- বইয়ের নামঃ ছবি ও গান
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অভিমানিনী
ও আমার অভিমানী মেয়ে
ওরে কেউ কিছু বোলো না ।
ও আমার কাছে এসেছে ,
ও আমায় ভালো বেসেছে ,
ওরে কেউ কিছু বোলো না ।
এলোথেলো চুলগুলি ছড়িয়ে
ওই দেখো সে দাঁড়িয়ে রয়েছে ,
নিমেষহারা আঁখির পাতা দুটি
চোখের জলে ভরে এয়েছে ।
গ্রীবাখানি ঈষৎ বাঁকানো ,
দুটি হাতে মুঠি আছে চাপি ,
ছোটো ছোটো রাঙা রাঙা ঠোঁট
ফুলে ফুলে উঠিতেছে কাঁপি ।
সাধিলে ও কথা কবে না ,
ডাকিলে ও আসিবে না কাছে ,
ও সবার ‘পরে অভিমান করে
আপ্না নিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আছে ।
কী হয়েছে কী হয়েছে বলে
বাতাস এসে চুলিগুলি দোলায়,
রাঙা ওই কপোলখানিতে
রবির হাসি হেসে চুমো খায় ।
কচি হাতে ফুল দুখানি ছিল
রাগ করে ঐ ফেলে দিয়েছে-
পায়ের কাছে পড়ে পড়ে তারা
মুখের পানে চেয়ে রয়েছে ।
আয় বাছা , তুই কোলে বসে বল্
কী কথা তোর বলিবার আছে ,
অভিমানে রাঙা মুখখানি
আন্ দেখি তুই এ বুকের কাছে ।
ধীরে ধীরে আধো আধো বল্ ।
কেঁদে কেঁদে ভাঙা ভাঙা কথা ,
আমায় যদি না বলিবি তুই
কে শুনিবে শিশুপ্রাণের ব্যথা ।
আচ্ছন্ন
লতার লাবণ্য যেন কচি কিশলয়ে ঘেরা ,
সুকুমার প্রাণ তার মাধুরীতে ঢেকেছে-
কোমল মুকুলগুলি চারি দিকে আকুলিত
তারি মাঝে প্রাণ যেন লুকিয়ে রেখেছে ।
ওরে যেন ভালো করে দেখা যায় না ,
আঁখি যেন ডুবে গিয়ে কূল পায় না ।
সাঁঝের আভা নেমে এল , জ্যোৎস্না পাশে ঘুমিয়ে প ‘ ল ,
ফুলের গন্ধ দেখতে এসেছে ,
তারাগুলি ঘিরে বসেছে ।
পূরবী রাগিণীগুলি দূর হতে চলে আসে
ছুঁতে তারে হয় নাকো ভরসা-
কাছে কাছে ফিরে ফিরে মুখপানে চায় তারা ,
যেন তারা মধুময়ী দুরাশা ।
ঘুমন্ত প্রাণেরে ঘিরে স্বপ্নগুলি ঘুরে ফিরে
গাঁথে যেন আলোকের কুয়াশা ,
ঢেকে তারে আছে কত , চারি দিকে শত শত
অনিমিষ নয়নের পিয়াসা ।
ওদের আড়াল থেকে আবছায়া দেখা যায়
অতুলন প্রাণের বিকাশ ,
সোনার মেঘের মাঝে কচি উষা ফোটে ফোটে
পুরবেতে তাহারি আভাস ।
আলোকবসনা যেন আপনি সে ঢাকা আছে
আপনার রূপের মাঝার ,
রেখা রেখা হাসিগুলি আশেপাশে চমকিয়ে
রূপেতেই লুকায় আবার ।
আঁখির আলোক-ছায়া আঁখিরে রয়েছে ঘিরে ,
তারি মাঝে দৃষ্টি পথহারা ,
যেথা চলে স্বর্গ হতে অবিরাম পড়ে যেন
লাবণ্যের পুষ্পবারিধারা ।
ধরণীরে ছুঁয়ে যেন পা দুখানি ভেসে যায় ,
কুসুমের স্রোত বহে যায় ,
কুসুমেরে ফেলে রেখে খেলাধুলা ভুলে গিয়ে
মায়ামুগ্ধ বসন্তের বায় ।
ওরে কিছু শুধাইলে বুঝি রে নয়ন মেলি
দু দণ্ড নীরবে চেয়ে রবে ,
অতুল অধর দুটি ঈষৎ টুটিয়ে বুঝি
অতি ধীরে দুটি কথা কবে ।
আমি কি বুঝি সে ভাষা , শুনিতে কি পাব বাণী
সে যেন কিসের প্রতিধ্বনি —
মধুর মোহের মতো যেমনি ছুঁইবে প্রাণ
ঘুমায়ে সে পড়িবে অমনি ।
হৃদয়ের দূর হতে সে যেন রে কথা কয়
তাই তার অতি মৃদুস্বর ,
বায়ুর হিল্লোলে তাই আকুল কুমুদসম
কথাগুলি কাঁপে থর থর ।
কে তুমি গো উষাময়ী , আপন কিরণ দিয়ে
আপনারে করেছ গোপন ,
রূপের সাগর-মাঝে কোথা তুমি ডুবে আছ
একাকিনী লক্ষ্মীর মতন!
