চৌদিকে উঠিতেছিল মধুর রাগিণী
জলে স্থলে নভস্তলে ; সুন্দর কাহিনী
কে যেন রচিতেছিল ছায়ারৌদ্রকরে
অরণ্যের সুপ্তি আর পাতার মর্মরে ,
বসন্তদিনের কত স্পন্দনে কম্পনে
নিশ্বাসে উচ্ছ্বাসে ভাষে আভাসে গুঞ্জনে
চমকে ঝলকে । যেন আকাশবীণার
রবিরশ্মিতন্ত্রীগুলি সুরবালিকার
চম্পক-অঙ্গুলি-ঘাতে সংগীতঝংকারে
কাঁদিয়া উঠিতেছিল — মৌন স্তব্ধতারে
বেদনায় পীড়িয়া মূর্ছিয়া । তরুতলে
স্খলিয়া পড়িতেছিল নিঃশব্দে বিরলে
বিবশ বকুলগুলি ; কোকিল কেবলি
অশ্রান্ত গাহিতেছিল — বিফল কাকলি
কাঁদিয়া ফিরিতেছিল বনান্তর ঘুরে
উদাসিনী প্রতিধ্বনি ছায়ায় অদূরে
সরোবরপ্রান্তদেশে ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী
কলনৃত্যে বাজাইয়া মাণিক্যকিংকিণী
কল্লোলে মিশিতেছিল ; তৃণাঞ্চিত তীরে
জলকলকলস্বরে মধ্যাহ্নসমীরে
সারস ঘুমায়ে ছিল দীর্ঘ গ্রীবাখানি
ভঙ্গিভরে বাঁকাইয়া পৃষ্ঠে লয়ে টানি
ধূসর ডানার মাঝে ; রাজহংসদল
আকাশে বলাকা বাঁধি সত্বর-চঞ্চল
ত্যজি কোন্ দূরনদীসৈকতবিহার
উড়িয়া চলিতেছিল গলিতনীহার
কৈলাসের পানে । বহু বনগন্ধ বহে
অকস্মাৎ শ্রান্ত বায়ু উত্তপ্ত আগ্রহে
লুটায়ে পড়িতেছিল সুদীর্ঘ নিশ্বাসে
মুগ্ধ সরসীর বক্ষে স্নিগ্ধ বাহুপাশে ।
মদন , বসন্তসখা , ব্যগ্র কৌতূহলে
লুকায়ে বসিয়া ছিল বকুলের তলে
পুষ্পাসনে , হেলায় হেলিয়ে তরু- ‘ পরে
প্রসারিয়া পদযুগ নবতৃণস্তরে ।
পীত উত্তরীয়প্রান্ত লুণ্ঠিত ভূতলে ,
গ্রন্থিত মালতীমালা কুঞ্চিত কুন্তলে
গৌর কণ্ঠতটে — সহাস্য কটাক্ষ করি
কৌতুকে হেরিতেছিল মোহিনী সুন্দরী
তরুণীর স্নানলীলা । অধীর চঞ্চল
উৎসুক অঙ্গুলি তার , নির্মল কোমল
বক্ষস্থল লক্ষ্য করি লয়ে পুষ্পশর
প্রতীক্ষা করিতেছিল নিজ অবসর ।
গুঞ্জরি ফিরিতেছিল লক্ষ মধুকর
ফুলে ফুলে , ছায়াতলে সুপ্ত হরিণীরে
ক্ষণে ক্ষণে লেহন করিতেছিল ধীরে
বিমুগ্ধনয়ন মৃগ — বসন্ত-পরশে
পূর্ণ ছিল বনচ্ছায়া আলসে লালসে ।
জলপ্রান্তে ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ন কম্পন রাখিয়া ,
সজল চরণচিহ্ন আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে , তীরে উঠিলা রূপসী —
স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি ।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে , তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্নরৌদ্র — ললাটে অধরে
ঊরু- ‘ পরে কটিতটে স্তনাগ্রচূড়ায়
বাহুযুগে সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে । ঘিরি তার চারি পাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাঁই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্বাঙ্গে চুম্বিল তার , সেবকের মতো
