- বইয়ের নামঃ চৈতালি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অজ্ঞাত বিশ্ব
জন্মেছি তোমার মাঝে ক্ষণিকের তরে
অসীম প্রকৃতি! সরল বিশ্বাসভরে
তবু তোরে গৃহ ব’লে মাতা ব’লে মানি।
আজ সন্ধ্যাবেলা তোর নখদন্ত হানি
প্রচন্ড পিশাচরূপে ছুটিয়া গর্জিয়া,
আপনার মাতৃবেশ শূন্যে বিসর্জিয়া
কুটি কুটি ছিন্ন করি বৈশাখের ঝড়ে
ধেয়ে এলি ভয়ংকরী ধূলিপক্ষ-’পরে,
তৃণসম করিবারে প্রাণ উৎপাটন।
সভয়ে শুধাই আজি, হে মহাভীষণ,
অনন্ত আকাশপথ রুধি চারি ধারে
কে তুমি সহস্রবাহু ঘিরেছ আমারে?
আমার ক্ষণিক প্রাণ কে এনেছে যাচি?
কোথা মোরে যেতে হবে, কেন আমি আছি?
অনন্ত পথে
বাতায়নে বসি ওরে হেরি প্রতিদিন
ছোটো মেয়ে খেলাহীন, চপলতাহীন,
গম্ভীর কর্তব্যরত, তৎপরচরণে
আসে যায় নিত্যকাজে; অশ্রুভরা মনে
ওর মুখপানে চেয়ে হাসি স্নেহভরে।
আজি আমি তরী খুলি যাব দেশান্তরে;
বালিকাও যাবে কবে কর্ম-অবসানে
আপন স্বদেশে; ও আমারে নাহি জানে,
আমিও জানি নে ওরে—দেখিবারে চাহি
কোথা ওর হবে শেষ জীবসূত্র বাহি।
কোন্ অজানিত গ্রামে কোন্ দূরদেশে
কার ঘরে বধূ হবে, মাতা হবে শেষে,
তার পরে সব শেষ—তারো পরে, হায়,
এই মেয়েটির পথ চলেছে কোথায়!
অনাবৃষ্টি
শুনেছিনু পুরাকালে মানবীর প্রেমে
দেবতারা স্বর্গ হতে আসিতেন নেমে।
সেকাল গিয়েছে। আজি এই বৃষ্টিহীন
শুষ্কনদী দগ্ধক্ষেত্র বৈশাখের দিন
কাতরে কৃষককন্যা অনুনয়বাণী
কহিতেছে বারম্বার—আয় বৃষ্টি হানি।
ব্যাকুল প্রত্যাশাভরে গগনের পানে
চাহিতেছে থেকে থেকে করুণ নয়ানে।
তবু বৃষ্টি নাহি নামে; বাতাস বধির
উড়ায়ে সকল মেঘ ছুটেছে অধীর,
আকাশের সর্বরস রৌদ্ররসনায়
লেহন করিল সূর্য। কলিযুগে, হায়,
দেবতারা বৃদ্ধ আজি। নারীর মিনতি
এখন কেবল খাটে মানবের প্রতি।
অভিমান
কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ।
যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি,
কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি ‘পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে—
তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্,
সাপ্তাহিকে দিগ্বিদিকে বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।
অভয়
আজি বর্ষশেষ-দিনে, গুরুমহাশয়,
কারে দেখাইছ বসে অন্তিমের ভয়?
অনন্ত আশ্বাস আজি জাগিছে আকাশে,
অনন্ত জীবনধারা বহিছে বাতাসে,
জগৎ উঠেছে হেসে জাগরণসুখে,
ভয় শুধু লেগে আছে তব শুষ্ক মুখে।
দেবতা রাক্ষস নহে মেলি মৃত্যুগ্রাস—
প্রবঞ্চনা করি তুমি দেখাইছ ত্রাস।
বরঞ্চ ঈশ্বরে ভুলি স্বল্প তাহে ক্ষতি—
ভয়, ঘোর অবিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি।
তিনি নিজে মৃত্যুকথা ভুলায়ে ভুলায়ে
রেখেছেন আমাদের সংসারকুলায়ে।
তুমি কে কর্কশ কণ্ঠ তুলিছ ভয়ের?
