দিদি
নদীতীরে মাটি কাটে সাজাইতে পাঁজা
পশ্চিমি মজুর। তাহাদেরি ছোটো মেয়ে
ঘাটে করে আনাগোনা; কত ঘষামাজা
ঘটি বাটি থালা লয়ে, আসে ধেয়ে ধেয়ে
দিবসে শতেক বার; পিত্তলকঙ্কণ
পিতলের থালি-’পরে বাজে ঠন্ ঠন্;
বড়ো ব্যস্ত সারাদিন, তারি ছোটো ভাই,
নেড়ামাথা, কাদামাখা, গায়ে বস্ত্র নাই,
পোষা প্রাণীটির মতো পিছে পিছে এসে
বসি থাকে উচ্চ পাড়ে দিদির আদেশে
স্থিরধৈর্যভরে। ভরা ঘট লয়ে মাথে,
বাম কক্ষে থালি, যায় বালা ডান হাতে
ধরি শিশুকর—জননীর প্রতিনিধি
কর্মভারে-অবনত অতি ছোটো দিদি।
দুই উপমা
যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
সর্বজন সর্বক্ষণ চলে যেই পথে
তৃণগুল্ম সেথা নাহি জন্মে কোনোমতে;
যে জাতি চলে না কভু তারি পথ-’পরে
তন্ত্র-মন্ত্র-সংহিতায় চরণ না সরে।
দুই বন্ধু
মূঢ় পশু ভাষাহীন নির্বাক্হৃদয়,
তার সাথে মানবের কোথা পরিচয়!
কোন্ আদি স্বর্গলোকে সৃষ্টির প্রভাতে
হৃদয়ে হৃদয়ে যেন নিত্য যাতায়াতে
পথচিহ্ন পড়ে গেছে, আজো চিরদিনে
লুপ্ত হয় নাই তাহা, তাই দোঁহে চিনে।
সেদিনের আত্মীয়তা গেছে বহুদূরে;
তবুও সহসা কোন্ কথাহীন সুরে
পরানে জাগিয়া উঠে ক্ষীণ পূর্বস্মৃতি,
অন্তরে উচ্ছলি উঠে সুধাময়ী প্রীতি,
মুগ্ধ মূঢ় স্নিগ্ধ চোখে পশু চাহে মুখে—
মানুষ তাহারে হেরে স্নেহের কৌতুকে।
যেন দুই ছদ্মবেশে দু বন্ধুর মেলা—
তার পরে দুই জীবে অপরূপ খেলা।
দুর্লভ জন্ম
একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ,
পড়িবে নয়ন-’পরে অন্তিম নিমেষ।
পরদিনে এইমত পোহাইবে রাত,
জাগ্রত জগৎ-’পরে জাগিবে প্রভাত।
কলরবে চলিবেক সংসারের খেলা,
সুখে দু:খে ঘরে ঘরে বহি যাবে বেলা।
সে কথা স্মরণ করি নিখিলের পানে
আমি আজি চেয়ে আছি উৎসুক নয়ানে।
যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলই দুর্লভ ব’লে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।
যা পাই নি তাও থাক্, যা পেয়েছি তাও,
তুচ্ছ ব’লে যা চাই নি তাই মোরে দাও।
দেবতার বিদায়
দেবতামন্দিরমাঝে ভকত প্রবীণ
জপিতেছে জপমালা বসি নিশিদিন।
হেনকালে সন্ধ্যাবেলা ধুলিমাখা দেহে
বস্ত্রহীন জীর্ণ দীন পশিল সে গেহে।
কহিল কাতরকণ্ঠে “গৃহ মোর নাই
এক পাশে দয়া করে দেহো মোরে ঠাঁই।”
সসংকোচে ভক্তবর কহিলেন তারে,
“আরে আরে অপবিত্র, দূর হয়ে যারে।”
সে কহিল, “চলিলাম”—চক্ষের নিমেষে
ভিখারি ধরিল মূর্তি দেবতার বেশে।
ভক্ত কহে, “প্রভু, মোরে কী ছল ছলিলে!”
