নববর্ষে
নিশি অবসানপ্রায় , ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত!
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত ।
বন্ধু হও , শত্রু হও , যেখানে যে কেহ রও ,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত ।
আজি বাঁধিতেছি বসি সংকল্প নূতন
অন্তরে আমার ,
সংসারে ফিরিয়া গিয়া হয়তো কখন
ভুলিব আবার ।
তখন কঠিন ঘাতে এনো অশ্রু আঁখিপাতে
অধমের করিয়ো বিচার ।
আজি নব-বরষ-প্রভাতে
ভিক্ষা চাহি মার্জনা সবার ।
আজ চলে গেলে কাল কী হবে না-হবে
নাহি জানে কেহ ,
আজিকার প্রীতিসুখ রবে কি না-রবে
আজিকার স্নেহ ।
যতটুকু আলো আছে কাল নিবে যায় পাছে ,
অন্ধকারে ঢেকে যায় গেহ —
আজ এসো নববর্ষদিনে
যতটুকু আছে তাই দেহ ।
বিস্তীর্ণ এ বিশ্বভূমি সীমা তার নাই ,
কত দেশ আছে!
কোথা হতে কয় জনা হেথা এক ঠাঁই
কেন মিলিয়াছে ?
করো সুখী , থাকো সুখে প্রীতিভরে হাসিমুখে
পুষ্পগুচ্ছ যেন এক গাছে —
তা যদি না পার চিরদিন ,
একদিন এসো তবু কাছে ।
সময় ফুরায়ে গেলে কখন আবার
কে যাবে কোথায় ,
অনন্তের মাঝখানে পরস্পরে আর
দেখা নাহি যায় ।
বড়ো সুখ বড়ো ব্যথা চিহ্ন না রাখিবে কোথা ,
মিলাইবে জলবিম্ব প্রায় —
একদিন প্রিয়মুখ যত
ভালো করে দেখে লই আয়!
আপন সুখের লাগি সংসারের মাঝে
তুলি হাহাকার!
আত্ম-অভিমানে অন্ধ জীবনের কাজে
আনি অবিচার!
আজি করি প্রাণপণ করিলাম সমর্পণ
এ জীবনে যা আছে আমার ।
তোমরা যা দিবে তাই লব ,
তার বেশি চাহিব না আর ।
লইব আপন করি নিত্যধৈর্যতরে
দুঃখভার যত ,
চলিব কঠিন পথে অটল অন্তরে
সাধি মহাব্রত ।
যদি ভেঙে যায় পণ , দুর্বল এ শ্রান্ত মন
সবিনয়ে করি শির নত
তুলি লব আপনার ‘ পরে
আপনার অপরাধ যত!
যদি ব্যর্থ হয় প্রাণ , যদি দুঃখ ঘটে —
ক ‘ দিনের কথা!
একদা মুছিয়া যাবে সংসারের পটে
শূন্য নিষ্ফলতা ।
জগতে কি তুমি একা ? চতুর্দিকে যায় দেখা
সুদুর্ভর কত দুঃখব্যথা ।
তুমি শুধু ক্ষুদ্র একজন ,
এ সংসারে অনন্ত জনতা ।
যতক্ষণ আছ হেথা স্থিরদীপ্তি থাকো ,
তারার মতন ।
সুখ যদি নাহি পাও , শান্তি মনে রাখো
করিয়া যতন ।
যুদ্ধ করি নিরবধি বাঁচিতে না পার যদি ,
পরাভব করে আক্রমণ ,
কেমনে মরিতে হয় তবে
শেখো তাই করি প্রাণপণ ।
জীবনের এই পথ , কে বলিতে পারে
বাকি আছে কত ?
মাঝে কত বিঘ্নশোক , কত ক্ষুরধারে
হৃদয়ের ক্ষত ?
পুনর্বার কালি হতে চলিব সে তপ্ত পথে ,
ক্ষমা করো আজিকার মতো —
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত ।
ওই যায় , চলে যায় কালপরপারে
মোর পুরাতন ।
এই বেলা , ওরে মন , বল্ অশ্রুধারে
কৃতজ্ঞ বচন ।
বল্ তারে — দুঃখসুখ দিয়েছ ভরিয়া বুক ,
চিরকাল রহিবে স্মরণ ,
যাহা-কিছু লয়ে গেলে সাথে
তোমারে করিনু সমর্পণ ।
ওই এল এ জীবনে নূতন প্রভাতে
নূতন বরষ —
মনে করি প্রীতিভরে বাঁধি হাতে হাতে ,
না পাই সাহস ।
নব অতিথিরে তবু ফিরাইতে নাই কভু —
এসো এসো নূতন দিবস!
ভরিলাম পুণ্য অশ্রুজলে
আজিকার মঙ্গলকলস ।
নারীর দান
একদা প্রাতে কুঞ্জতলে
অন্ধ বালিকা
পত্রপুটে আনিয়া দিল
পুষ্পমালিকা ।
কণ্ঠে পরি অশ্রুজল
ভরিল নয়নে ;
বক্ষে লয়ে চুমিনু তার
স্নিগ্ধ বয়নে ।
কহিনু তারে ‘ অন্ধকারে
দাঁড়ায়ে রমণী
কী ধন তুমি করিছ দান
না জান আপনি ।
পুষ্পসম অন্ধ তুমি
অন্ধ বালিকা ,
দেখ নি নিজে মোহন কী যে
তোমার মালিকা । ‘
নীরব তন্ত্রী
তোমার বীণায় সব তার বাজে ,
ওহে বীণকার ,
তারি মাঝে কেন নীরব কেবল
একখানি তার । ‘
ভবনদীতীরে হৃদিমন্দিরে
দেবতা বিরাজে ,
পূজা সমাপিয়া এসেছি ফিরিয়া
আপনার কাজে ।
বিদায়ের ক্ষণে শুধাল পূজারি ,
‘ দেবীরে কী দিলে ?
তব জনমের শ্রেষ্ঠ কী ধন
ছিল এ নিখিলে ?’
কহিলাম আমি , সঁপিয়া এসেছি
পূজা-উপহার
আমার বীণায় ছিল যে একটি
সুবর্ণ-তার ,
যে তারে আমার হৃদয়বনের
যত মধুকর
ক্ষণেকে ক্ষণেকে ধ্বনিয়া তুলিত
গুঞ্জনস্বর ,
যে তারে আমার কোকিল গাহিত
বসন্তগান
সেইখানি আমি দেবতাচরণে
করিয়াছি দান ।
তাই এ বীণায় বাজে না কেবল
একখানি তার —
আছে তাহা শুধু মৌন মহৎ
পূজা-উপহার ।
পূর্ণিমা
পড়িতেছিলাম গ্রন্থ বসিয়া একেলা
সঙ্গীহীন প্রবাসের শূন্য সন্ধ্যাবেলা
করিবারে পরিপূর্ণ । পণ্ডিতের লেখা
সমালোচনার তত্ত্ব ; পড়ে হয় শেখা
সৌন্দর্য কাহারে বলে — আছে কী কী বীজ
কবিত্বকলায় ; শেলি , গেটে , কোল্রীজ
কার কোন্ শ্রেণী । পড়ি পড়ি বহুক্ষণ
তাপিয়া উঠিল শির , শ্রান্ত হল মন ,
মনে হল সব মিথ্যা , কবিত্ব কল্পনা
সৌন্দর্য সুরুচি রস সকলি জল্পনা
লিপিবণিকের — অন্ধ গ্রন্থকীটগণ
বহু বর্ষ ধরি শুধু করিছে রচন
শব্দমরীচিকাজাল , আকাশের ‘ পরে
অকর্ম আলস্যাবেশে দুলিবার তরে
দীর্ঘ রাত্রিদিন ।
অবশেষে শ্রান্তি মানি
তন্দ্রাতুর চোখে , বন্ধ করি গ্রন্থখানি
ঘড়িতে দেখিনু চাহি দ্বিপ্রহর রাতি ,
চমকি আসন ছাড়ি নিবাইনু বাতি ।
যেমন নিবিল আলো , উচ্ছ্বসিত স্রোতে
মুক্ত দ্বারে , বাতায়নে , চতুর্দিক হতে
চকিতে পড়িল কক্ষে বক্ষে চক্ষে আসি
ত্রিভুবনবিপ্লাবিনী মৌন সুধাহাসি ।
হে সুন্দরী , হে প্রেয়সী , হে পূর্ণপূর্ণিমা ,
অনন্তের অন্তরশায়িনী , নাহি সীমা
তব রহস্যের । এ কী মিষ্ট পরিহাসে
সংশয়ীর শুষ্ক চিত্ত সৌন্দর্য-উচ্ছ্বাসে
মুহূর্তে ডুবালে । কখন দুয়ারে এসে
মুখানি বাড়ায়ে , অভিসারিকার বেশে
আছিলে দাঁড়ায়ে , এক প্রান্তে , সুররানী ,
সুদূর নক্ষত্র হতে সাথে করে আনি
বিশ্বভরা নীরবতা । আমি গৃহকোণে
তর্কজালবিজড়িত ঘন বাক্যবনে
শুষ্কপত্রপরিকীর্ণ অক্ষরের পথে
একাকী ভ্রমিতেছিনু শূন্য মনোরথে
তোমারি সন্ধানে । উদ্ভ্রান্ত এ ভকতেরে
এতক্ষণ ঘুরাইলে ছলনার ফেরে ।
কী জানি কেমন করে লুকায়ে দাঁড়ালে
একটি ক্ষণিক ক্ষুদ্র দীপের আড়ালে
হে বিশ্বব্যাপিনী লক্ষ্মী । মুগ্ধ কর্ণপুটে
গ্রন্থ হইতে গুটিকত বৃথা বাক্য উঠে
আচ্ছন্ন করিয়াছিল , কেমনে না জানি ,
লোকলোকান্তরপূর্ণ তব মৌনবাণী ।