আনন্দই উপাসনা আনন্দময়ের।
অসময়
বৃথা চেষ্টা রাখি দাও। স্তব্ধ নীরবতা
আপনি গড়িবে তুলি আপনার কথা।
আজি সে রয়েছে ধ্যানে—এ হৃদয় মম
তপোভঙ্গভয়ভীত তপোবনসম।
এমন সময়ে হেথা বৃথা তুমি প্রিয়া
বসন্তকুসুমমালা এসেছ পরিয়া,
এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি—
নিভৃত নিকুঞ্জে আজি নাই কোনো গীতি।
শুধু এ মর্মরহীন বনপথ-’পরি
তোমারি মঞ্জীর দুটি উঠিছে গুঞ্জরি।
প্রিয়তমে, এ কাননে এলে অসময়ে,
কালিকার গান আজি আছে মৌন হয়ে।
তোমারে হেরিয়া তারা হতেছে ব্যাকুল,
অকালে ফুটিতে চাহে সকল মুকুল।
আশার সীমা
সকল আকাশ , সকল বাতাস ,
সকল শ্যামল ধরা ,
সকল কান্তি , সকল শান্তি
সন্ধ্যাগগন – ভরা ,
যত – কিছু সুখ যত সুধামুখ ,
যত মধুমাখা হাসি ,
যত নব নব বিলাসবিভব ,
প্রমোদমদিরারাশি ,
সকল পৃথ্বী , সকল কীর্তি ,
সকল অর্ঘ্যভার ,
বিশ্বমথন সকল যতন ,
সকল রতনহার ,
সব পাই যদি তবু নিরবধি
আরো পেতে চায় মন —
যদি তারে পাই তবে শুধু চাই
একখানি গৃহকোণ ।
আশিষ-গ্রহণ
চলিয়াছি রণক্ষেত্রে সংগ্রামের পথে।
সংসারবিপ্লবধ্বনি আসে দূর হতে।
বিদায় নেবার আগে, পারি যতক্ষণ
পরিপূর্ণ করি লই মোর প্রাণমন
নিত্য-উচ্চারিত তব কলকণ্ঠস্বরে
উদার মঙ্গলমন্ত্রে—হৃদয়ের ‘পরে
লই তব শুভস্পর্শ, কল্যাণসঞ্চয়।
এই আশীর্বাদ করো, জয়পরাজয়
ধরি যেন নম্রচিত্তে করি শির নত
দেবতার আশীর্বাদী কুসুমের মতো।
বিশ্বস্ত স্নেহের মূর্তি দুঃস্বপ্নের প্রায়
সহসা বিরূপ হয়—তবু যেন তায়
আমার হৃদয়সুধা না পায় বিকার,
আমি যেন আমি থাকি নিত্য আপনার।
ইছামতী নদী
অয়ি তন্বী ইছামতী, তব তীরে তীরে
শান্তি চিরকাল থাক কুটিরে কুটিরে—
শস্যে পূর্ণ হোক ক্ষেত্র তব তটদেশে।
বর্ষে বর্ষে বরষায় আনন্দিত বেশে
ঘনঘোরঘটা-সাথে বজ্রবাদ্যরবে
পূর্ববায়ুকল্লোলিত তরঙ্গ-উৎসবে
তুলিয়া আনন্দধ্বনি দক্ষিণে ও বামে
আশ্রিত পালিত তব দুই-তট-গ্রামে
সমারোহে চলে এসো শৈলগৃহ হতে
সৌভাগ্যে শোভায় গর্বে উল্লসিত স্রোতে।
যখন রব না আমি, রবে না এ গান,
তখনো ধরার বক্ষে সঞ্চরিয়া প্রাণ,
তোমার আনন্দগাথা এ বঙ্গে, পার্বতী,
বর্ষে বর্ষে বাজিবেক অয়ি ইছামতী!