তোমাদের বাসরকুঞ্জের বহির্দ্বারে
বসে আছি — কানে আসিতেছে বারে বারে
মৃদুমন্দ কথা , বাজিতেছে সুমধুর
রিনিঝিনি রুনুঝুনু সোনার নূপুর —
কার কেশপাশ হতে খসি পুষ্পদল
পড়িছে আমার বক্ষে , করিছে চঞ্চল
চেতনাপ্রবাহ । কোথায় গাহিছ গান ।
তোমরা কাহারা মিলি করিতেছ পান
কিরণকনকপাত্রে সুগন্ধি অমৃত ,
মাথায় জড়ায়ে মালা পূর্ণবিকশিত
পারিজাত — গন্ধ তারি আসিছে ভাসিয়া
মন্দ সমীরণে — উন্মাদ করিছে হিয়া
অপূর্ব বিরহে । খোলো দ্বার , খোলো দ্বার ।
তোমাদের মাঝে মোরে লহো একবার
সৌন্দর্যসভায় । নন্দনবনের মাঝে
নির্জন মন্দিরখানি — সেথায় বিরাজে
একটি কুসুমশয্যা , রত্নদীপালোকে
একাকিনী বসি আছে নিদ্রাহীন চোখে
বিশ্বসোহাগিনী লক্ষ্মী , জ্যোতির্ময়ী বালা —
আমি কবি তারি তরে আনিয়াছি মালা ।
দিনশেষে
দিনশেষ হয়ে এল , আঁধারিল ধরণী ,
আর বেয়ে কাজ নাই তরণী ।
‘ হ্যাঁগো এ কাদের দেশে
বিদেশী নামিনু এসে ‘
তাহারে শুধানু হেসে যেমনি —
অমনি কথা না বলি
ভরা ঘট ছলছলি
নতমুখে গেল চলি তরুণী ।
এ ঘাটে বাঁধিব মোর তরণী ।
নামিছে নীরব ছায়া ঘনবনশয়নে ,
এ দেশ লেগেছে ভালো নয়নে ।
স্থির জলে নাহি সাড়া ,
পাতাগুলি গতিহারা ,
পাখি যত ঘুমে সারা কাননে —
শুধু এ সোনার সাঁঝে
বিজনে পথের মাঝে
কলস কাঁদিয়া বাজে কাঁকনে ।
এ দেশ লেগেছে ভালো নয়নে ।
ঝলিছে মেঘের আলো কনকের ত্রিশূলে ,
দেউটি জ্বলিছে দূরে দেউলে ।
শ্বেত পাথরেতে গড়া
পথখানি ছায়া-করা
ছেয়ে গেছে ঝরে-পড়া বকুলে ।
সারি সারি নিকেতন ,
বেড়া-দেওয়া উপবন ,
দেখে পথিকের মন আকুলে ।
দেউটি জ্বলিছে দূরে দেউলে ।
রাজার প্রাসাদ হতে অতিদূর বাতাসে
ভাসিছে পূরবীগীতি আকাশে ।
ধরণী সমুখপানে
চলে গেছে কোন্খানে ,
পরান কেন কে জানে উদাসে ।
ভালো নাহি লাগে আর
আসা-যাওয়া বারবার
বহুদূর দুরাশার প্রবাসে ।
পূরবী রাগিণী বাজে আকাশে ।
কাননে প্রাসাদচূড়ে নেমে আসে রজনী ,
আর বেয়ে কাজ নাই তরণী ।
যদি কোথা খুঁজে পাই
মাথা রাখিবার ঠাঁই
বেচাকেনা ফেলে যাই এখনি —
যেখানে পথের বাঁকে
গেল চলি নত আঁখে
ভরা ঘট লয়ে কাঁখে তরুণী ।
এই ঘাটে বাঁধো মোর তরণী ।
দুঃসময়
বিলম্বে এসেছ , রুদ্ধ এবে দ্বার ,
জনশূন্য পথ , রাত্রি অন্ধকার ,
গৃহহারা বায়ু করি হাহাকার
ফিরিয়া মরে ।
তোমারে আজিকে ভুলিয়াছে সবে ,
শুধাইলে কেহ কথা নাহি কবে ,
এহেন নিশীথে আসিয়াছ তবে
কী মনে করে ।
এ দুয়ারে মিছে হানিতেছ কর ,
ঝটিকার মাঝে ডুবে যায় স্বর ,
ক্ষীণ আশাখানি ত্রাসে থরথর্
কাঁপিছে বুকে ।
যেথা একদিন ছিল তোর গেহ
ভিখারির মতো আসে সেথা কেহ ?