দেবতা কহিল, “মোরে দূর করি দিলে।
জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়াতরে,
গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে।”
ধরাতল
ছোটো কথা, ছোটো গীত, আজি মনে আসে।
চোখে পড়ে যাহা-কিছু হেরি চারি পাশে।
আমি যেন চলিয়াছি বাহিয়া তরণী,
কূলে কূলে দেখা যায় শ্যামল ধরণী।
সবই বলে, “যাই যাই” নিমেষে নিমেষে,
ক্ষণকাল দেখি ব’লে দেখি ভালোবেসে।
তীর হতে দুঃখ সুখ দুই ভাইবোনে
মোর মুখপানে চায় করুণ নয়নে।
ছায়াময় গ্রামগুলি দেখা যায় তীরে,
মনে ভাবি কত প্রেম আছে তারে ঘিরে।
যবে চেয়ে চেয়ে দেখি উৎসুক নয়ানে
আমার পরান হতে ধরার পরানে—
ভালোমন্দ দুঃখসুখ অন্ধকার-আলো,
মনে হয়, সব নিয়ে এ ধরণী ভালো।
ধ্যান
যত ভালোবাসি, যত হেরি বড়ো ক’রে
তত, প্রিয়তমে, আমি সত্য হেরি তোরে।
যত অল্প করি তোরে, তত অল্প জানি—
কখনো হারায়ে ফেলি, কভু মনে আনি।
আজি এ বসন্তদিনে বিকশিতমন
হেরিতেছি আমি এক অপূর্ব স্বপন—
যেন এ জগৎ নাহি, কিছু নাহি আর,
যেন শুধু আছে এক মহাপারাবার,
নাহি দিন নাহি রাত্রি নাহি দন্ড পল,
প্রলয়ের জলরাশি স্তব্ধ অচঞ্চল;
যেন তারি মাঝখানে পূর্ণ বিকাশিয়া
একমাত্র পদ্ম তুমি রয়েছ ভাসিয়া;
নিত্যকাল মহাপ্রেমে বসি বিশ্বভূপ
তোমামাঝে হেরিছেন আত্মপ্রতিরূপ।
নদীযাত্রা
চলেছে তরণী মোর শান্ত বায়ুভরে।
প্রভাতের শুভ্র মেঘ দিগন্তশিয়রে।
বরষার ভরা নদী তৃপ্ত শিশুপ্রায়
নিস্তরঙ্গ পুষ্ট-অঙ্গ নিঃশব্দে ঘুমায়।
দুই কূলে স্তব্ধ ক্ষেত্র শ্যামশস্যে ভরা,
আলস্যমন্থর যেন পূর্ণগর্ভা ধরা।
আজি সর্ব জলস্থল কেন এত স্থির?
নদীতে না হেরি তরী, জনশূন্য তীর।
পরিপূর্ণ ধরা-মাঝে বসিয়া একাকী
চিরপুরাতন মৃত্যু আজি ম্লান-আঁখি
সেজেছে সুন্দরবেশে, কেশে মেঘভার,
পড়েছে মলিন আলো ললাটে তাহার।
গুঞ্জরিয়া গাহিতেছে সকরুণ তানে,
ভুলায়ে নিতেছে মোর উতলা পরানে।
নারী
তুমি এ মনের সৃষ্টি, তাই মনোমাঝে
এমন সহজে তব প্রতিমা বিরাজে।
যখন তোমারে হেরি জগতের তীরে
মনে হয় মন হতে এসেছ বাহিরে।
যখন তোমারে দেখি মনোমাঝখানে
মনে হয় জন্ম-জন্ম আছ এ পরানে।
মানসীরূপিণী তুমি, তাই দিশে দিশে
সকল সৌন্দর্যসাথে যাও মিলে মিশে।
চন্দ্রে তব মুখশোভা, মুখে চন্দ্রোদয়,
নিখিলের সাথে তব নিত্য বিনিময়।
মনের অনন্ত তৃষ্ণা মরে বিশ্ব ঘুরি,
মিশায় তোমার সাথে নিখিল মাধুরী।
তার পরে মনগড়া দেবতারে মন
ইহকাল পরকাল করে সমর্পণ।
পদ্মা
হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিনে,
গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।
অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন
নতমুখী বধূসম শান্ত বাক্যহীন;
সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে
চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।
সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
নানা কর্মে মোর কাছে আসে নানা জন,
নাহি জানে আমাদের পরানবন্ধন,
নাহি জানে কেন আসি সন্ধ্যা-অভিসারে
বালুকা শয়ন-পাতা নির্জন এ পারে।
যখন মুখর তব চক্রবাকদল
সুপ্ত থাকে জলাশয়ে ছাড়ি কোলাহল,
যখন নিস্তব্ধ গ্রামে তব পূর্বতীরে
রুদ্ধ হয়ে যায় দ্বার কুটিরে কুটিরে,
তুমি কোন্ গান কর আমি কোন্ গান
দুই তীরে কেহ তার পায় নি সন্ধান।
নিভৃতে শরতে গ্রীষ্মে শীতে বরষায়
শত বার দেখাশুনা তোমায় আমায়।
কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে
পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে,
যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে
তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে—
কত গ্রাম কত মাঠ কত ঝাউঝাড়
কত বালুচর কত ভেঙে-পড়া পাড়
পার হয়ে এই ঠাঁই আসিব যখন
জেগে উঠিবে না কোনো গভীর চেতন?
জন্মান্তরে শতবার যে নির্জন তীরে
গোপন হৃদয় মোর আসিত বাহিরে,
আর বার সেই তীরে সে সন্ধ্যাবেলায়
হবে না কি দেখাশুনা তোমায় আমায়?