প্রস্তরমূর্তি
হে নির্বাক্ অচঞ্চল পাষাণসুন্দরী ,
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি কত বর্ষ ধরি
অনম্বরা অনাসক্তা চির-একাকিনী
আপন সৌন্দর্যধ্যানে দিবসযামিনী
তপস্যামগনা । সংসারের কোলাহল
তোমারে আঘাত করে নিয়ত নিষ্ফল —
জন্মমৃত্যু দুঃখসুখ অস্ত-অভ্যুদয়
তরঙ্গিত চারি দিকে চরাচরময় ,
তুমি উদাসিনী । মহাকাল পদতলে
মুগ্ধনেত্রে ঊর্ধ্বমুখে রাত্রিদিন বলে
‘ কথা কও , কথা কও , কথা কও প্রিয়ে!
কথা কও , মৌন বধূ , রয়েছি চাহিয়ে । ‘
তুমি চির বাক্যহীনা , তব মহাবাণী
পাষাণে আবদ্ধ ওগো সুন্দরী পাষাণী ।
প্রেমের অভিষেক
তুমি মোরে করেছ সম্রাট । তুমি মোরে
পরায়েছ গৌরবমুকুট । পুষ্পডোরে
সাজায়েছ কণ্ঠ মোর ; তব রাজটিকা
দীপিছে ললাটমাঝে মহিমার শিখা
অহর্নিশি । আমার সকল দৈন্য-লাজ
আমার ক্ষুদ্রতা যত ঢাকিয়াছ আজ
তব রাজ-আস্তরণে । হৃদিশয্যাতল
শুভ্র দুগ্ধফেননিভ কোমল শীতল
তারি মাঝে বসায়েছ , সমস্ত জগৎ
বাহিরে দাঁড়ায়ে আছে , নাহি পায় পথ
সে অন্তর-অন্তঃপুরে । নিভৃত সভায়
আমারে চৌদিকে ঘিরি সদা গান গায়
বিশ্বের কবিরা মিলি ; অমরবীণায়
উঠিয়াছে কী ঝংকার । নিত্য শুনা যায়
দূর-দূরান্তর হতে দেশবিদেশের
ভাষা , যুগ-যুগান্তের কথা , দিবসের
নিশীথের গান , মিলনের বিরহের
গাথা , তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহীন আগ্রহের
উৎকণ্ঠিত তান ।
প্রেমের অমরাবতী —
প্রদোষ-আলোকে যেথা দময়ন্তী সতী
বিচরে নলের সনে দীর্ঘনিশ্বসিত
অরণ্যের বিষাদমর্মরে ; বিকশিত
পুষ্পবীথিতলে শকুন্তলা আছে বসি ,
করপদ্মতললীন ম্লান মুখশশী ,
ধ্যানরতা ; পুরূরবা ফিরে অহরহ
বনে বনে , গীতস্বরে দুঃসহ বিরহ
বিস্তারিয়া বিশ্বমাঝে ; মহারণ্যে যেথা
বীণা হস্তে লয়ে তপস্বিনী মহাশ্বেতা
মহেশমন্দিরতলে বসি একাকিনী
অন্তরবেদনা দিয়ে গড়িছে রাগিণী
সান্ত্বনাসিঞ্চিত ; গিরিতটে শিলাতলে
কানে কানে প্রেমবার্তা কহিবার ছলে
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপোল
চুম্বিছে ফাল্গুনি ; ভিখারি শিবের কোল
সদা আগলিয়া আছে প্রিয়া পার্বতীরে
অনন্তব্যগ্রতাপাশে ; সুখদুঃখনীরে
বহে অশ্রুমন্দাকিনী , মিনতির স্বরে
কুসুমিত বনানীরে ম্লানমুখী করে
করুণায় ; বাঁশরির ব্যথাপূর্ণ তান
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করিছে সন্ধান
হৃদয়সাথিরে ; হাত ধরে মোরে তুমি
লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দনভূমি
অমৃত-আলয়ে । সেথা আমি জ্যোতিষ্মান
অক্ষয়যৌবনময় দেবতাসমান ,
সেথা মোর লাবণ্যের নাহি পরিসীমা ,
সেথা মোরে অর্পিয়াছে আপন মহিমা
নিখিল প্রণয়ী ; সেথা মোর সভাসদ
রবিচন্দ্রতারা , পরি নব পরিচ্ছদ
শুনায় আমারে তারা নব নব গান
নব অর্থভরা — চিরসুহৃদ্মান
সর্বচরাচর ।
হেথা আমি কেহ নহি ,
সহস্রের মাঝে একজন — সদা বহি
সংসারের ক্ষুদ্র ভার , কত অনুগ্রহ
কত অবহেলা সহিতেছি অহরহ ।
সেই শতসহস্রের পরিচয়হীন
প্রবাহ হইতে , এই তুচ্ছ কর্মাধীন
