উৎসর্গ
আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে
গুচ্ছ গুচ্ছ ধরিয়াছে ফল।
পরিপূর্ণ বেদনার ভরে
মুহূর্তেই বুঝি ফেটে পড়ে,
বসন্তের দুরন্ত বাতাসে
নুয়ে বুঝি নমিবে ভূতল—
রসভরে অসহ উচ্ছ্বাসে
থরে থরে ফলিয়াছে ফল।
তুমি এসো নিকুঞ্জনিবাসে,
এসো মোর সার্থকসাধন।
লুটে লও ভরিয়া অঞ্চল
জীবনের সকল সম্বল,
নীরবে নিতান্ত অবনত
বসন্তের সর্ব-সমর্পণ—
হাসি মুখে নিয়ে যাও যত
বনের বেদননিবেদন।
শুক্তিরক্ত নখরে বিক্ষত
ছিন্ন করি ফেলো বৃন্তগুলি।
সুখাবেশে বসি লতামূলে
সারাবেলা অলস অঙ্গুলে
বৃথা কাজে যেন অন্যমনে
খেলাচ্ছলে লহো তুলি তুলি—
তব ওষ্ঠে দশনদংশনে
টুটে যাক পূর্ণ ফলগুলি।
আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে
গুঞ্জরিছে ভ্রমর চঞ্চল।
সারাদিন অশান্ত বাতাস
ফেলিতেছে মর্মরনিশ্বাস,
বনের বুকের আন্দোলনে
কাঁপিতেছে পল্লব-অঞ্চল—
আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে
পুঞ্জ পুঞ্জ ধরিয়াছে ফল।
ঋতুসংহার
হে কবীন্দ্র কালিদাস, কল্পকুঞ্জবনে
নিভৃতে বসিয়া আছ প্রেয়সীর সনে
যৌবনের যৌবরাজ্যসিংহাসন-’পরে।
মরকতপাদপীঠ-বহনের তরে
রয়েছে সমস্ত ধরা, সমস্ত গগন
স্বর্ণরাজছত্র ঊর্ধ্বে করেছে ধারণ
শুধু তোমাদের-’পরে; ছয় সেবাদাসী
ছয় ঋতু ফিরে ফিরে নৃত্য করে আসি;
নব নব পাত্র ভরি ঢালি দেয় তারা
নব নব বর্ণময়ী মদিরার ধারা
তোমাদের তৃষিত যৌবনে; ত্রিভুবন
একখানি অন্তঃপুর, বাসরভবন।
নাই দুঃখ, নাই দৈন্য, নাই জনপ্রাণী—
তুমি শুধু আছ রাজা, আছে তব রানী।
ঐশ্বর্য
ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মান্ডের মাঝে
সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে।
পূরবের নবসূর্য, নিশীথের শশী,
তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি।
আমার এ গান এও জগতের গানে
মিশে যায় নিখিলের মর্মমাঝখানে;
শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর
সকলের মাঝে তার আপনার ঘর।
কিন্তু, হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার
ক্ষুদ্র রুদ্ধদ্বারে শুধু একাকী তোমার।
নাহি পড়ে সূর্যালোক, নাহি চাহে চাঁদ,
নাহি তাহে নিখিলের নিত্য আশীর্বাদ।
সম্মুখে দাঁড়ালে মৃত্যু মুহূর্তেই হায়
পাংশুপান্ডু শীর্ণম্লান মিথ্যা হয়ে যায়।
করুণা
অপরাহ্নে ধূলিচ্ছন্ন নগরীর পথে
বিষম লোকের ভিড়; কর্মশালা হতে
ফিরে চলিয়াছে ঘরে পরিশ্রান্ত জন
বাঁধমুক্ত তটিনীর স্রোতের মতন।
ঊর্ধ্বশ্বাসে রথ-অশ্ব চলিয়াছে ধেয়ে
ক্ষুধা আর সারথির কশাঘাত খেয়ে।
হেনকালে দোকানির খেলামুগ্ধ ছেলে
কাটা ঘুড়ি ধরিবারে চলে বাহু মেলে।
অকস্মাৎ শকটের তলে গেল পড়ি,
পাষাণকঠিন পথ উঠিল শিহরি।
সহসা উঠিল শূন্যে বিলাপ কাহার,
স্বর্গে যেন দয়াদেবী করে হাহাকার।
ঊর্ধ্বপানে চেয়ে দেখি স্খলিতবসনা
লুটায়ে লুটায়ে ভূমে কাঁদে বারাঙ্গনা।
কর্ম
ভৃত্যের না পাই দেখা প্রাতে ।
দুয়ার রয়েছে খোলা , স্নানজল নাই তোলা ,
মূর্খাধম আসে নাই রাতে ।
মোর ধৌত বস্ত্রখানি কোথা আছে নাহি জানি ,
কোথা আহারের আয়োজন !
