা চলে গেল তারা ,
কোথা যেন পথহারা ,
তাদের দেখি নে কেন আর!
কোথা সেই ছায়া-ছায়া
কিশোর-কল্পনা-মায়া ,
মেঘমুখে হাসিটি উষার!
আলোতে ছায়াতে ঘেরা
জাগরণ স্বপনেরা
আশেপাশে করিত রে খেলা—
একে একে পলাইল ,
শূন্যে যেন মিলাইল ,
বাড়িতে লাগিল যত বেলা ।
আর্তস্বর
শ্রাবণে গভীর নিশি দিগ্বিদিক আছে মিশি
মেঘেতে মেঘেতে ঘন বাঁধা ,
কোথা শশী কোথা তারা মেঘারণ্যে পথহারা
আঁধারে আঁধারে সব আঁধা ।
জ্বলন্ত বিদ্যুৎ-অহি ক্ষণে ক্ষণে রহি রহি
অন্ধকারে করিছে দংশন ।
কুম্ভকর্ণ অন্ধকার নিদ্রা টুটি বার বার
উঠিতেছে করিয়া গর্জন ।
শূন্যে যেন স্থান নাই , পরিপূর্ণ সব ঠাঁই ,
সুকঠিন আঁধার চাপিয়া ।
ঝড় বহে , মনে হয় ও যেন রে ঝড় নয় ,
অন্ধকার দুলিছে কাঁপিয়া ।
মাঝে মাঝে থর হ র কোথা হতে মরমর
কেঁদে কেঁদে উঠিছে অরণ্য ।
নিশীথসমুদ্র-মাঝে জলজন্তু-সম রাজে
নিশাচর যেন রে অগণ্য ।
কে যেন রে মুহুর্মুহু নিশ্বাস ফেলিছে হু হু ,
হু হু করে কেঁদে কেঁদে ওঠে ,
সূদূর অরণ্যতলে ডালপালা পায়ে দলে
আর্তনাদ করে যেন ছোটে ।
এ অনন্ত অন্ধকারে কে রে সে , খুঁজিছে কারে ,
তন্ন তন্ন আকাশগহ্বর ।
তারে নাহি দেখে কেহ , শুধু শিহরায় দেহ
শুনি তার তীব্র কণ্ঠস্বর ।
তুই কি রে নিশীথিনী অন্ধকারে অনাথিনী
হারাইলি জগতেরে তোর ?
অনন্ত আকাশ- ‘ পরি ছুটিস রে হা হা করি ,
আলোড়িয়া অন্ধকার ঘোর ।
তাই কি রে থেকে থেকে নাম ধরে ডেকে ডেকে
জগতেরে করিস আহ্বান ।
শুনি আজি তোর স্বর শিহরিত কলেবর ,
কাঁদিয়া উঠিছে কার প্রাণ ।
কে আজি রে তোর সাথে ধরি তোর হাতে হাতে
খুঁজিতে চাহিছে যেন কারে ।
মহাশূন্যে দাঁড়াইয়ে প্রান্ত হতে প্রান্তে গিয়ে
কে চাহে কাঁদিতে অন্ধকারে!
আঁধারেতে আঁখি ফুটে ঝটিকার’পরে ছুটে
তীক্ষ্ণশিখা বিদ্যুৎ মাড়ায়ে
হু হু করি নিশ্বাসিয়া চলে যাবে উদাসিয়া
কেশপাশ আকাশে ছড়ায়ে ।
উলঙ্গিনী উন্মাদিনী ঝটিকার কণ্ঠ জিনি
তীব্র কণ্ঠে ডাকিবে তাহারে ,
সে বিলাপ কেঁপে কেঁপে বেড়াবে আকাশ ব্যেপে
ধ্বনিয়া অনন্ত অন্ধকারে ।
ছিঁড়ি ছিঁড়ি কেশপাশ কভু কান্না কভু হাস
প্রাণ ভরে করিবে চীৎকার ,
বজ্র-আলিঙ্গন দিয়ে বুকে তোরে জড়াইয়ে
ছুটিতে গিয়েছে সাধ তার ।
একাকিনী
একটি মেয়ে একেলা ,
সাঁঝের বেলা ,
মাঠ দিয়ে চলেছে ।
চারি দিকে সোনার ধান ফলেছে ।
ওর মুখেতে পড়েছে সাঁঝের আভা ,
চুলেতে করিছে ঝিকিমিকি ।
কে জানে কী ভাবে মনে মনে
আনমনে চলে ধিকিধিকি ।
পশ্চিমে সোনায় সোনাময় ,
এত সোনা কে কোথা দেখেছে ।
তারি মাঝে মলিন মেয়েটি
কে যেন রে এঁকে রেখেছে ।
মুখখানি কেন গো অমন ধারা ,
কোন্খানে হয়েছে পথহারা ,
কারে যেন কী কথা শুধাবে ,
শুধাইতে ভয়ে হয় সারা ।
চরণ চলিতে বাধে বাধে ,
শুধালে কথাটি নাহি কয় ।
বড়ো বড়ো আকুল নয়নে
শুধু মুখপানে চেয়ে রয় ।
নয়ন করিছে ছলছল ,
এখনি পড়িবে যেন জল ।
সাঁঝেতে নিরালা সব ঠাঁই ,
মাঠে কোথাও জনপ্রাণী নাই —
দূরে অতি দূরে দেখা যায় ,
মলিন সে সাঁঝের আলোতে
ছায়া ছায়া গাছপালাগুলি
মেশে মেশে মেঘের কোলেতে ।
বড়ো তোর বাজিতেছে পায়,
আয় রে আমার কোলে আয় ।
আ মরি জননী তোর কে ,
বল্ রে কোথায় তোর ঘর ।
তরাসে চাহিস কেন রে ,
আমারে বাসিস কেন পর ?
কে ?
আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো !
সে যে ছুঁয়ে গেল নুয়ে গেল রে,
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ।
সে চলে গেল , বলে গেল না ,
সে কোথায় গেল ফিরে এল না ,
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল ,
কী যেন গেয়ে গেল
তাই আপন মনে বসে আছি
কুসুম-বনেতে ।
সে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছে ,
চঁদের আলোর দেশে গেছে ,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে ।
মনে হল আঁখির কোণে
আমায় যেন ডেকে গেছে সে ।
আমি কোথায় যাব কোথায় যাব ,
ভাবতেছি তাই একলা বসে ।
সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল
ঘুমের ঘোর ।
সে প্রাণের কোথা দুলিয়ে গেল
ফুলের ডোর ।
সে কুসুম-বনের উপর দিয়ে
কী কথা যে বলে গেল ,
ফুলের গন্ধ পাগল হয়ে
সঙ্গে তারি চলে গেল ।
হৃদয় আমার আকুল হল ,
নয়ন আমার মুদে এল ,
কোথা দিয়ে কোথায় গেল সে!