মোরে তুমি লয়েছ তুলিয়া , নাহি জানি
কী কারণে । অয়ি মহীয়সী মহারানী ,
তুমি মোরে করিয়াছ মহীয়ান । আজি
এই-যে আমারে ঠেলি চলে জনরাজি
না তাকায়ে মোর মুখে , তাহারা কি জানে —
নিশিদিন তোমার সোহাগ-সুধাপানে
অঙ্গ মোর হয়েছে অমর । তাহারা কি
পায় দেখিবারে — নিত্য মোরে আছে ঢাকি
মন তব অভিনব লাবণ্যরসনে ।
তব স্পর্শ , তব প্রেম রেখেছি যতনে ,
তব সুধাকণ্ঠবাণী , তোমার চুম্বন ,
তোমার আঁখির দৃষ্টি , সর্ব দেহমন
পূর্ণ করি — রেখেছে যেমন সুধাকর
দেবতার গুপ্ত সুধা যুগযুগান্তর
আপনারে সুধাপাত্র করি , বিধাতার
পুণ্য অগ্নি জ্বালায়ে রেখেছে অনিবার
সবিতা যেমন সযতনে , কমলার
চরণকিরণে যথা পরিয়াছে হার
সুনির্মল গগনের অনন্ত ললাট ।
হে মহিমাময়ী , মোরে করেছ সম্রাট ।
প্রৌঢ়
যৌবননদীর স্রোতে তীব্র বেগভরে
একদিন ছুটেছিনু ; বসন্তপবন
উঠেছিল উচ্ছ্বসিয়া ; তীরউপবন
ছেয়েছিল ফুল্ল ফুলে ; তরুশাখা — ‘ পরে
গেয়েছিল পিককুল — আমি ভালো করে
দেখি নাই শুনি নাই কিছু — অনুক্ষণ
দুলেছিনু আলোড়িত তরঙ্গশিখরে
মত্ত সন্তরণে । আজি দিবা-অবসানে
সমাপ্ত করিয়া খেলা উঠিয়াছি তীরে ,
বসিয়াছি আপনার নিভৃত কুটিরে ;
বিচিত্র কল্লোলগীত পশিতেছে কানে ,
কত গন্ধ আসিতেছে সায়াহ্নসমীরে —
বিস্মিত নয়ন মেলি হেরি শূন্যপানে
গগনে অনন্তলোক জাগে ধীরে ধীরে ।
বিজয়িনী
অচ্ছোদসরসীনীরে রমণী যেদিন
নামিল স্নানের তরে , বসন্ত নবীন
সেদিন ফিরিতেছিল ভুবন ব্যাপিয়া
প্রথম প্রেমের মতো কাঁপিয়া কাঁপিয়া
ক্ষণে ক্ষণে শিহরি শিহরি । সমীরণ
প্রলাপ বকিতেছিল প্রচ্ছায়সঘন
পল্লবশয়নতলে , মধ্যাহ্নের জ্যোতি
মূর্ছিত বনের কোলে , কপোতদম্পতি
বসি শান্ত অকম্পিত চম্পকের ডালে
ঘন চঞ্চুচুম্বনের অবসরকালে
নিভৃতে করিতেছিল বিহ্বল কূজন ।
তীরে শ্বেতশিলাতলে সুনীল বসন
লুটাইছে এক প্রান্তে স্খলিতগৌরব
অনাদৃত — শ্রীঅঙ্গের উত্তপ্ত সৌরভ
এখনো জড়িত তাহে — আয়ুপরিশেষ
মূর্ছাম্বিত দেহে যেন জীবনের লেশ —
লুটায় মেখলাখানি ত্যজি কটিদেশ
মৌন অপমানে । নূপুর রয়েছে পড়ি ,
বক্ষের নিচোলবাস যায় গড়াগড়ি
ত্যজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে ।
কনকদর্পণখানি চাহে শূন্য-পানে
কার মুখ স্মরি । স্বর্ণপাত্রে সুসজ্জিত
চন্দনকুঙ্কুমপঙ্ক , লুণ্ঠিত লজ্জিত
দুটি রক্ত শতদল , অম্লানসুন্দর
শ্বেতকরবীর মালা — ধৌত শুক্লাম্বর
লঘু স্বচ্ছ , পূর্ণিমার আকাশের মতো ।
পরিপূর্ণ নীল নীর স্থির অনাহত —
কূলে কূলে প্রসারিত বিহ্বল গভীর
বুক-ভরা আলিঙ্গনরাশি । সরসীর
প্রান্তদেশে , বকুলের ঘনচ্ছায়াতলে
শ্বেতশিলাপটে , আবক্ষ ডুবায়ে জলে
বসিয়া সুন্দরী , কম্পমান ছায়াখানি
প্রসারিয়া স্বচ্ছ নীরে — বক্ষে লয়ে টানি
সযত্নপালিত শুভ্র রাজহংসীটিরে
করিছে সোহাগ — নগ্ন বাহুপাশে ঘিরে
সুকোমল ডানা দুটি , লম্বা গ্রীবা তার
রাখি স্কন্ধ- ‘ পরে , কহিতেছে বারম্বার
স্নেহের প্রলাপবাণী — কোমল কপোল
বুলাইছে হংসপৃষ্ঠে পরশবিভোল ।