পরবেশ
কে তুমি ফিরিছ পরি প্রভুদের সাজ।
ছদ্মবেশে বাড়ে না কি চতুর্গুণ লাজ!
পরবস্ত্র অঙ্গে তব হয়ে অধিষ্ঠান
তোমারেই করিছে না নিত্য অপমান?
বলিছে না, “ওরে দীন, যত্নে মোরে ধরো,
তোমার চর্মের চেয়ে আমি শ্রেষ্ঠতর?”
চিত্তে যদি নাহি থাকে আপন সম্মান,
পৃষ্ঠে তবে কালো বস্ত্র কলঙ্কনিশান।
ওই তুচ্ছ টুপিখানা চড়ি তব শিরে
ধিক্কার দিতেছে না কি তব স্বজাতিরে।
বলিতেছে, “যে মস্তক আছে মোর পায়
হীনতা ঘুচেছে তার আমারি কৃপায়।”
সর্বাঙ্গে লাঞ্ছনা বহি এ কী অহংকার!
ওর কাছে জীর্ণ চীর জেনো অলংকার।
পরিচয়
একদিন দেখিলাম উলঙ্গ সে ছেলে
ধুলি-’পরে বসে আছে পা-দুখানি মেলে।
ঘাটে বসি মাটি ঢেলা লইয়া কুড়ায়ে
দিদি মাজিতেছে ঘটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে।
অদূরে কোমললোম ছাগবৎস ধীরে
চরিয়া ফিরিতেছিল নদী-তীরে-তীরে।
সহসা সে কাছে আসি থাকিয়া থাকিয়া
বালকের মুখ চেয়ে উঠিল ডাকিয়া।
বালক চমকি কাঁপি কেঁদে ওঠে ত্রাসে,
দিদি ঘাটে ঘটি ফেলে ছুটে চলে আসে।
এক কক্ষে ভাই লয়ে অন্য কক্ষে ছাগ
দুজনেরে বাঁটি দিল সমান সোহাগ!
পশুশিশু, নরশিশু—দিদি মাঝে প’ড়ে
দোঁহারে বাঁধিয়া দিল পরিচয়ডোরে।
পল্লীগ্রামে
হেথায় তাহারে পাই কাছে —
যত কাছে ধরাতল , যত কাছে ফুলফল —
যত কাছে বায়ু জল আছে ।
যেমন পাখির গান , যেমন জলের তান ,
যেমনি এ প্রভাতের আলো ,
যেমনি এ কোমলতা , অরণ্যের শ্যামলতা ,
তেমনি তাহারে বাসি ভালো ।
যেমন সুন্দর সন্ধ্যা , যেমন রজনীগন্ধা ,
শুকতারা আকাশের ধারে ,
যেমন সে অকলুষা শিশিরনির্মলা উষা ,
তেমনি সুন্দর হেরি তারে ।
যেমন বৃষ্টির জল , যেমন আকাশতল ,
সুখসুপ্তি যেমন নিশার ,
যেমন তটিনীনীর , বটচ্ছায়া অটবীর ,
তেমনি সে মোর আপনার ।
যেমন নয়ন ভরি অশ্রুজল পড়ে ঝরি
তেমনি সহজ মোর গীতি —
যেমন রয়েছে প্রাণ ব্যাপ্ত করি মর্মস্থান
তেমনি রয়েছে তার প্রীতি ।
পুঁটু
চৈত্রের মধ্যাহ্নবেলা কাটিতে না চাহে।
তৃষাতুরা বসুন্ধরা দিবসের দাহে।
হেনকালে শুনিলাম বাহিরে কোথায়
কে ডাকিল দূর হতে, “পুঁটুরানী, আয়।”
জনশূন্য নদীতটে তপ্ত দ্বিপ্রহরে
কৌতুহল জাগি উঠে স্নেহকণ্ঠস্বরে।
গ্রন্থখানি বন্ধ করি উঠিলাম ধীরে,
দুয়ার করিয়া ফাঁক দেখিনু বাহিরে।
মহিষ বৃহৎকায় কাদামাখা গায়ে
স্নিগ্ধনেত্রে নদীতীরে রয়েছে দাঁড়ায়ে।
যুবক নামিয়া জলে ডাকিছে তাহায়
স্নান করাবার তরে, “পুঁটুরানী, আয়!”