ধীরে ধীরে ওঠো দেখি , একবার চেয়ে দেখি
স্বর্ণজ্যোতি-কমল-আসন ,
সুনীল সলিল হতে ধীরে ধীরে উঠে যথা
প্রভাতের বিমল কিরণ ।
সৌন্দর্যকোরক টুটে এস গো বাহির হয়ে
অনুপম সৌরভের প্রায় ,
আমি তাহে ডুবে যাব সাথে সাথে বহে যাব
উদাসীন বসন্তের বায় ।
আদরিনী
একটুখানি সোনার বিন্দু , একটুখানি মুখ ,
একা একটি বনফুল ফোটে-ফোটে হয়েছে ,
কচি কচি পাতার মাঝে মাথা থুয়ে রয়েছে ।
চার দিকে তার গাছের ছায়া , চার দিকে তার নিষুতি-
চার দিকে তার ঝোপেঝাপে আঁধার দিয়ে ঢেকেছে ,
বনের সে যে স্নেহের ধন আদরিণী মেয়ে ,
তারে বুকের কাছে লুকিয়ে যেন রেখেছে ।
একটুখানি রূপের হাসি আঁধারেতে ঘুমিয়ে আলা ,
বনের স্নেহ শিয়রেতে জেগে আছে ।
সুকুমার প্রাণটুকু তার কিছু যেন জানে না ,
চোখে শুধু সুখের স্বপন লেগে আছে ।
একটি যেন রবির কিরণ ভোরের বেলা বনের মাঝে
খেলাতেছিল নেচে নেচে ,
নিরালাতে গাছের ছায়ে , আঁধারেতে শ্রান্তকায়ে
সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ।
বনদেবী করুণ-হিয়ে তারে যেন কুড়িয়ে নিয়ে
যতন করে আপন ঘরেতে ।
থুয়ে কোমল পাতার’পরে মায়ের মতো স্নেহভরে
ছোঁয় তারে কোমল করেতে ।
ধীরি ধীরি বাতাস গিয়ে আসে তারে দোলা দিয়ে ,
চোখেতে চুমো খেয়ে যায় ।
ঘুরে ফিরে আশেপাশে বার বার ফিরে আসে ,
হাতটি বুলিয়ে দেয় গায় ।
একলা পাখি গাছের শাখে কাছে তোর বসে থাকে ,
সারা দুপুরবেলা শুধু ডাকে ,
যেন তার আর কেহ নাই , সারা দিন একলাটি তাই
স্নেহভরে তোরে নিয়েই থাকে ।
ও পাখির নাম জানি নে , কোথায় ছিল কে তা জানে ,
রাতের বেলায় কোথায় চলে যায় ,
দুপুরবেলা কাছে আসে- সারা দিন বসে পাশে
একটি শুধু আদরের গান গায় ।
রাতে কত তারা ওঠে , ভোরের বেলা চলে যায়-
তোরে তো কেউ দেখে না , জানে না ।
এক কালে তুই ছিলি যেন ওদেরই ঘরের মেয়ে ,
আজকে রে তুই অজানা অচেনা ।
নিত্যি দেখি রাতের বেলা একটি শুধু জোনাই আসে ,
আলো দিয়ে মুখপানে তোর চায় ।
কে জানে সে কী যে করে! তারা-জন্মের কাহিনী তোর
কানে বুঝি স্বপন দিয়ে যায় ।
ভোরের বেলা আলো এল , ডাকছে রে তোর নামটি ধরে ,
আজকে তবে মুখখানি তোর তোল্ ,
আজকে তবে আঁখিটি তোর খোল্ ,
লতা জাগে , পাখি জাগে গায়ের কাছে বাতাস লাগে ,
দেখি রে — ধীরে ধীরে দোল্ দোল্ দোল্ ।