আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে ,
মধুর মিলনরাতি —
স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার ,
নির্বাণ দীপ , রুদ্ধ দুয়ার ,
শ্রাবণগগন করে হাহাকার
তিমিরশয়ন পাতি —
শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে
জ্বালায়ে রেখেছে বাতি ।
কোথায় লুকাই , কেমনে নিবাই
নিলাজ ভূষণভাতি ।
আমি আমার গোপন মরমের কথা
রেখেছি মরমতলে ।
মলয় কহিছে আপন কাহিনী ,
কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী ,
নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী
আপনার কলকলে —
শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি
গীতঝংকারছলে
যে কথা যখন করিব গোপন
সে কথা তখনি বলে ।
চিত্রা
জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী ।
অযুত আলোকে ঝলসিছ নীল গগনে ,
আকুল পুলকে উলসিছ ফুলকাননে ,
দ্যুলোকে ভূলোকে বিলসিছ চলচরণে ,
তুমি চঞ্চলগামিনী ।
মুখর নূপুর বাজিছে সুদূর আকাশে ,
অলকগন্ধ উড়িছে মন্দ বাতাসে ,
মধুর নৃত্যে নিখিল চিত্তে বিকাশে
কত মঞ্জুল রাগিণী ।
কত না বর্ণে কত না স্বর্ণে গঠিত
কত যে ছন্দে কত সংগীতে রটিত
কত না গ্রন্থে কত না কণ্ঠে পঠিত
তব অসংখ্য কাহিনী ।
জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
তুমি বিচিত্ররূপিণী ।
অন্তরমাঝে শুধু তুমি একা একাকী
তুমি অন্তরব্যাপিনী ।
একটি স্বপ্ন মুগ্ধ সজল নয়নে ,
একটি পদ্ম হৃদয়বৃন্তশয়নে ,
একটি চন্দ্র অসীম চিত্তগগনে —
চারি দিকে চিরযামিনী ।
অকূল শান্তি সেথায় বিপুল বিরতি ,
একটি ভক্ত করিছে নিত্য আরতি ,
নাহি কাল দেশ , তুমি অনিমেষ মুরতি —
তুমি অচপলদামিনী ।
ধীর গম্ভীর গভীর মৌনমহিমা ,
স্বচ্ছ অতল স্নিগ্ধ নয়ননীলিমা
স্থির হাসিখানি উষালোকসম অসীমা ,
অয়ি প্রশান্তহাসিনী ।
অন্তরমাঝে তুমি শুধু একা একাকী
তুমি অন্তরবাসিনী ।
জীবনদেবতা
ওহে অন্তরতম ,
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম ।
দুঃখসুখের লক্ষ ধারায়
পাত্র ভরিয়া দিয়েছি তোমায় ,
নিঠুর পীড়নে নিঙাড়ি বক্ষ
দলিত দ্রাক্ষাসম ।
কত যে বরন কত যে গন্ধ
কত যে রাগিণী কত যে ছন্দ
গাঁথিয়া গাঁথিয়া করেছি বয়ন
বাসরশয়ন তব —
গলায়ে গলায়ে বাসনার সোনা
প্রতিদিন আমি করেছি রচনা
তোমার ক্ষণিক খেলার লাগিয়া
মুরতি নিত্যনব ।
আপনি বরিয়া লয়েছিলে মোরে
না জানি কিসের আশে ।
লেগেছে কি ভালো , হে জীবননাথ ,
আমার রজনী আমার প্রভাত
আমার নর্ম আমার কর্ম
তোমার বিজন বাসে ।
বরষা শরতে বসন্তে শীতে
ধ্বনিয়াছে হিয়া যত সংগীতে
শুনেছ কি তাহা একেলা বসিয়া
আপন সিংহাসনে ।
মানসকুসুম তুলি অঞ্চলে
গেঁথেছ কি মালা , পরেছ কি গলে ,
আপনার মনে করেছ ভ্রমণ
মম যৌবনবনে ।
কী দেখিছ , বঁধু , মরমমাঝারে
রাখিয়া নয়ন দুটি ।
করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার
স্খলন পতন ত্রুটি ।
পূজাহীন দিন সেবাহীন রাত
কত বারবার ফিরে গেছে নাথ ,
অর্ঘ্যকুসুম ঝরে পড়ে গেছে
বিজন বিপিনে ফুটি ।
যে সুরে বাঁধিলে এ বীণার তার
নামিয়া নামিয়া গেছে বারবার —
হে কবি , তোমার রচিত রাগিণী
আমি কি গাহিতে পারি ।
তোমার কাননে সেচিবারে গিয়া
ঘুমায়ে পড়েছি ছায়ায় পড়িয়া ,
সন্ধ্যাবেলায় নয়ন ভরিয়া
এনেছি অশ্রুবারি ।
এখন কি শেষ হয়েছে , প্রাণেশ ,
যা কিছু আছিল মোর ।
যত শোভা যত গান যত প্রাণ
জাগরণ ঘুমঘোর ।
শিথিল হয়েছে বাহুবন্ধন ,
মদিরাবিহীন মম চুম্বন ,
জীবনকুঞ্জে অভিসারনিশা
আজি কি হয়েছে ভোর ?
ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা ,
আনো নব রূপ , আনো নব শোভা ,
নূতন করিয়া লহো আরবার
চিরপুরাতন মোরে ।
নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়
নবীন জীবনডোরে ।
জ্যোৎস্নারাত্রে
শান্ত করো , শান্ত করো এ ক্ষুব্ধ হৃদয়
হে নিস্তব্ধ পূর্ণিমাযামিনী । অতিশয়
উদ্ভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত
বারম্বার , তুমি এসো স্নিগ্ধ অশ্রুপাত
দগ্ধ বেদনার ‘পরে । শুভ্র সুকোমল
মোহভরা নিদ্রাভরা করপদ্মদল ,
আমার সর্বাঙ্গে মনে দাও বুলাইয়া
বিভাবরী , সর্ব ব্যথা দাও ভুলাইয়া ।
বহু দিন পরে আজি দক্ষিণ বাতাস
প্রথম বহিছে । মুগ্ধ হৃদয় দুরাশ
তোমার চরণপ্রান্তে রাখি তপ্ত শির
নিঃশব্দে ফেলিতে চাহে রুদ্ধ অশ্রুনীর
হে মৌনরজনী! পাণ্ডুর অম্বর হতে
ধীরে ধীরে এসো নামি লঘু জ্যোৎস্নাস্রোতে ,
মৃদুহাস্যে নতনেত্রে দাঁড়াও আসিয়া
নির্জন শিয়রতলে । বেড়াক ভাসিয়া
রজনীগন্ধার গন্ধ মদির লহরী
সমীরহিল্লোলে ; স্বপ্নে বাজুক বাঁশরি
চন্দ্রলোকপ্রান্ত হতে ; তোমার অঞ্চল
বায়ুভরে উড়ে এসে পুলকচঞ্চল
করুক আমার তনু ; অধীর মর্মরে
শিহরি উঠুক বন ; মাথার উপরে
চকোর ডাকিয়া যাক দূরশ্রুত তান ;
সম্মুখে পড়িয়া থাক্ তটান্তশয়ান ,
সুপ্ত নটিনীর মতো , নিস্তব্ধ তটিনী
স্বপ্নালসা ।
হেরো আজি নিদ্রিতা মেদিনী ,
ঘরে ঘরে রুদ্ধ বাতায়ন । আমি একা
আছি জেগে , তুমি একাকিনী দেহো দেখা
এই বিশ্বসুপ্তিমাঝে , অসীম সুন্দর ,
ত্রিলোকনন্দনমূর্তি । আমি যে কাতর
অনন্ত তৃষায় , আমি নিত্য নিদ্রাহীন ,
সদা উৎকণ্ঠিত , আমি চিররাত্রিদিন
আনিতেছি অর্ঘ্যভার অন্তরমন্দিরে
অজ্ঞাত দেবতা লাগি — বাসনার তীরে
একা বসে গড়িতেছি কত যে প্রতিমা
আপন হৃদয় ভেঙে , নাহি তার সীমা ।
আজি মোরে করো দয়া , এসো তুমি , অয়ি ,
অপার রহস্য তব , হে রহস্যময়ী ,
খুলে ফেলো — আজি ছিন্ন করে ফেলো ওই
চিরস্থির আচ্ছাদন অনন্ত অম্বর ।
মৌনশান্ত অসীমতা নিশ্চল সাগর ,
তারি মাঝখান হতে উঠে এসো ধীরে
তরুণী লক্ষ্মীর মতো হৃদয়ের তীরে
আঁখির সম্মুখে । সমস্ত প্রহরগুলি
ছিন্ন পুষ্পদলসম পড়ে যাক খুলি
তব চারি দিকে — বিদীর্ণ নিশীথখানি
খসে যাক নীচে । বক্ষ হতে লহো টানি
অঞ্চল তোমার , দাও অবারিত করি
শুভ্র ভাল , আঁখি হতে লহো অপসরি
উন্মুক্ত অলক । কোনো মর্ত দেখে নাই
যে দিব্য মুরতি আমারে দেখাও তাই
এ বিশ্রব্ধ রজনীতে নিস্তব্ধ বিরলে ।
উৎসুক উন্মুখ চিত্ত চরণের তলে
চকিতে পরশ করো ; একটি চুম্বন
ললাটে রাখিয়া যাও , একান্ত নির্জন
সন্ধ্যার তারার মতো ; আলিঙ্গনস্মৃতি
অঙ্গে তরঙ্গিয়া দাও , অনন্তের গীতি
বাজায়ে শিরার তন্ত্রে । ফাটুক হৃদয়
ভূমানন্দে — ব্যাপ্ত হয়ে যাক শূন্যময়
গানের তানের মতো । একরাত্রি-তরে
হে অমরী , অমর করিয়া দাও মোরে ।