বাজিয়া যেতেছে ঘড়ি বসে আছি রাগ করি —
দেখা পেলে করিব শাসন ।
বেলা হলে অবশেষে প্রণাম করিল এসে ,
দাঁড়াইল করি করজোড় ।
আমি তারে রোষভরে কহিলাম , “ দূর হ রে ,
দেখিতে চাহি নে মুখ তোর । ”
শুনিয়া মূঢ়ের মতো ক্ষণকাল বাক্যহত
মুখে মোর রহিল সে চেয়ে —
কহিল গদ্গদস্বরে , “ কালি রাত্রি দ্বিপ্রহরে
মারা গেছে মোর ছোটো মেয়ে । ”
এত কহি ত্বরা করি গামোছাটি কাঁধে ধরি
নিত্যকাজে গেল সে একাকী ।
প্রতি দিবসের মতো ঘষা মাজা মোছা কত ,
কোনো কর্ম রহিল না বাকি ।
কাব্য
তবু কি ছিল না তব সুখদুঃখ যত,
আশা নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব আমাদেরি মতো,
হে অমর কবি! ছিল না কি অনুক্ষণ
রাজসভা-ষড়্চক্র, আঘাত গোপন?
কখনো কি সহ নাই অপমানভার,
অনাদর, অবিশ্বাস, অন্যায় বিচার,
অভাব কঠোর ক্রূর—নিদ্রাহীন রাতি
কখনো কি কাটে নাই বক্ষে শেল গাঁথি?
তবু সে সবার ঊর্ধ্বে নির্লিপ্ত নির্মল
ফুটিয়াছে কাব্য তব সৌন্দর্যকমল
আনন্দের সূর্য-পানে; তার কোনো ঠাঁই
দুঃখদৈন্যদুর্দিনের কোনো চিহ্ন নাই।
জীবনমন্থনবিষ নিজে করি পান
অমৃত যা উঠেছিল করে গেছ দান।
কালিদাসের প্রতি
আজ তুমি কবি শুধু, নহ আর কেহ—
কোথা তব রাজসভা, কোথা তব গেহ,
কোথা সেই উজ্জয়িনী—কোথা গেল আজ
প্রভু তব, কালিদাস, রাজ-অধিরাজ।
কোনো চিহ্ন নাহি কারো। আজ মনে হয়
ছিলে তুমি চিরদিন চিরানন্দময়
অলকার অধিবাসী। সন্ধ্যাভ্রশিখরে
ধ্যান ভাঙি উমাপতি ভূমানন্দভরে
নৃত্য করিতেন যবে, জলদ সজল
গর্জিত মৃদঙ্গরবে, তড়িৎ চপল
ছন্দে ছন্দে দিত তাল, তুমি সেই ক্ষণে
গাহিতে বন্দনাগান—গীতিসমাপনে
কর্ণ হতে বর্হ খুলি স্নেহহাস্যভরে
পরায়ে দিতেন গৌরী তব চূড়া-’পরে।
কুমারসম্ভবগান
যখন শুনালে, কবি, দেবদম্পতিরে
কুমারসম্ভবগান, চারি দিকে ঘিরে
দাঁড়ালো প্রমথগণ—শিখরের ‘পর
নামিল মন্থর শান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর
স্থগিত-বিদ্যুৎ-লীলা, গর্জনবিরত,
কুমারের শিখী করি পুচ্ছ অবনত
স্থির হয়ে দাঁড়াইল পার্বতীর পাশে
বাঁকায়ে উন্নত গ্রীবা। কভু স্মিতহাসে
কাঁপিল দেবীর ওষ্ঠ, কভু দীর্ঘশ্বাস
অলক্ষে বহিল, কভু অশ্রুজলোচ্ছ্বাস
দেখা দিল আঁখিপ্রান্তে—যবে অবশেষে
ব্যাকুল শরমখানি নয়ননিমেষে
নামিল নীরবে, কবি, চাহি দেবীপানে
সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে।