ক্ষণমিলন
পরম আত্মীয় বলে যারে মনে মানি
তারে আমি কতদিন কতটুকু জানি!
অসীম কালের মাঝে তিলেক মিলনে
পরশে জীবন তার আমার জীবনে।
যতটুকু লেশমাত্র চিনি দুজনায়,
তাহার অনন্তগুণ চিনি নাকো হায়।
দুজনের এক জন এক দিন যবে
বারেক ফিরাবে মুখ, এ নিখিল ভবে
আর কভু ফিরিবে না মুখোমুখি পথে,
কে কার পাইবে সাড়া অনন্ত জগতে!
এ ক্ষণমিলনে তবে, ওগো মনোহর,
তোমারে হেরিনু কেন এমন সুন্দর!
মুহূর্ত-আলোক কেন, হে অন্তরতম,
তোমারে চিনিনু চিরপরিচিত মম?
খেয়া
খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
দুই তীরে দুই গ্রাম আছে জানাশোনা,
সকাল হইতে সন্ধ্যা করে আনাগোনা।
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব কত সর্বনাশ,
নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস,
রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে,
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা,
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা—
শুধু হেথা দুই তীরে, কেবা জানে নাম,
দোঁহাপানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
গান
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
হৃদয়ে আমার ।
যৌবনসমুদ্রমাঝে কোন্ পূর্ণিমায় আজি
এসেছে জোয়ার !
উচ্ছল পাগল নীরে তালে তালে ফিরে ফিরে
এ মোর নির্জন তীরে কী খেলা তোমার !
মোর সর্ব বক্ষ জুড়ে কত নৃত্যে কত সুরে
এসো কাছে যাও দূরে শতলক্ষবার ।
তুমি পড়িতেছ হেসে তরঙ্গের মতো এসে
হৃদয়ে আমার ।
জাগরণসম তুমি আমার ললাট চুমি
উদিছ নয়নে ।
সুষুপ্তির প্রান্ততীরে দেখা দাও ধীরে ধীরে
নবীন কিরণে ।
দেখিতে দেখিতে শেষে সকল হৃদয়ে এসে
দাঁড়াও আকুল কেশে রাতুল চরণে —
সকল আকাশ টুটে তোমাতে ভরিয়া উঠে ,
সকল কানন ফুটে জীবনে যৌবনে ।
জাগরণসম তুমি আমার ললাট চুমি
উদিছ নয়নে ।
কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি
মোর বক্ষ -‘ পরে ।
গোপন শিশিরছলে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে
প্রাণ সিক্ত করে ।
নিঃশব্দ সৌরভরাশি পরানে পশিছে আসি
সুখস্বপ্ন পরকাশি নিভৃত অন্তরে ।
পরশপুলকে ভোর চোখে আসে ঘুমঘোর ,
তোমার চুম্বন , মোর সর্বাঙ্গে সঞ্চরে ।
কুসুমের মতো শ্বসি পড়িতেছ খসি খসি
মোর বক্ষ -‘ পরে ।
গীতহীন
চলে গেছে মোর বীণাপাণি
কতদিন হল সে না জানি ।
কী জানি কী অনাদরে বিস্মৃত ধূলির পরে
ফেলে রেখে গেছে বীণাখানি ।
ফুটেছে কুসুমরাজি — নিখিল জগতে আজি
আসিয়াছে গাহিবার দিন ,
মুখরিত দশ দিক , অশ্রান্ত পাগল পিক ,
উচ্ছ্বসিত বসন্তবিপিন ।
বাজিয়া উঠেছে ব্যথা , প্রাণ – ভরা ব্যাকুলতা ,
মনে ভরি উঠে কত বাণী ,
বসে আছি সারাদিন গীতিহীন স্তুতিহীন —
চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।
আর সে নবীন সুরে বীণা উঠিবে না পুরে ,
বাজিবে না পুরানো রাগিণী ;
যৌবনে যোগিনীমত , লয়ে নিত্য মৌনব্রত
তুই বীণা রবি উদাসিনী ।
কে বসিবে এ আসনে মানসকমলবনে ,
কার কোলে দিব তোরে আনি —
থাক্ পড়ে ওইখানে চাহিয়া আকাশপানে —
চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।
কখনো মনের ভুলে যদি এরে লই তুলে
বাজে বুকে বাজাইতে বীণা ;
যদিও নিখিল ধরা বসন্তে সংগীত ভরা ,
তবু আজি গাহিতে পারি না ।
কথা আজি কথাসার , সুর তাহে নাহি আর ,
গাঁথা ছন্দ বৃথা বলে মানি —
অশ্রুজলে ভরা প্রাণ , নাহি তাহে কলতান —
চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।
ভাবিতাম সুরে বাঁধা এ বীণা আমারি সাধা ,
এ আমার দেবতার বর ;
এ আমারি প্রাণ হতে মন্ত্রভরা সুধাস্রোতে
পেয়েছে অক্ষয় গীতস্বর ।
একদিন সন্ধ্যালোকে অশ্রুজল ভরি চোখে
বক্ষে এরে লইলাম টানি —
আর না বাজিতে চায় , তখনি বুঝিনু হায়
চলে গেছে মোর বীণাপাণি ।
তত্ত্ব ও সৌন্দর্য
শুনিয়াছি নিম্নে তব, হে বিশ্বপাথার,
নাহি অন্ত মহামূল্য মণিমুকুতার।
নিশিদিন দেশে দেশে পন্ডিত ডুবারি
রত রহিয়াছে কত অন্বেষণে তারি।
তাহে মোর নাহি লোভ মহাপারাবার!
যে আলোক জ্বলিতেছে উপরে তোমার,
যে রহস্য দুলিতেছে তব বক্ষতলে,
যে মহিমা প্রসারিত তব নীল জলে,
যে সংগীত উঠে তব নিয়ত আঘাতে,
যে বিচিত্র লীলা তব মহানৃত্যে মাতে,
এ জগতে কভু তার অন্ত যদি জানি,
চিরদিনে কভু তাহে শ্রান্তি যদি মানি,
তোমার অতলমাঝে ডুবিব তখন
যেথায় রতন আছে অথবা মরণ।
তত্ত্বজ্ঞানহীন
যার খুশি রুদ্ধচক্ষে করো বসি ধ্যান,
বিশ্ব সত্য কিম্বা ফাঁকি লভ সেই জ্ঞান।
আমি ততক্ষণ বসি তৃপ্তিহীন চোখে
বিশ্বেরে দেখিয়া লই দিনের আলোকে।
তপোবন
মনশ্চক্ষে হেরি যবে ভারত প্রাচীন
পুরব পশ্চিম হতে উত্তর দক্ষিণ
মহারণ্য দেখা দেয় মহাচ্ছায়া লয়ে।
রাজা রাজ্য-অভিমান রাখি লোকালয়ে
অশ্বরথ দূরে বাঁধি যায় নতশিরে
গুরুর মন্ত্রণা লাগি— স্রোতস্বিনীতীরে
মহর্ষি বসিয়া যোগাসনে, শিষ্যগণ
বিরলে তরুর তলে করে অধ্যয়ন
প্রশান্ত প্রভাতবায়ে, ঋষিকন্যাদলে
পেলব যৌবন বাঁধি পরুষ বল্কলে
আলবালে করিতেছে সলিল সেচন।
প্রবেশিছে বনদ্বারে ত্যজি সিংহাসন
মুকুটবিহীন রাজা পক্ককেশজালে
ত্যাগের মহিমাজ্যোতি লয়ে শান্ত ভালে।
তৃণ
হে বন্ধু, প্রসন্ন হও, দূর করো ক্রোধ।
তোমাদের সাথে মোর বৃথা এ বিরোধ।
আমি চলিবারে চাই যেই পথ বাহি
সেথা কারো তরে কিছু স্থানাভাব নাহি।
সপ্তলোক সেই পথে চলে পাশে পাশে
তবু তার অন্ত নাই মহান আকাশে।
তোমার ঐশ্বর্যরাশি গৃহভিত্তিমাঝে
ব্রহ্মান্ডেরে তুচ্ছ করি দীপ্তগর্বে সাজে।
তারে সেই বিশ্বপথে করিলে বাহির
মুহূর্তে সে হবে ক্ষুদ্র ম্লান নতশির—
সেথা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নব তৃণদল
বরষার বৃষ্টিধারে সরস শ্যামল।
সেথা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, ওগো অভিমান,
এ আমার আজিকার অতি ক্ষুদ্র গান।