দেবী , এ জীবনে আমি গাহিয়াছি বসি অনেক গান ,
পেয়েছি অনেক ফল —
সে আমি সবারে বিশ্বজনারে করেছি দান ,
ভরেছি ধরণীতল ।
যার ভালো লাগে সেই নিয়ে যাক ,
যতদিন থাকে ততদিন থাক্ ,
যশ-অপযশ কুড়ায়ে বেড়াক
ধুলার মাঝে ।
বলেছি যে কথা করেছি যে কাজ
আমার সে নয় সবার সে আজ
ফিরিছে ভ্রমিয়া সংসারমাঝ
বিবিধ সাজে ।
যা-কিছু আমার আছে অপনার শ্রেষ্ঠ ধন
দিতেছি চরণে আসি —
অকৃত কার্য , অকথিত বাণী , অগীত গান ,
বিফল বাসনারাশি ।
ওগো বিফল বাসনারাশি
হেরিয়া আজিকে ঘরে পরে সবে
হাসিছে হেলার হাসি ।
তুমি যদি , দেবী , লহ কর পাতি ,
আপনার হাতে রাখ মালা গাঁথি ,
নিত্য নবীন রবে দিনরাতি
সুবাসে ভাসি ,
সফল করিবে জীবন আমার
বিফল বাসনারাশি ।
সান্ত্বনা
কোথা হতে দুই চক্ষে ভরে নিয়ে এলে জল
হে প্রিয় আমার ।
হে ব্যথিত , হে অশান্ত , বলো আজি গাব গান
কোন্ সান্ত্বনার ।
হেথায় প্রান্তরপারে
নগরীর এক ধারে
সায়াহ্নের অন্ধকারে
জ্বালি দীপখানি
শূন্য গৃহে অন্যমনে
একাকিনী বাতায়নে
বসে আছি পুষ্পাসনে
বাসরের রানী —
কোথা বক্ষে বিঁধি কাঁটা ফিরিলে আপন নীড়ে
হে আমার পাখি ।
ওরে ক্লিষ্ট , ওরে ক্লান্ত , কোথা তোর বাজে ব্যথা ,
কোথা তোরে রাখি ।
চারি দিকে তমস্বিনী রজনী দিয়েছে টানি
মায়ামন্ত্র-ঘের —
দুয়ার রেখেছি রুধি , চেয়ে দেখো কিছু হেথা
নাহি বাহিরের ।
এ যে দুজনের দেশ ,
নিখিলের সব শেষ ,
মিলনের রসাবেশ
অনন্ত ভবন —
শুধু এই এক ঘরে
দুখানি হৃদয় ধরে ,
দুজনে সৃজন করে
নূতন ভুবন ।
একটি প্রদীপ শুধু এ আঁধারে যতটুকু
আলো করে রাখে
সেই আমাদের বিশ্ব , তাহার বাহিরে আর
চিনি না কাহাকে ।
একখানি বীণা আছে , কভু বাজে মোর বুকে
কভু তব কোরে ।
একটি রেখেছি মালা , তোমারে পরায়ে দিলে
তুমি দিবে মোরে ।
এক শয্যা রাজধানী ,
আধেক আঁচলখানি
বক্ষ হতে লয়ে টানি
পাতিব শয়ন ।
একটি চুম্বন গড়ি
দোঁহে লব ভাগ করি —
এ রাজত্বে , মরি মরি ,
এত আয়োজন ।
একটি গোলাপফুল রেখেছি বক্ষের মাঝে ,
তব ঘ্রাণশেষে
আমারে ফিরায়ে দিলে অধরে পরশি তাহা
পরি লব কেশে ।
আজ করেছিনু মনে তোমারে করিব রাজা
এই রাজ্যপাটে ,
এ অমর বরমাল্য আপনি যতনে তব
জড়াব ললাটে ।
মঙ্গলপ্রদীপ ধ ‘ রে
লইব বরণ করে ,
পুষ্পসিংহাসন- ‘ পরে
বসাব তোমায় —
তাই গাঁথিয়াছি হার ,
আনিয়াছি ফুলভার ,
দিয়েছি নূতন তার
কনকবীণায় ।
আকাশে নক্ষত্রসভা নীরবে বসিয়া আছে
শান্ত কৌতূহলে —
আজি কি এ মালাখানি সিক্ত হবে , হে রাজন্ ,
নয়নের জলে ।
রুদ্ধকণ্ঠ , গীতহারা , কহিয়ো না কোনো কথা ,
কিছু শুধাব না —
নীরবে লইব প্রাণে তোমার হৃদয় হতে
নীরব বেদনা ।
প্রদীপ নিবায়ে দিব ,
বক্ষে মাথা তুলি নিব ,
স্নিগ্ধ করে পরশিব
সজল কপোল —
বেণীমুক্ত কেশজাল
স্পর্শিবে তাপিত ভাল ,
কোমল বক্ষের তাল
মৃদুমন্দ দোল ।
নিশ্বাসবীজনে মোর কাঁপিবে কুন্তল তব ,
মুদিবে নয়ন —
অর্ধরাতে শান্তবায়ে নিদ্রিত ললাটে দিব
একটি চুম্বন ।
সিন্ধুপারে
পউষ প্রখর শীতে জর্জর , ঝিল্লিমুখর রাতি ;
নিদ্রিত পুরী , নির্জন ঘর , নির্বাণদীপ বাতি ।
