উর্বশী
নহ মাতা , নহ কন্যা , নহ বধূ , সুন্দরী রূপসী ,
হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!
গোষ্ঠে যবে সন্ধ্যা নামে শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বাল সন্ধ্যাদীপখানি ,
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে
স্তব্ধ অর্ধরাতে ।
উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা
তুমি অকুণ্ঠিতা ।
বৃন্তহীন পুষ্প-সম আপনাতে আপনি বিকশি
কবে তুমি ফুটিলে উর্বশী!
আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিলে ম ন্থি ত সাগরে ,
ডান হাতে সুধাপাত্র বিষভাণ্ড লয়ে বাম করে ,
তরঙ্গিত মহাসিন্ধু মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো
পড়েছিল পদপ্রান্তে উচ্ছ্বসিত ফণা লক্ষ শত
করি অবনত ।
কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি সুরেন্দ্রবন্দিতা ,
তুমি অনিন্দিতা ।
কোনোকালে ছিলে না কি মুকুলিকা বালিকা-বয়সী
হে অনন্তযৌবনা উর্বশী!
আঁধার পাথারতলে কার ঘরে বসিয়া একেলা
মানিক মুকুতা লয়ে করেছিলে শৈশবের খেলা ,
মণিদীপদীপ্ত কক্ষে সমুদ্রের কল্লোলসংগীতে
অকলঙ্ক হাস্যমুখে প্রবাল-পালঙ্কে ঘুমাইতে
কার অঙ্কটিতে ।
যখনি জাগিলে বিশ্বে , যৌবনে গঠিতা ,
পূর্ণপ্রস্ফুটিতা ।
যুগযুগান্তর হতে তুমি শুধু বিশ্বের প্রেয়সী
হে অপূর্বশোভনা উর্বশী!
মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল ,
তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল ,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধবায়ু বহে চারি ভিতে ,
মধুমত্তভৃঙ্গসম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধচিতে
উদ্দাম সংগীতে ।
নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা
বিদ্যুৎ-চঞ্চলা ।
সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লসি
হে বিলোলহিল্লোল উর্বশী ,
ছন্দে ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল ,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল ,
তব স্তনহার হতে নভস্তলে খসি পড়ে তারা —
অকস্মাৎ পুরুষের বক্ষোমাঝে চিত্ত আত্মহারা ,
নাচে রক্তধারা ।
দিগন্তে মেখলা তব টুটে আচম্বিতে
অয়ি অসম্বৃতে ।
স্বর্গের উদয়াচলে মূর্তিমতী তুমি হে উষসী ,
হে ভুবনমোহিনী উর্বশী!
জগতের অশ্রুধারে ধৌত তব তনুর তনিমা ,
ত্রিলোকের হৃদিরক্তে আঁকা তব চরণশোণিমা ।
মুক্তবেণী বিবসনে , বিকশিত বিশ্ব-বাসনার
অরবিন্দ-মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার
অতি লঘুভার —
অখিল মানসস্বর্গে অনন্তরঙ্গিণী ,
হে স্বপ্নসঙ্গিনী ।
ওই শুন দিশে দিশে তোমা লাগি কাঁদিছে ক্রন্দসী
হে নিষ্ঠুরা বধিরা উর্বশী!
আদিযুগ পুরাতন এ জগতে ফিরিবে কি আর ,
অতল অকূল হতে সিক্তকেশে উঠিবে আবার ?
প্রথম সে তনুখানি দেখা দিবে প্রথম প্রভাতে
সর্বাঙ্গে কাঁদিবে তব নিখিলের নয়ন-আঘাতে
বারিবিন্দুপাতে —
অকস্মাৎ মহাম্বুধি অপূর্ব সংগীতে
রবে তরঙ্গিতে ।
ফিরিবে না , ফিরিবে না — অস্ত গেছে সে গৌরবশশী ,
অস্তাচলবাসিনী উর্বশী!
