এসো এসো , বঁধু , এসো —
আধেক আঁচরে বোসো ,
অবাক অধরে হাসো
ভুলাও সকল তত্ত্ব ।
তুমি শুধু চাহ ফিরে —
ডুবে যাক ধীরে ধীরে
সুধাসাগরের নীরে
যত মিছা যত সত্য ।
আনো গো যৌবনগীতি ,
দূরে চলে যাক নীতি ,
আনো পরানের প্রীতি ,
থাক্ প্রবীণের ভাষ্য ।
এসো হে আপনহারা
প্রভাতসন্ধ্যার তারা
বিষাদের আঁখিধারা ,
প্রমোদের মধুহাস্য ।
আনো বাসনার ব্যথা ,
অকারণ চঞ্চলতা ,
আনো কানে কানে কথা ,
চোখে চোখে লাজদৃষ্টি ।
অসম্ভব , আশাতীত ,
অনাবশ্য , অনাদৃত ,
এনে দাও অযাচিত
যত-কিছু অনাসৃষ্টি ।
হৃদয়নিকুঞ্জমাঝ
এসো আজি ঋতুরাজ ,
ভেঙে দাও সব কাজ
প্রেমের মোহনমন্ত্রে ।
হিতাহিত হোক দূর —
গাব গীত সুমধুর ,
ধরো তুমি ধরো সুর
সুধাময়ী বীণা-যন্ত্রে ।
শেষ উপহার
যাহা-কিছু ছিল সব দিনু শেষ করে
ডালাখানি ভরে —
কাল কী আনিয়া দিব যুগল চরণে
তাই ভাবি মনে ।
বসন্তে সকল ফুল নিঃশেষে ফুটায়ে নিয়ে
তরু তার পরে
এক দিনে দীনহীন , শূন্যে দেবতার পানে
চাহে রিক্তকরে ।
আজি দিন শেষ হলে যদি মোর গান
হয় অবসান ,
কাল প্রাতে এ গানের স্মৃতিসুখলেশ
রবে না কি শেষ ।
শূন্য থালে মৌনকণ্ঠে নতমুখে আসি যদি
তোমার সম্মুখে ,
তখন কি অগৌরবে চাহিবে না একবার
ভকতের মুখে ।
দিই নি কি প্রাণপূর্ণ হৃদিপদ্মখানি
পাদপদ্মে আনি ?
দিই নি কি কোনো ফুল অমর করিয়া
অশ্রুতে ভরিয়া ।
এত গান গাহিয়াছি , তার মাঝে নাহি কি গো
হেন কোনো গান
আমি চলে গেলে তবু বহিবে যে চিরদিন
অনন্ত পরান ।
সেই কথা মনে করে দিবে না কি নব
বরমাল্য তব —
ফেলিবে না আঁখি হতে একবিন্দু জল
করুণাকোমল ,
আমার বসন্তশেষে রিক্তপুষ্প দীনবেশে
নীরবে যেদিন
ছলছল-আঁখিজলে দাঁড়াইব সভাতলে
উপহারহীন ।
সন্ধ্যা
ক্ষান্ত হও , ধীরে কও কথা । ওরে মন ,
নত করো শির । দিবা হল সমাপন ,
সন্ধ্যা আসে শান্তিময়ী । তিমিরের তীরে
অসংখ্য-প্রদীপ-জ্বালা এ বিশ্বমন্দিরে
এল আরতির বেলা । ওই শুন বাজে
নিঃশব্দ গম্ভীর মন্দ্রে অনন্তের মাঝে
শঙ্খঘণ্টাধ্বনি । ধীরে নামাইয়া আনো
বিদ্রোহের উচ্চ কণ্ঠ পূরবীর ম্লান-
মন্দ স্বরে । রাখো রাখো অভিযোগ তব ,
মৌন করো বাসনার নিত্য নব নব
নিষ্ফল বিলাপ । হেরো মৌন নভস্তল ,
ছায়াচ্ছন্ন মৌন বন , মৌন জলস্থল
স্তম্ভিত বিষাদে নম্র । নির্বাক্ নীরব
দাঁড়াইয়া সন্ধ্যাসতী — নয়নপল্লব
নত হয়ে ঢাকে তার নয়নযুগল ,
অনন্ত আকাশপূর্ণ অশ্রু-ছলছল
করিয়া গোপন । বিষাদের মহাশান্তি
ক্লান্ত ভুবনের ভালে করিছে একান্তে
সান্ত্বনা-পরশ । আজি এই শুভক্ষণে ,
শান্ত মনে , সন্ধি করো অনন্তের সনে
সন্ধ্যার আলোকে । বিন্দু দুই অশ্রুজলে
দাও উপহার — অসীমের পদতলে
জীবনের স্মৃতি । অন্তরের যত কথা
শান্ত হয়ে গিয়ে , মর্মান্তিক নীরবতা
করুক বিস্তার ।
হেরো ক্ষুদ্র নদীতীরে
সুপ্তপ্রায় গ্রাম । পক্ষীরা গিয়েছে নীড়ে ,
শিশুরা খেলে না ; শূন্য মাঠ জনহীন ;