অকাতর দেহে আছিনু মগন সুখনিদ্রার ঘোরে —
তপ্ত শয্যা প্রিয়ার মতন সোহাগে ঘিরেছে মোরে ।
হেনকালে হায় বাহির হইতে কে ডাকিল মোর নাম —
নিদ্রা টুটিয়া সহসা চকিতে চমকিয়া বসিলাম ।
তীক্ষ্ণ শাণিত তীরের মতন মর্মে বাজিল স্বর —
ঘর্ম বহিল ললাট বাহিয়া , রোমাঞ্চকলেবর ।
ফেলি আবরণ , ত্যজিয়া শয়ন , বিরলসন বেশে
দুরু দুরু বুকে খুলিয়া দুয়ার বাহিরে দাঁড়ানু এসে ।
দূর নদীপারে শূন্য শ্মশানে শৃগাল উঠিল ডাকি ,
মাথার উপরে কেঁদে উড়ে গেল কোন্ নিশাচর পাখি ।
দেখিনু দুয়ারে রমণীমুরতি অবগুণ্ঠনে ঢাকা —
কৃষ্ণ অশ্বে বসিয়া রয়েছে , চিত্রে যেন সে আঁকা ।
আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে রয়েছে , পুচ্ছ ভূতল চুমে ,
ধূম্রবরন , যেন দেহ তার গঠিত শ্মশানধূমে ।
নড়িল না কিছু , আমারে কেবল হেরিল আঁখির পাশে —
শিহরি শিহরি সর্ব শরীর কাঁপিয়া উঠিল ত্রাসে ।
পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর গ্লানি-মাখা ,
পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্ন শাখা ।
নীরব রমণী অঙ্গুলী তুলি দিল ইঙ্গিত করি —
মন্ত্রমুগ্ধ অচেতনসম চড়িনু অশ্ব- ‘ পরি ।
বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া — বারেক চাহিনু পিছে ,
ঘরদ্বার মোর বাষ্পসমান মনে হল সব মিছে ।
কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে ,
কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে ।
পথের দুধারে রুদ্ধদুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধসারি ,
ঘরে ঘরে হায় সুখশয্যায় ঘুমাইছে নরনারী ।
নির্জন পথ চিত্রিতবৎ , সাড়া নাই সারা দেশে —
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে ।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে —
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘন্টা বাজে ।
অফুরান পথ , অফুরান রাতি , অজানা নূতন ঠাঁই —
অপরূপ এক স্বপ্নসমান , অর্থ কিছুই নাই ।
কী যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে , ছিল নাকো আগাগোড়া —
লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া ।
চরণে তাদের শব্দ বাজে না , উড়ে নাকো ধূলিরেখা —
কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা , সকলি বাষ্পে লেখা ।
মাঝে মাঝে যেন চেনা-চেনা-মতো মনে হয় থেকে থেকে —
নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে ।
মনে হল মেঘ , মনে হল পাখি , মনে হল কিশলয় ,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয় ।
দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি ? অথবা তরুর মূল ?
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল ?
মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখে —
নীরব নিদয় বসিয়া রয়েছে , প্রাণ কেঁপে ওঠে বুকে ।
ভয়ে ভুলে যাই দেবতার নাম , মুখে কথা নাহি ফুটে ;
হুহু রবে বায়ু বাজে দুই কানে ঘোড়া চলে যায় ছুটে ।