তাই আজি ধরাতলে বসন্তের আনন্দ-উচ্ছ্বাসে
কার চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস মিশে বহে আসে ,
পূর্ণিমানিশীথে যবে দশ দিকে পরিপূর্ণ হাসি
দূরস্মৃতি কোথা হতে বাজায় ব্যাকুল-করা বাঁশি —
ঝরে অশ্রুরাশি ।
তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে —
অয়ি অবন্ধনে ।
উৎসব
মোর অঙ্গে অঙ্গে যেন আজি বসন্ত-উদয়
কত পত্রপুষ্পময় ।
যেন মধুপের মেলা
গুঞ্জরিছে সারাবেলা ,
হেলাভরে করে খেলা
অলস মলয় ।
ছায়া আলো অশ্রু হাসি
নৃত্য গীত বীণা বাঁশি ,
যেন মোর অঙ্গে আসি
বসন্ত-উদয়
কত পত্রপুষ্পময় ।
তাই মনে হয় আমি পরম সুন্দর ,
আমি অমৃতনির্ঝর ।
সুখসিক্ত নেত্র মম
শিশিরিত পুষ্পসম ,
ওষ্ঠে হাসি নিরুপম
মাধুরীমনথর ।
মোর পুলকিত হিয়া
সর্বদেহে বিলসিয়া
বক্ষে উঠে বিকশিয়া
পরম সুন্দর ,
নব অমৃতনির্ঝর ।
ওগো , যে তুমি আমার মাঝে নূতন নবীন
সদা আছ নিশিদিন ,
তুমি কি বসেছ আজি
নব বরবেশে সাজি ,
কুন্তলে কুসুমরাজি ,
অঙ্কে লয়ে বীন ,
ভরিয়া আরতিথালা
জ্বালায়েছ দীপমালা ,
সাজায়েছ পুষ্পডালা
নূতন নবীন —
আজি বসন্তের দিন ।
ওগো তুমি কি উতলাসম বেড়াইছ ফিরে
মোর হৃদয়ের তীরে ?
তোমারি কি চারিপাশ
কাঁপে শত অভিলাষ ,
তোমারি কি পট্টবাস
উড়িছে সমীরে ?
নব গান তব মুখে
ধ্বনিছে আমার বুকে ,
উচ্ছ্বসিয়া সুখে দুখে
হৃদয়ের তীরে
তুমি বেড়াইছ ফিরে ।
আজি তুমি কি দেখিছ এই শোভা রাশি রাশি
ওগো মনোবনবাসী ।
আমার নিশ্বাসবায়
লাগিছে কি তব গায় ,
বাসনার পুষ্প পায়
পড়িছে কি আসি ।
উঠিছে কি কলতান
মর্মরগুঞ্জরগান ,
তুমি কি করিছ পান
মোর সুধারাশি
ওগো মনোবনবাসী ।
আজি এ উৎসবকলরব কেহ নাহি জানে ,
শুধু আছে তাহা প্রাণে ।
শুধু এ বক্ষের কাছে
কী জানি কাহারা নাচে ,
সর্বদেহ মাতিয়াছে
শব্দহীন গানে ।
যৌবনলাবণ্যধারা
অঙ্গে অঙ্গে পথহারা ,
এ আনন্দ তুমি ছাড়া
কেহ নাহি জানে —
তুমি আছ মোর প্রাণে ।
এবার ফিরাও মোরে
সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত ,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ন তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি । ওরে তুই ওঠ্ আজি ;
আগুন লেগেছে কোথা ? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে ? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল ? কোন্ অন্ধকারামাঝে জর্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায় ? স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
লক্ষ মুখ দিয়া ; বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার ; সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস
লুকাইছে ছদ্মবেশে । ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে — ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী ; স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি , যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার —
তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি ,
নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে , নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি ,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ , নাহি জানে অভিমান ,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া । সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে ,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে ,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে —
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে । এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা — এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা — ডাকিয়া বলিতে হবে —
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে ,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে ,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে ;
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার , তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে ;
দেবতা বিমুখ তারে , কেহ নাহি সহায় তাহার ,
মুখে করে আস্ফালন , জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে ।