কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস।
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো,
পাগল ওগো, ধরায় আস।
এই অকুল সংসারে
দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
ঘোরবিপদ-মাঝে
কোন্ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।
তুমি কাহার সন্ধানে
সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে।
এমন ব্যাকুল করে
কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।
তোমার ভাবনা কিছু নাই–
কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
তুমি মরণ ভুলে
কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।
১৭ পৌষ, ১৩১৬
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী,
আমার মুখে তোমার নাম কি সাজে।
যখন সবাই উপহাসে তখন ভাবি আমি
আমার কণ্ঠে তোমার নাম কি বাজে।
তোমা হতে অনেক দূরে থাকি
সে যেন মোর জানতে না রয় বাকি,
নামগানের এই ছদ্মবেশে দিই পরিচয় পাছে
মনে মনে মরি যে সেই লাজে।
অহংকারের মিথ্যা হতে বাঁচাও দয়া করে
রাখো আমায় যেথা আমার স্থান।
আর-সকলের দৃষ্টি হতে সরিয়ে দিয়ে মোরে
করো তোমার নত নয়ন দান।
আমার পূজা দয়া পাবার তরে,
মান যেন সে না পায় করো ঘরে,
নিত্য তোমায় ডাকি আমি ধুলার ‘পরে বসে
নিত্যনূতন অপরাধের মাঝে।
রেলপথ। ই। বি। এস। আর, ২২ আষাঢ়, ১৩১৭
গান গাওয়ালে আমায় তুমি কতই ছলে যে
গান গাওয়ালে আমায় তুমি
কতই ছলে যে,
কত সুখের খেলায়, কত
নয়নজলে হে।
ধরা দিয়ে দাও না ধরা,
এস কাছে, পালাও ত্বরা,
পরান কর ব্যথায় ভরা
পলে পলে হে।
গান গাওয়ালে এমনি করে
কতই ছলে যে।
কত তীব্র তারে, তোমার
বীণা সাজাও যে,
শত ছিদ্র করে জীবন
বাঁশি বাজাও হে।
তব সুরের লীলাতে মোর
জনম যদি হয়েছে ভোর,
চুপ করিয়ে রাখো এবার
চরণতলে হে,
গান গাওয়ালে চিরজীবন
কতই ছলে যে।
রেলপথে, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি বাহির মনে
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি
বাহির মনে
চিরদিবস মোর জীবনে।
নিয়ে গেছে গান আমারে
ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে,
গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই
এই ভুবনে।
কত শেখা সেই শেখালো,
কত গোপন পথ দেখালো,
চিনিয়ে দিল কত তারা
হৃদ্গগনে।
বিচিত্র সুখদুখের দেশে
রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে
সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল
কোন্ ভবনে।
৯ শ্রাবণ, ১৩১৭
গাবার মতো হয় নি কোনো গান
গাবার মতো হয় নি কোনো গান,
দেবার মতো হয় নি কিছু দান।
মনে যে হয় সবি রইল বাকি
তোমায় শুধু দিয়ে এলেম ফাঁকি,
কবে হবে জীবন পূর্ণ করে
এই জীবনের পূজা অবসান।
আর-সকলের সেবা করি যত
প্রাণপণে দিই অর্ঘ্য ভরি ভরি।
সত্য মিথ্যা সাজিয়ে দিই যে কত
দীন বলিয়া পাছে ধরা পড়ি।
তোমার কাছে গোপন কিছু নাই,
তোমার পূজায় সাহস এত তাই,
যা আছে তাই পায়ের কাছে আনি
অনাবৃত দরিদ্র এই প্রাণ।
৭ শ্রাবণ, ১৩১৭
গায়ে আমার পুলক লাগে
গায়ে আমার পুলক লাগে,
চোখে ঘনায় ঘোর,
হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে
রাঙা রাখীর ডোর।
আজিকে এই আকাশতলে
জলে স্থলে ফুলে ফলে
কেমন করে মনোহরণ
ছড়ালে মন মোর।
কেমন খেলা হল আমার
আজি তোমার সনে।
পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই
ভেবে না পাই মনে।
আনন্দ আজ কিসের ছলে
কাঁদিতে চায় নয়নজলে,
বিরহ আজ মধুর হয়ে
করেছে প্রাণ ভোর।
শিলাইদহ, ২৫ আশ্বিন, ১৩১৬
» চাই গো আমি তোমারে চাই
চাই গো আমি তোমারে চাই
তোমায় আমি চাই–
এই কথাটি সদাই মনে
বলতে যেন পাই।
আর যা-কিছু বাসনাতে
ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে
মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো
তোমায় আমি চাই।
রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে
আলোর প্রার্থনাই–
তেমনি গভীর মোহের মাঝে
তোমায় আমি চাই।
শান্তিরে ঝড় যখন হানে
শান্তি তবু চায় সে প্রাণে,
তেমনি তোমায় আঘাত করি
তবু তোমায় চাই।
৩ আষাঢ়, ১৩১৭
চিত্ত আমার হারাল আজ মেঘের মাঝখানে
চিত্ত আমার হারাল আজ
মেঘের মাঝখানে,
কোথায় ছুটে চলেছে সে
কোথায় কে জানে।
বিজুলি তা’র বীণার তারে
আঘাত করে বারে বারে,
বুকের মাঝে বজ্র বাজে
কী মহাতানে।
পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে
নিবিড় নীল অন্ধকারে
জড়াল রে অঙ্গ আমার,
ছড়াল প্রাণে।
পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি
হল আমার সাথের সাথি,
অট্টহাসে ধায় কোথা সে–
বারণ না মানে।
তিনধরিয়া, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
চিরজনমের বেদনা, ওহে চিরজীবনের সাধনা
ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে
ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে,
ওরে হবে তোর জয়।
অন্ধকার যায় বুঝি কেটে,
ওরে আর নেই ভয়।
ওই দেখ্ পূর্বাশার ভালে
নিবিড় বনের অন্তরালে
শুকতারা হয়েছে উদয়।
ওরে আর নেই ভয়।
এরা যে কেবল নিশাচর–
অবিশ্বাস আপনার ‘পর,
নিরাশ্বাস, আলস্য সংশয়,
এরা প্রভাতের নয়।
ছুটে আয়, আয় রে বাহিরে,
চেয়ে দেখ্, দেখ্ ঊর্ধ্বশিরে,
আকাশ হতেছে জ্যোতির্ময়।
ওরে আর নেই ভয়।
২১ আষাঢ়, ১৩১৭