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে — ছায়াখানি রক্তপদতলে
চ্যুত বসনের মতো রহিল পড়িয়া ।
অরণ্য রহিল স্তব্ধ , বিস্ময়ে মরিয়া ।
ত্যজিয়া বকুলমূল মৃদুমন্দ হাসি
উঠিল অনঙ্গদেব ।
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়ালো সহসা । মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল-তরে । পরক্ষণে ভূমি- ‘ পরে
জানু পাতি বসি , নির্বাক্ বিস্ময়ভরে ,
নতশিরে , পুষ্পধনু পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপচার
তূণ শূন্য করি । নিরস্ত্র মদনপানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানে ।
ব্যাঘাত
কোলে ছিল সুরে-বাঁধা বীণা
মনে ছিল বিচিত্র রাগিণী ,
মাঝখানে ছিঁড়ে যাবে তার
সে কথা ভাবি নি ।
ওগো আজি প্রদীপ নিবাও ,
বন্ধ করো দ্বার —
সভা ভেঙে ফিরে চলে যাও
হৃদয় আমার ।
তোমরা যা আশা করেছিলে
নারিনু পুরাতে —
কে জানিত ছিঁড়ে যাবে তার
গীত না ফুরাতে ।
ভেবেছিনু ঢেলে দিব মন ,
প্লাবন করিব দশদিশি —
পুষ্পগন্ধে আনন্দে মিশিয়া
পূর্ণ হবে পূর্ণিমার নিশি ।
ভেবেছিনু ঘিরিয়া বসিবে
তোমরা সকলে ,
গীতশেষে হেসে ভালোবেসে
মালা দিবে গলে ,
শেষ করে যাব সব কথা
সকল কাহিনী —
মাঝখানে ছিঁড়ে যাবে তার
সে কথা ভাবি নি ।
আজি হতে সবে দয়া করে
ভুলে যাও , ঘরে যাও চলে —
করিয়ো না মোরে অপরাধী
মাঝখানে থামিলাম ব ‘ লে ।
আমি চাহি আজি রজনীতে
নীরব নির্জন
ভূমিতলে ঘুমায়ে পড়িতে
স্তব্ধ অচেতন —
খ্যাতিহীন শান্তি চাহি আমি
স্নিগ্ধ অন্ধকার ।
সাঙ্গ না হইতে সব গান
ছিন্ন হল তার ।
মরীচিকা
কেন আসিতেছ মুগ্ধ মোর পানে ধেয়ে
ওগো দিক্ভ্রান্ত পান্থ , তৃষার্ত নয়ানে
লুব্ধ বেগে । আমি যে তৃষিত তোমা চেয়ে!
আমি চিরদিন থাকি এ মরুশয়ানে
সঙ্গীহারা । এ তো নহে পিপাসার জল ,
এ তো নহে নিকুঞ্জের ছায়া , পক্ব ফল
মধুরসে ভরা , এ তো নহে উৎসধারে
সিঞ্চিত সরস স্নিগ্ধ নবীন শাদ্বল
নয়ননন্দন শ্যাম । পল্লবমাঝারে
কোথায় বিহঙ্গ কোথা মধুকরদল ।
শুধু জেনো , একখানি বহ্নিসম-শিখা
তপ্ত বাসনার তুলি আমার সম্বল —
অনন্ত পিপাসাপটে এ কেবল লিখা
চিরতৃষার্তের স্বপ্নমায়ামরীচিকা ।
মৃত্যুর পরে
আজিকে হয়েছে শান্তি ,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে ।
রাত্রিদিন ধুক্ধুক্
তরঙ্গিত দুঃখসুখ
থামিয়াছে বুকে ।
যত কিছু ভালোমন্দ
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
হয়ে যাক ছাই ।
গুঞ্জরি করুক তান
ধীরে ধীরে করো গান
বসিয়া শিয়রে ।
যদি কোথা থাকে লেশ
জীবনস্বপ্নের শেষ
তাও যাক মরে ।
তুলিয়া অঞ্চলখানি
মুখ- ‘ পরে দাও টানি ,
ঢেকে দাও দেহ ।
করুণ মরণ যথা
ঢাকিয়াছে সব ব্যথা
সকল সন্দেহ ।