মেঘদূত
নিমেষে টুটিয়া গেল সে মহাপ্রতাপ।
ঊর্ধ্ব হতে একদিন দেবতার শাপ
পশিল সে সুখরাজ্যে, বিচ্ছেদের শিখা
করিয়া বহন; মিলনের মরীচিকা,
যৌবনের বিশ্বগ্রাসী মত্ত অহমিকা
মুহূর্তে মিলায়ে গেল মায়াকুহেলিকা
খররৌদ্রকরে। ছয় ঋতু সহচরী
ফেলিয়া চামরছত্র, সভাভঙ্গ করি
সহসা তুলিয়া দিল রঙ্গযবনিকা—
সহসা খুলিয়া গেল, যেন চিত্রে লিখা,
আষাঢ়ের অশ্রুপ্লুত সুন্দর ভুবন।
দেখা দিল চারি দিকে পর্বত কানন
নগর নগরী গ্রাম—বিশ্বসভামাঝে
তোমার বিরহবীণা সকরুণ বাজে।
মৌন
যাহা-কিছু বলি আজি সব বৃথা হয়,
মন বলে মাথা নাড়ি—এ নয়, এ নয়।
যে কথায় প্রাণ মোর পরিপূর্ণতম
সে কথা বাজে না কেন এ বীণায় মম।
সে শুধু ভরিয়া উঠি অশ্রুর আবেগে
হৃদয়আকাশ ঘিরে ঘনঘোর মেঘে;
মাঝে মাঝে বিদ্যুতের বিদীর্ণ রেখায়
অন্তর করিয়া ছিন্ন কী দেখাতে চায়?
মৌন মূক মূঢ়-সম ঘনায়ে আঁধারে
সহসা নিশীথরাত্রে কাঁদে শত ধারে।
বাক্যভারে রুদ্ধকণ্ঠ, রে স্তম্ভিত প্রাণ,
কোথায় হারায়ে এলি তোর যত গান।
বাঁশি যেন নাই, বৃথা নিশ্বাস কেবল—
রাগিনীর পরিবর্তে শুধু অশ্রুজল।
যাত্রী
ওরে যাত্রী, যেতে হবে বহুদূরদেশে।
কিসের করিস চিন্তা বসি পথশেষে?
কোন্ দুঃখে কাঁদে প্রাণ? কার পানে চাহি
বসে বসে দিন কাটে শুধু গান গাহি
শুধু মুগ্ধনেত্র মেলি? কার কথা শুনে
মরিস জ্বলিয়া মিছে মনের আগুনে?
কোথায় রহিবে পড়ি এ তোর সংসার!
কোথায় পশিবে সেথা কলরব তার!
মিলাইবে যুগ যুগ স্বপনের মতো,
কোথা রবে আজিকার কুশাঙ্কুরক্ষত!
নীরবে জ্বলিবে তব পথের দু ধারে
গ্রহতারকার দীপ কাতারে কাতারে।
তখনো চলেছ একা অনন্ত ভুবনে—
কোথা হতে কোথা গেছ না রহিবে মনে।
শান্তিমন্ত্র
কাল আমি তরী খুলি লোকালয়মাঝে
আবার ফিরিয়া যাব আপনার কাজে—
হে অন্তর্যামিনী দেবী, ছেড়ো না আমারে,
যেয়ো না একেলা ফেলি জনতাপাথারে
কর্মকোলাহলে। সেথা সর্ব ঝঞ্ঝনায়
নিত্য যেন বাজে চিত্তে তোমার বীণায়
এমনি মঙ্গলধ্বনি। বিদ্বেষের বাণে
বক্ষ বিদ্ধ করি যবে রক্ত টেনে আনে,
তোমার সান্ত্বনাসুধা অশ্রুবারিসম
পড়ে যেন বিন্দু বিন্দু ক্ষতপ্রাণে মম।
বিরোধ উঠিবে গর্জি শতফণা ফণী,
তুমি মৃদুস্বরে দিয়ো শান্তিমন্ত্রধ্বনি—
স্বার্থ মিথ্যা, সব মিথ্যা—বোলো কানে কানে—
আমি শুধু নিত্য সত্য তোর মাঝখানে।
শুশ্রূষা
ব্যথাক্ষত মোর প্রাণ লয়ে তব ঘরে
অতিথিবৎসলা নদী কত স্নেহভরে
শুশ্রূষা করিলে আজি— স্নিগ্ধ হস্তখানি
দগ্ধ হৃদয়ের মাঝে সুধা দিল আনি।
সায়াহ্ন আসিল নামি, পশ্চিমের তীরে
ধান্যক্ষেত্রে রক্তরবি অস্ত গেল ধীরে।
পূর্বতীরে গ্রাম বন নাহি যায় দেখা,
জ্বলন্ত দিগন্তে শুধু মসীপুঞ্জরেখা;
সেথা অন্ধকার হতে আনিছে সমীর
কর্ম-অবসান-ধ্বনি অজ্ঞাত পল্লীর।
দুই তীর হতে তুলি দুই শান্তিপাখা
আমারে বুকের মাঝে দিলে তুমি ঢাকা।
চুপি চুপি বলি দিলে, “বৎস, জেনো সার,
সুখ দুঃখ বাহিরের, শান্তি সে আত্মার।”
শেষ কথা
মাঝে মাঝে মনে হয়, শত কথা-ভারে
হৃদয় পড়েছে যেন নুয়ে একেবারে।
যেন কোন্ ভাবযজ্ঞ বহু আয়োজনে
চলিতেছে অন্তরের সুদূর সদনে।
অধীর সিন্ধুর মতো কলধ্বনি তার
অতি দূর হতে কানে আসে বারম্বার।
মনে হয় কত ছন্দ, কত-না রাগিণী,
কত-না আশ্চর্য গাথা, অপূর্ব কাহিনী,
যতকিছু রচিয়াছে যত কবিগণে
সব মিলিতেছে আসি অপূর্ব মিলনে—
এখনি বেদনাভরে ফাটি গিয়া প্রাণ
উচ্ছ্বসি উঠিবে যেন সেই মহাগান।
অবশেষে বুক ফেটে শুধু বলি আসি—
হে চিরসুন্দর, আমি তোরে ভালবাসি।
শেষ চুম্বন
দূর স্বর্গে বাজে যেন নীরব ভৈরবী।
ঊষার করুণ চাঁদ শীর্ণমুখচ্ছবি।
ম্লান হয়ে এল তারা; পূর্বদিগ্বধূর
কপোল শিশিরসিক্ত, পান্ডুর, বিধুর।
ধীরে ধীরে নিবে গেল শেষ দীপশিখা,
খসে গেল যামিনীর স্বপ্নযবনিকা।
প্রবেশিল বাতায়নে পরিতাপসম
রক্তরশ্মি প্রভাতের আঘাত নির্মম।
সেইক্ষণে গৃহদ্বারে সত্বর সঘন
আমাদের সর্বশেষ বিদায়-চুম্বন।
মুহূর্তে উঠিল বাজি চারি দিক হতে
কর্মের ঘর্ঘরমন্দ্র সংসারের পথে।
মহারবে সিংহদ্বার খুলে বিশ্বপুরে—
অশ্রুজল মুছে ফেলি চলি গেনু দূরে।
সঙ্গী
আরেক দিনের কথা পড়ি গেল মনে।
একদা মাঠের ধারে শ্যাম তৃণাসনে
একটি বেদের মেয়ে অপরাহ্নবেলা
কবরী বাঁধিতেছিল বসিয়া একেলা।
পালিত কুকুরশিশু আসিয়া পিছনে
কেশের চাঞ্চল্য হেরি খেলা ভাবি মনে
লাফায়ে লাফায়ে উচ্চে করিয়া চিৎকার
দংশিতে লাগিল তার বেণী বারম্বার।
বালিকা ভর্ৎসিল তারে গ্রীবাটি নাড়িয়া,
খেলার উৎসাহ তাহে উঠিল বাড়িয়া।
বালিকা মারিল তারে তুলিয়া তর্জনী,
দ্বিগুণ উঠিল মেতে খেলা মনে গণি।
তখন হাসিয়া উঠি লয়ে বক্ষ-’পরে
বালিকা ব্যথিল তারে আদরে আদরে।
সতী
সতীলোকে বসি আছে কত পতিব্রতা,
পুরাণে উজ্জ্বল আছে যাঁহাদের কথা।
আরো আছে শত লক্ষ অজ্ঞাতনামিনী
খ্যাতিহীনা কীর্তিহীনা কত-না কামিনী—
কেহ ছিল রাজসৌধে কেহ পর্ণঘরে,
কেহ ছিল সোহাগিনী কেহ অনাদরে;
শুধু প্রীতি ঢালি দিয়া মুছি লয়ে নাম
চলিয়া এসেছে তারা ছাড়ি মর্তধাম।
তারি মাঝে বসি আছে পতিতা রমণী
মর্তে কলঙ্কিনী, স্বর্গে সতীশিরোমণি।
হেরি তারে সতীগর্বে গরবিনী যত
সাধ্বীগণ লাজে শির করে অবনত।
তুমি কী জানিবে বার্তা, অন্তর্যামী যিনি
তিনিই জানেন তার সতীত্বকাহিনী।