ঘরে-ফেরা শ্রান্ত গাভী গুটি দুই-তিন
কুটির-অঙ্গনে বাঁধা , ছবির মতন
স্তব্ধপ্রায় । গৃহকার্য হল সমাপন —
কে ওই গ্রামের বধূ ধরি বেড়াখানি
সম্মুখে দেখিছে চাহি , ভাবিছে কী জানি
ধূসর সন্ধ্যায় ।
অমনি নিস্তব্ধপ্রাণে
বসুন্ধরা , দিবসের কর্ম-অবসানে ,
দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া আছে চাহি
দিগন্তের পানে । ধীরে যেতেছে প্রবাহি
সম্মুখে আলোকস্রোত অনন্ত অম্বরে
নিঃশব্দ চরণে ; আকাশের দূরান্তরে
একে একে অন্ধকারে হতেছে বাহির
একেকটি দীপ্ত তারা , সুদূর পল্লীর
প্রদীপের মতো । ধীরে যেন উঠে ভেসে
ম্লানচ্ছবি ধরণীর নয়ননিমেষে
কত যুগ-যুগান্তের অতীত আভাস ,
কত জীবজীবনের জীর্ণ ইতিহাস ।
যেন মনে পড়ে সেই বাল্যনীহারিকা ;
তার পরে প্রজ্বলন্ত যৌবনের শিখা ;
তার পরে স্নিগ্ধশ্যাম অন্নপূর্ণালয়ে
জীবধাত্রী জননীর কাজ বক্ষে লয়ে
লক্ষ কোটি জীব — কত দুঃখ , কত ক্লেশ ,
কত যুদ্ধ , কত মৃত্যু , নাহি তার শেষ ।
ক্রমে ঘনতর হয়ে নামে অন্ধকার ,
গাঢ়তর নীরবতা — বিশ্বপরিবার
সুপ্ত নিশ্চেতন । নিঃসঙ্গিনী ধরণীর
বিশাল অন্তর হতে উঠে সুগম্ভীর
একটি ব্যথিত প্রশ্ন , ক্লিষ্ট ক্লান্ত সুর ,
শূন্যপানে — “ আরো কোথা ? আরো কত দূর ?”
সাধনা
দেবী , অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে
অনেক অর্ঘ্য আনি ,
আমি অভাগ্য এনেছি বহিয়া নয়নজলে
ব্যর্থ সাধনখানি ।
তুমি জান মোর মনের বাসনা ,
যত সাধ ছিল সাধ্য ছিল না ,
তবু বহিয়াছি কঠিন কামনা
দিবসনিশি ।
মনে যাহা ছিল হয়ে গেল আর ,
গড়িতে ভাঙিয়া গেল বারবার ,
ভালোয় মন্দে আলোয় আঁধার
গিয়েছে মিশি ।
তবু ওগো , দেবী , নিশিদিন করি পরানপণ ,
চরণে দিতেছি আনি
মোর জীবনের সকল শ্রেষ্ঠ সাধের ধন
ব্যর্থ সাধনখানি ।
ওগো ব্যর্থ সাধনখানি
দেখিয়া হাসিছে সার্থকফল
সকল ভক্ত প্রাণী ।
তুমি যদি , দেবী , পলকে কেবল
কর কটাক্ষ স্নেহসুকোমল ,
একটি বিন্দু ফেল আঁখিজল
করুণা মানি ,
সব হবে তবে সার্থক হবে
ব্যর্থ সাধনখানি ।
দেবী , আজি আসিয়াছে অনেক যন্ত্রী শুনাতে গান
অনেক যন্ত্র আনি ,
আমি আনিয়াছি ছিন্নতন্ত্রী নীরব ম্লান
এই দীন বীণাখানি ।
তুমি জান ওগো করি নাই হেলা ,
পথে প্রান্তরে করি নাই খেলা ,
শুধু সাধিয়াছি বসি সারাবেলা
শতেক বার ।
মনে যে গানের আছিল আভাস ,
যে তান সাধিতে করেছিনু আশ ,
সহিল না সেই কঠিন প্রয়াস —
ছিঁড়িল তার ।
স্তবহীন তাই রয়েছি দাঁড়ায়ে সারাটি ক্ষণ ,
আনিয়াছি গীতহীনা
আমার প্রাণের একটি যন্ত্র বুকের ধন
ছিন্নতন্ত্রী বীণা ।
ওগো ছিন্নতন্ত্রী বীণা
দেখিয়া তোমার গুণীজন সবে
হাসিছে করিয়া ঘৃণা ।
তুমি যদি এরে লহ কোলে তুলি ,
তোমার শ্রবণে উঠিবে আকুলি
সকল অগীত সংগীতগুলি ,
হৃদয়াসীনা ।
ছিল যা আশায় ফুটাবে ভাষায়
ছিন্নতন্ত্রী বীণা ।