সভ্যতার প্রতি
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব—
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।
সমাপ্তি
যদিও বসন্ত গেছে তবু বারে বারে
সাধ যায় বসন্তের গান গাহিবারে।
সহসা পঞ্চম রাগ আপনি সে বাজে,
তখনি থামাতে চাই শিহরিয়া লাজে।
যত-না মধুর হোক মধুরসাবেশ
যেখানে তাহার সীমা সেথা করো শেষ।
যেখানে আপনি থামে যাক থেমে গীতি,
তার পরে থাক্ তার পরিপূর্ণ স্মৃতি।
পূর্ণতারে পূর্ণতর করিবারে, হায়,
টানিয়া কোরো না ছিন্ন বৃথা দুরাশায়!
নিঃশব্দে দিনের অন্তে আসে অন্ধকার,
তেমনি হউক শেষ শেষ যা হবার।
আসুক বিষাদভরা শান্ত সান্ত্বনায়
মধুরমিলন-অন্তে সুন্দর বিদায়।
সামান্য লোক
সন্ধ্যাবেলা লাঠি কাঁখে বোঝা বহি শিরে
নদীতীরে পল্লীবাসী ঘরে যায় ফিরে।
শত শতাব্দীর পরে যদি কোনোমতে
মন্ত্রবলে অতীতের মৃত্যুরাজ্য হতে
এই চাষী দেখা দেয় হয়ে মূর্তিমান,
এই লাঠি কাঁখে লয়ে, বিস্মিত নয়ান,
চারি দিকে ঘিরি তারে অসীম জনতা
কাড়াকাড়ি করি লবে তার প্রতি কথা।
তার সুখদুঃখ যত, তার প্রেম স্নেহ,
তার পাড়াপ্রতিবেশী, তার নিজ গেহ,
তার খেত, তার গোরু, তার চাষ-বাস,
শুনে শুনে কিছুতেই মিটিবে না আশ।
আজি যার জীবনের কথা তুচ্ছতম
সেদিন শুনাবে তাহা কবিত্বের সম।
স্নেহগ্রাস
অন্ধ মোহবন্ধ তব দাও মুক্ত করি—
রেখো না বসায়ে দ্বারে জাগ্রত প্রহরী
হে জননী, আপনার স্নেহ-কারাগারে
সন্তানেরে চিরজন্ম বন্দী রাখিবারে।
বেষ্টন করিয়া তারে আগ্রহ-পরশে,
জীর্ণ করি দিয়া তারে লালনের রসে,
মনুষ্যত্ব-স্বাধীনতা করিয়া শোষণ
আপন ক্ষুধিত চিত্ত করিবে পোষণ?
দীর্ঘ গর্ভবাস হতে জন্ম দিলে যার
স্নেহগর্ভে গ্রাসিয়া কি রাখিবে আবার?
চলিবে সে এ সংসারে তব পিছু-পিছু?
সে কি শুধু অংশ তব, আর নহে কিছু?
নিজের সে, বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার—
সন্তান নহে, গো মাতঃ, সম্পত্তি তোমার।
স্নেহদৃশ্য
বয়স বিংশতি হবে, শীর্ণ তনু তার
বহু বরষের রোগে অস্থিচর্মসার।
হেরি তার উদাসীন হাসিহীন মুখ
মনে হয় সংসারে লেশমাত্র সুখ
পারে না সে কোনোমতে করিতে শোষণ
দিয়ে তার সর্বদেহ সর্বপ্রাণমন।
স্বল্পপ্রাণ শীর্ণ দীর্ঘ জীর্ণ দেহভার
শিশুসম কক্ষে বহি জননী তাহার
আশাহীন দৃঢ়ধৈর্য মৌনম্লানমুখে
প্রতিদিন লয়ে আসে পথের সম্মুখে।
আসে যায় রেলগাড়ি, ধায় লোকজন—
সে চাঞ্চল্যে মুমূর্ষুর অনাসক্ত মন
যদি কিছু ফিরে চায় জগতের পানে,
এইটুকু আশা ধরি মা তাহারে আনে।
স্বপ্ন
কাল রাতে দেখিনু স্বপন —
দেবতা – আশিস – সম শিয়রে সে বসি মম
মুখে রাখি করুণনয়ন
কোমল অঙ্গুলি শিরে বুলাইছে ধীরে ধীরে
সুধামাখা প্রিয় – পরশন —
কাল রাতে হেরিনু স্বপন ।
হেরি সেই মুখপানে বেদনা ভরিল প্রাণে
দুই চক্ষু জলে ছলছলি —
বুকভরা অভিমান আলোড়িয়া মর্মস্থান
কণ্ঠে যেন উঠিল উছলি ।
সে শুধু আকুল চোখে নীরবে গভীর শোকে
শুধাইল , “ কী হয়েছে তোর ?”