হেরি সে যুবারে—হেরি পুঁটুরানী তারি
মিশিল কৌতুকে মোর স্নিগ্ধ সুধাবারি।
পুণ্যের হিসাব
সাধু যবে স্বর্গে গেল, চিত্রগুপ্তে ডাকি
কহিলেন, “আনো মোর পুণ্যের হিসাব।”
চিত্রগুপ্ত খাতাখানি সম্মুখেতে রাখি
দেখিতে লাগিল তার মুখের কী ভাব।
সাধু কহে চমকিয়া, “মহা ভুল এ কী!
প্রথমের পাতাগুলো ভরিয়াছ আঁকে,
শেষের পাতায় এ যে সব শূন্য দেখি—
যতদিন ডুবে ছিনু সংসারের পাঁকে
ততদিন এত পুণ্য কোথা হতে আসে!”
শুনি কথা চিত্রগুপ্ত মনে মনে হাসে।
সাধু মহা রেগে বলে, “যৌবনের পাতে
এত পুণ্য কেন লেখ দেবপূজা-খাতে।”
চিত্রগুপ্ত হেসে বলে, “বড়ো শক্ত বুঝা।
যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।”
প্রথম চুম্বন
স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি—
বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।
শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর
মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর
বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।
অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,
আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি।
প্রভাত
নির্মল তরুণ উষা, শীতল সমীর,
শিহরি শিহরি উঠে শান্ত নদীনীর।
এখনো নামে নি জলে রাজহাঁসগুলি,
এখনো ছাড়ে নি নৌকা সাদা পাল তুলি।
এখনো গ্রামের বধূ আসে নাই ঘাটে,
চাষি নাহি চলে পথে, গোরু নাই মাঠে।
আমি শুধু একা বসি মুক্ত বাতায়নে
তপ্ত ভাল পাতিয়াছি উদার গগনে।
বাতাস সোহাগস্পর্শ বুলাইছে কেশে,
প্রসন্ন কিরণখানি মুখে পড়ে এসে।
পাখির আনন্দগান দশ দিক হতে
দুলাইছে নীলাকাশ অমৃতের স্রোতে।
ধন্য আমি হেরিতেছি আকাশের আলো,
ধন্য আমি জগতেরে বাসিয়াছি ভালো।
প্রাচীন ভারত
দিকে দিকে দেখা যায় বিদর্ভ, বিরাট,
অযোধ্যা, পাঞ্চাল, কাঞ্চী উদ্ধতললাট
স্পর্ধিছে অম্বরতল অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে,
অশ্বের হ্রেষায় আর হস্তীর বৃংহিতে,
অসির ঝঞ্ঝনা আর ধনুর টংকারে,
বীণার সংগীত আর নূপুরঝংকারে,
বন্দীর বন্দনারবে, উৎসব-উচ্ছ্বাসে,
উন্নাদ শঙ্খের গর্জে, বিজয়-উল্লাসে,
রথের ঘর্ঘরমন্দ্রে, পথের কল্লোলে
নিয়ত ধ্বনিত ধ্মাত কর্মকলরোলে।
ব্রাহ্মণের তপোবন অদূরে তাহার,
নির্বাক্ গম্ভীর শান্ত সংযত উদার।
হেথা মত্ত স্ফীতস্ফূর্ত ক্ষত্রিয়গরিমা,
হোথা স্তব্ধ মহামৌন ব্রাহ্মণমহিমা।
প্রার্থনা
আজি কোন্ ধন হতে বিশ্ব আমারে
কোন্ জনে করে বঞ্চিত
তব চরণকমলরতনরেণুকা
অন্তরে আছে সঞ্চিত ।
কত নিঠুর কঠোর দরশে ঘরষে
মর্মমাঝারে শল্য বরষে
তবু প্রাণমন পীযূষপরশে
পলে পলে পুলকাঞ্চিত !
আজি কিসের পিপাসা মিটিল না , ওগো
পরম – পরান – বল্লভ ।
চিতে চিরসুধা করে সঞ্চার , তব
সকরুণ করপল্লব ।
হেথা কত দিনে রাতে অপমানঘাতে
আছি নতশির গঞ্জিত ,
তবু চিত্তললাট তোমারি স্বকরে
রয়েছে তিলকরঞ্জিত ।
হেথা কে আমার কানে কঠিন বচনে
বাজায় বিরোধঝঞ্ঝনা !
প্রাণে দিবসরজনী উঠিতেছে ধ্বনি
তোমারি বীণার গুঞ্জনা ।
নাথ , যার যাহা আছে তার তাই থাক্ ,
আমি থাকি চিরলাঞ্ছিত ।
শুধু তুমি এ জীবনে নয়নে নয়নে
থাকো থাকো চিরবাঞ্ছিত ।