কার লাগি জাগে উপবাসী স্নেহ
ব্যাকুল মুখে ।
ঘুমায়েছে যারা তাহারা ঘুমাক ,
দুয়ারে দাঁড়ায়ে কেন দাও ডাক ,
তোমারে হেরিলে হইবে অবাক
সহসা রাতে ।
যাহারা জাগিছে নবীন উৎসবে
রুদ্ধ করি দ্বার মত্ত কলরবে ,
কী তোমার যোগ আজি এই ভবে
তাদের সাথে ।
দ্বারছিদ্র দিয়ে কী দেখিছ আলো ,
বাহির হইতে ফিরে যাওয়া ভালো ,
তিমির ক্রমশ হতেছে ঘোরালো
নিবিড় মেঘে ।
বিলম্বে এসেছ — রুদ্ধ এবে দ্বার ,
তোমার লাগিয়া খুলিবে না আর ,
গৃহহারা ঝড় করি হাহাকার
বহিছে বেগে ।
দুরাকাঙ্ক্ষা
কেন নিবে গেল বাতি ।
আমি অধিক যতনে ঢেকেছিনু তারে
জাগিয়া বাসররাতি ,
তাই নিবে গেল বাতি ।
কেন ঝরে গেল ফুল ।
আমি বক্ষে চাপিয়া ধরেছিনু তারে
চিন্তিত ভয়াকুল ,
তাই ঝরে গেল ফুল ।
কেন মরে গেল নদী ।
আমি বাঁধ বাঁধি তারে চাহি ধরিবারে
পাইবারে নিরবধি ,
তাই মরে গেল নদী ।
কেন ছিঁড়ে গেল তার ।
আমি অধিক আবেগে প্রাণপণ বলে
দিয়েছিনু ঝংকার ,
তাই ছিঁড়ে গেল তার ।
ধূলি
অয়ি ধূলি , অয়ি তুচ্ছ , অয়ি দীনহীনা ,
সকলের নিম্নে থাক নীচতম জনে
বক্ষে বাঁধিবার তরে ; সহি সর্ব ঘৃণা
কারে নাহি কর ঘৃণা । গৈরিক বসনে
হে ব্রতচারিণী তুমি সাজি উদাসীনা
বিশ্বজনে পালিতেছ আপন ভবনে ।
নিজেরে গোপন করি , অয়ি বিমলিনা ,
সৌন্দর্য বিকশি তোল বিশ্বের নয়নে ।
বিস্তারিছ কোমলতা হে শুষ্ক কঠিনা —
হে দরিদ্রা , পূর্ণা তুমি রত্নে ধান্যে ধনে ।
হে আত্মবিস্মৃতা , বিশ্বচরণবিলীনা ,
বিস্মৃতেরে ঢেকে রাখ অঞ্চল-বসনে ।
নূতনেরে নির্বিচারে কোলে লহ তুলি ,
পুরাতনে বক্ষে ধর হে জননী ধূলি ।
নগরসংগীত
কোথা গেল সেই মহান শান্ত
নব নির্মল শ্যামলকান্ত
উজ্জ্বলনীলবসনপ্রান্ত
সুন্দর শুভ ধরণী ।
আকাশ আলোকপুলকপুঞ্জ ,
ছায়াসুশীতল নিভৃত কুঞ্জ ,
কোথা সে গভীর ভ্রমরগুঞ্জ ,
কোথা নিয়ে এল তরণী ।
ওই রে নগরী — জনতারণ্য ,
শত রাজপথ , গৃহ অগণ্য ,
কতই বিপণি , কতই পণ্য
কত কোলাহলকাকলি ।
কত-না অর্থ কত অনর্থ
আবিল করিছে স্বর্গমর্ত ,
তপনতপ্ত ধূলি-আবর্ত
উঠিছে শূন্য আকুলি ।
সকলি ক্ষণিক , খণ্ড , ছিন্ন —
পশ্চাতে কিছু রাখে না চিহ্ন ,
পলকে মিলিছে পলকে ভিন্ন
ছুটিছে মৃত্যু-পাথারে ।
করুণ রোদন কঠিন হাস্য ,
প্রভূত দম্ভ বিনীত দাস্য ,
ব্যাকুল প্রয়াস , নিষ্ঠুর ভাষ্য ,
চলিছে কাতারে কাতারে ।
স্থির নহে কিছু নিমেষমাত্র ,
চাহে নাকো কিছু প্রবাসযাত্র ,
বিরামবিহীন দিবসরাত্র
চলিছে আঁধারে আলোকে ।
কোন্ মায়ামৃগ কোথায় নিত্য
স্বর্ণঝলকে করিছে নৃত্য
তাহারে বাঁধিতে লোলুপচিত্ত
ছুটিছে বৃদ্ধবালকে ।
এ যেন বিপুল যজ্ঞকুণ্ড ,
আকাশে আলোড়ি শিখার শুণ্ড
হোমের অগ্নি মেলিছে তুণ্ড
ক্ষুধার দহন জ্বালিয়া ।
নরনারী সবে আনিয়া তূর্ণ
প্রাণের পাত্র করিয়া চূর্ণ
বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ
জীবন-আহুতি ঢালিয়া ।
চারি দিকে ঘিরি যতেক ভক্ত
স্বর্ণবরনমরণাসক্ত
দিতেছে অস্থি , দিতেছে রক্ত ,
সকল শক্তিসাধনা ।
জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে ,
ধূমায়ে শূন্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে
লুপ্ত করিছে সূর্যচন্দ্রে
বিশ্বব্যাপিনী দাহনা ।
বায়ুদলবল হইয়া ক্ষিপ্ত
ঘিরি ঘিরি সেই অনল দীপ্ত
কাঁদিয়া ফিরিছে অপরিতৃপ্ত ,
ফুঁসিয়া উষ্ণ শ্বসনে ।
যেন প্রসারিয়া কাতর পক্ষ
কেঁদে উড়ে আসে লক্ষ লক্ষ
পক্ষীজননী , করিয়া লক্ষ্য
খাণ্ডব-হুত-অশনে ।
বিপ্র ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র
মিলিয়া সকলে মহৎ ক্ষুদ্র
খুলেছে জীবনযজ্ঞ রুদ্র
আবালবৃদ্ধরমণী ।
হেরি এ বিপুল দহনরঙ্গ
আকুল হৃদয় যেন পতঙ্গ
ঢালিবারে চাহে আপন অঙ্গ ,
কাটিবারে চাহে ধমনী ।
হে নগরী , তব ফেনিল মদ্য
উছসি উছলি পড়িছে সদ্য ,
আমি তাহা পান করিব অদ্য ,
বিস্মৃত হব আপনা ।
অয়ি মানবের পাষাণী ধাত্রী ,
আমি হব তব মেলার যাত্রী
সুপ্তিবিহীন মত্ত রাত্রি
জাগরণে করি যাপনা ।
ঘূর্ণচক্র জনতাসংঘ ,
বন্ধনহীন মহা- আসঙ্গ ,
তারি মাঝে আমি করিব ভঙ্গ
আপন গোপন স্বপনে ।
ক্ষুদ্র শান্তি করিব তুচ্ছ ,
পড়িব নিম্নে , চড়িব উচ্চ ,
ধরিব ধূম্রকেতুর পুচ্ছ ,
বাহু বাড়াইব তপনে ।
নব নব খেলা খেলে অদৃষ্ট
কখনো ইষ্ট কভু অনিষ্ট ,
কখনো তিক্ত কখনো মিষ্ট ,
যখন যা দেয় তুলিয়া —
সুখের দুখের চক্রমধ্যে
কখনো উঠিব উধাও পদ্যে ,
কখনো লুটিব গভীর গদ্যে ,
নাগরদোলায় দুলিয়া ।
হাতে তুলি লব বিজয়বাদ্য
আমি অশান্ত , আমি অবাধ্য
যাহা-কিছু আছে অতি অসাধ্য
তাহারে ধরিব সবলে ।
আমি নির্মম আমি নৃশংস
সবেতে বসাব নিজের অংশ ,
পরমুখ হতে করিয়া ভ্রংশ
তুলিব আপন কবলে ।
মনেতে জানিব সকল পৃথ্বী
আমারি চরণ-আসনভিত্তি ,
রাজার রাজ্য দস্যুবৃত্তি
কোনো ভেদ নাহি উভয়ে ।
ধনসম্পদ করিব নস্য ,
লুণ্ঠন করি আনিব শস্য ,
অশ্বমেধের মুক্ত অশ্ব
ছুটাব বিশ্বে অভয়ে ।
নব নব ক্ষুধা , নূতন তৃষ্ণা ,
নিত্যনূতন কর্মনিষ্ঠা ,
জীবনগ্রন্থে নূতন পৃষ্ঠা
উলটিয়া যাব ত্বরিতে ।
জটিল কুটিল চলেছে পন্থ
নাহি তার আদি নাহিকো অন্ত ,
উদ্দামবেগে ধাই তুরন্ত
সিন্ধু-শৈল-সরিতে ।
শুধু সম্মুখে চলেছি লক্ষি
আমি নীড়হারা নিশার পক্ষী ,
তুমিও ছুটিছ চপলা লক্ষ্মী ,
আলেয়া-হাস্যে ধাঁধিয়া ।
পূজা দিয়া পদে করি না ভিক্ষা ,
বসিয়া করি না তব প্রতীক্ষা ,
কে কারে জিনিবে হবে পরীক্ষা —
আনিব তোমারে বাঁধিয়া ।
মানবজন্ম নহে তো নিত্য ,
ধনজনমান খ্যাতি ও বিত্ত
নহে তারা কারো অধীন ভৃত্য —
কাল-নদী ধায় অধীরা ।
তবে দাও ঢালি — কেবলমাত্র
দু-চারি দিবস , দু-চারি রাত্র ,
পূর্ণ করিয়া জীবনপাত্র
জনসংঘাতমদিরা ।