কী বলিতে গিয়ে প্রাণ ফেটে হল শতখান ,
তখনি ভাঙিল ঘুমঘোর ।
অন্ধকার নিশীথিনী ঘুমাইছে একাকিনী ,
অরণ্যে উঠিছে ঝিল্লিস্বর ,
বাতায়নে ধ্রুবতারা চেয়ে আছে নিদ্রাহারা —
নতনেত্রে গণিছে প্রহর ।
দীপ – নির্বাপিত ঘরে শুয়ে শূন্য শয্যা – পরে
ভাবিতে লাগিনু কতক্ষণ —
শিথানে মাথাটি থুয়ে সেও একা শুয়ে শুয়ে
কী জানি কী হেরিছে স্বপন
দ্বিপ্রহরা যামিনী যখন ।
স্বার্থ
কে রে তুই, ওরে স্বার্থ, তুই কতটুকু,
তোর স্পর্শে ঢেকে যায় ব্রহ্মান্ডের মুখ,
লুকায় অনন্ত সত্য—স্নেহ সখ্য প্রীতি
মুহূর্তে ধারণ করে নির্লজ্জ বিকৃতি,
থেমে যায় সৌন্দর্যের গীতি চিরন্তন
তোর তুচ্ছ পরিহাসে। ওগো বন্ধুগণ,
সব স্বার্থ পূর্ণ হোক। ক্ষুদ্রতম কণা
ভান্ডারে টানিয়া আনো—কিছু ত্যজিয়ো না।
আমি লইলাম বাছি চিরপ্রেমখানি,
জাগিছে যাহার মুখে অনন্তর বাণী
অমৃতে অশ্রুতে মাখা। মোর তরে থাক্
পরিহাস্য পুরাতন বিশ্বাস নির্বাক্।
থাক্ মহাবিশ্ব, থাক্ হৃদয়-আসীনা
অন্তরের মাঝখানে যে বাজায় বীণা।
স্মৃতি
সে ছিল আরেক দিন এই তরী-’পরে,
কন্ঠ তার পূর্ণ ছিল সুধাগীতিস্বরে।
ছিল তার আঁখি দুটি ঘনপক্ষ্মচ্ছায়,
সজল মেঘের মতো ভরা করুণায়।
কোমল হৃদয়খানি উদ্বেলিত সুখে,
উচ্ছ্বসি উঠিত হাসি সরল কৌতুকে।
পাশে বসি ব’লে যেত কলকণ্ঠকথা,
কত কী কাহিনী তার কত আকুলতা!
প্রত্যুষে আনন্দভরে হাসিয়া হাসিয়া
প্রভাত-পাখির মতো জাগাত আসিয়া।
স্নেহের দৌরাত্ম্য তার নির্ঝরের প্রায়
আমারে ফেলিত ঘেরি বিচিত্র লীলায়।
আজি সে অনন্ত বিশ্বে আছে কোন্খানে
তাই ভাবিতেছি বসি সজলনয়ানে।
হৃদয়ধর্ম
হৃদয় পাষাণভেদী নির্ঝরের প্রায়,
জড়জন্তু সবাপানে নামিবারে চায়।
মাঝে মাঝে ভেদচিহ্ন আছে যত যার
সে চাহে করিতে মগ্ন লুপ্ত একাকার।
মধ্যদিনে দগ্ধদেহে ঝাঁপ দিয়ে নীরে
মা ব’লে সে ডেকে ওঠে স্নিগ্ধ তটিনীরে।
যে চাঁদ ঘরের মাঝে হেসে দেয় উঁকি
সে যেন ঘরেরই মেয়ে শিশু সুধামুখী।
যে-সকল তরুলতা রচি উপবন
গৃহপার্শ্বে বাড়িয়াছে, তারা ভাইবোন।
যে পশুরে জন্ম হতে আপনার জানি,
হৃদয় আপনি তারে ডাকে ‘পুঁটুরানী’।
বুদ্ধি শুনে হেসে ওঠে, বলে—কী মূঢ়তা!
হৃদয় লজ্জায় ঢাকে হৃদয়ের কথা।