প্রিয়া
শত বার ধিক্ আজি আমারে, সুন্দরী,
তোমারে হেরিতে চাহি এত ক্ষুদ্র করি।
তোমার মহিমাজ্যোতি তব মূর্তি হতে
আমার অন্তরে পড়ি ছড়ায় জগতে।
যখন তোমার ‘পরে পড়ে নি নয়ন
জগৎ-লক্ষ্মীর দেখা পাই নি তখন।
স্বর্গের অঞ্জন তুমি মাখাইলে চোখে,
তুমি মোরে রেখে গেছ অনন্ত এ লোকে।
এ নীল আকাশ এত লাগিত কি ভালো,
যদি না পড়িত মনে তব মুখ-আলো।
অপরূপ মায়াবলে তব হাসি-গান
বিশ্বমাঝে লভিয়াছে শত শত প্রাণ।
তুমি এলে আগে-আগে দীপ লয়ে করে,
তব পাছে পাছে বিশ্ব পশিল অন্তরে।
প্রেম
নিবিড়তিমির নিশা, অসীম কান্তার,
লক্ষ দিকে লক্ষ জন হইতেছে পার।
অন্ধকারে অভিসার, কোন্ পথপানে
কার তরে, পান্থ তাহা আপনি না জানে।
শুধু মনে হয় চিরজীবনের সুখ
এখনি দিবেক দেখা লয়ে হাসিমুখ।
কত স্পর্শ কত গন্ধ কত শব্দ গান
কাছ দিয়ে চলে যায় শিহরিয়া প্রাণ।
দৈবযোগে ঝলি উঠে বিদ্যুতের আলো,
যারেই দেখিতে পাই তারে বাসি ভালো—
তাহারে ডাকিয়া বলি—ধন্য এ জীবন,
তোমারি লাগিয়া মোর এতেক ভ্রমণ।
অন্ধকারে আর সবে আসে যায় কাছে,
জানিতে পারি নে তারা আছে কি না আছে।
প্রেয়সী
হে প্রেয়সী, হে শ্রেয়সী, হে বীণাবাদিনী,
আজি মোর চিত্তপদ্মে বসি একাকিনী
ঢালিতেছ স্বর্গসুধা; মাথার উপর
সদ্যস্নাত বরষার স্বচ্ছ নীলাম্বর
রাখিয়াছে স্নিগ্ধহস্ত আশীর্বাদে ভরা;
সম্মুখেতে শস্যপূর্ণ হিল্লোলিত ধরা
বুলায় নয়নে মোর অমৃতচুম্বন;
উতলা বাতাস আসি করে আলিঙ্গন;
অন্তরে সঞ্চার করি আনন্দের বেগ
বহে যায় ভরা নদী; মধ্যাহ্নের মেঘ
স্বপ্নমালা গাঁথি দেয় দিগন্তের ভালে।
তুমি আজি মুগ্ধমুখী আমারে ভুলালে,
ভুলাইলে সংসারের শতলক্ষ কথা—
বীণাস্বরে রচি দিলে মহা নীরবতা।
বঙ্গমাতা
পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।
বন
শ্যামল সুন্দর সৌম্য, হে অরণ্যভূমি,
মানবের পুরাতন বাসগৃহ তুমি।
নিশ্চল নির্জীব নহ সৌধের মতন—
তোমার মুখশ্রীখানি নিত্যই নূতন
প্রাণে প্রেমে ভাবে অর্থে সজীব সচল।
তুমি দাও ছায়াখানি, দাও ফুল ফল,
দাও বস্ত্র, দাও শয্যা, দাও স্বাধীনতা;
নিশিদিন মর্মরিয়া কহ কত কথা
অজানা ভাষার মন্ত্র; বিচিত্র সংগীতে
গাও জাগরণগাথা; গভীর নিশীথে
পাতি দাও নিস্তব্ধতা অঞ্চলের মতো
জননীবক্ষের; বিচিত্র হিল্লোলে কত
খেলা কর শিশুসনে; বৃদ্ধের সহিত
কহ সনাতন বাণী বচন-অতীত।
বনে ও রাজ্যে
সারাদিন কাটাইয়া সিংহাসন পরে
সন্ধ্যায় পশিল রাম শয়নের ঘরে।
শয্যার আধেক অংশ শূন্য বহুকাল,
তারি পরে রাখিলেন পরিশ্রান্ত ভাল।
দেবশূন্য দেবালয়ে ভক্তের মতন
বসিলেন ভূমি-পরে সজলনয়ন,
কহিলেন নতজানু কাতর নিশ্বাসে—
“যতদিন দীনহীন ছিনু বনবাসে
নাহি ছিল স্বর্ণমণি মাণিক্যমুকতা,
তুমি সদা ছিলে লক্ষ্মী প্রত্যক্ষ দেবতা।
আজি আমি রাজ্যেশ্বর, তুমি নাই আর,
আছে স্বর্ণমাণিক্যের প্রতিমা তোমার।”
নিত্যসুখ দীনবেশে বনে গেল ফিরে,
স্বর্ণময়ী চিরব্যথা রাজার মন্দিরে।
বর্ষশেষ
নির্মল প্রত্যুষে আজি যত ছিল পাখি
বনে বনে শাখে শাখে উঠিয়াছে ডাকি।
দোয়েল শ্যামার কণ্ঠে আনন্দ-উচ্ছ্বাস,
গেয়ে গেয়ে পাপিয়ার নাহি মিটে আশ।
করুণ মিনতিস্বরে অশ্রান্ত কোকিল
অন্তরের আবেদনে ভরিছে নিখিল।
কেহ নাচে, কেহ গায়, উড়ে মত্তবৎ,
ফিরিয়া পেয়েছে যেন হারানো জগৎ।
পাখিরা জানে না কেহ আজি বর্ষশেষ,
বকবৃদ্ধ-কাছে নাহি শুনে উপদেশ।
যতদিন এ আকাশে এ জীবন আছে,
বরষের শেষ নাহি তাহাদের কাছে।
মানুষ আনন্দহীন নিশিদিন ধরি
আপনারে ভাগ করে শতখানা করি।
বিদায়
হে তটিনী, সে নগরে নাই কলস্বন
তোমার কণ্ঠের মতো; উদার গগন,
অলিখিত মহাশাস্ত্র, নীল পত্রগুলি
দিক হতে দিগন্তরে নাহি রাখে খুলি;
শান্ত স্নিগ্ধ বসুন্ধরা শ্যামল অঞ্জনে
সত্যের স্বরূপখানি নির্মল নয়নে
রাখে না নবীন করি— সেথায় কেবল
একমাত্র আপনার অন্তর সম্বল
অকূলের মাঝে। তাই ভীতশিশুপ্রায়
হৃদয় চাহে না আজি লইতে বিদায়
তোমা-সবাকার কাছে। তাই প্রাণপণে
আঁকড়িয়া ধরিতেছে আর্ত আলিঙ্গনে
নির্জনলক্ষ্মীরে। শুভশান্তিপত্র তব
অন্তরে বাঁধিয়া দাও, কণ্ঠে পরি লব।
বিলয়
যেন তার আঁখি দুটি নবনীল ভাসে
ফুটিয়া উঠিছে আজি অসীম আকাশে।
বৃষ্টিধৌত প্রভাতের আলোকহিল্লোলে
অশ্রুমাখা হাসি তার বিকাশিয়া তোলে।
তার সেই স্নেহলীলা সহস্র আকারে
সমস্ত জগৎ হতে ঘিরিছে আমারে।
বরষার নদী-’পরে ছলছল আলো,
দূরতীরে কাননের ছায়া কালো কালো,
দিগন্তের শ্যামপ্রান্তে শান্ত মেঘরাজি—
তারি মুখখানি যেন শতরূপ সাজি।
আঁখি তার কহে যেন মোর মুখে চাহি—
“আজ প্রাতে সব পাখি উঠিয়াছে গাহি,
শুধু মোর কণ্ঠস্বর এ প্রভাতবায়ে
অনন্ত জগৎমাঝে গিয়েছে হারায়ে।”