যাত্রী আমি ওরে পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে
যাত্রী আমি ওরে।
পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে।
দুঃখসুখের বাঁধন সবই মিছে,
বাঁধা এ-ঘর রইবে কোথায় পিছে,
বিষয়বোঝা টানে আমায় নীচে,
ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে যাবে পড়ে।
যাত্রী আমি ওরে।
চলতে পথে গান গাহি প্রাণ ভরে।
দেহ-দুর্গে খুলবে সকল দ্বার,
ছিন্ন হবে শিকল বাসনার,
ভালোমন্দ কাটিয়ে হব পার
চলতে রব লোকে লোকান্তরে।
যাত্রী আমি ওরে।
যা-কিছু ভার যাবে সকাল সরে।
আকাশ আমায় ডাকে দূরের পানে
ভাষাবিহীন অজানিতের গানে,
সকাল-সাঁঝে পরান মম টানে
কাহার বাঁশি এমন গভীর স্বরে।
যাত্রী আমি ওরে–
বাহির হলেম না জানি কোন্ ভোরে।
তখন কোথাও গায় নি কোনো পাখি,
কী জানি রাত কতই ছিল বাকি,
নিমেষহারা শুধুই একটি আঁখি
জেগেছিল অন্ধকারের ‘পরে।
যাত্রী আমি ওরে।
কোন্ দিনান্তে পৌঁছব কোন্ ঘরে।
কোন্ তারকা দীপ জ্বালে সেইখানে,
বাতাস কাঁদে কোন্ কুসুমের ঘ্রাণে,
কে গো সেথায় স্নিগ্ধ দু-নয়ানে
অনাদিকাল চাহে আমার তরে।
গোরাই নদী, ২৬ আষাঢ়, ১৩১৭
যাবার দিন এই কথাটি
যাবার দিন এই কথাটি
বলে যেন যাই–
যা দেখেছি যা পেয়েছি
তুলনা তার নাই৷
এই জ্যোতিসমুদ্র-মাঝে
যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি
ধন্য আমি তাই–
যাবার দিনে এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই৷
বিশ্বরূপের খেলাঘরে
কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম
দুটি নয়ন মেলে৷
পরশ যাঁরে যায় না করা
সকল দেহে দিলেন ধরা।
এই খানে শেষ করেন যদি
শেষ করে দিন তাই–
যাবার বেলা এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই৷
যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে
যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে
সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে।
সোনার ঘটে সূর্য তারা
নিচ্ছে তুলে আলোর ধারা,
অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে।
সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে।
যেথায় তুমি বস দানের আসনে,
চিত্ত আমার সেথায় যাবে কেমনে।
নিত্য নূতন রসে ঢেলে
আপনাকে যে দিচ্ছ মেলে,
সেথা কি ডাক পড়বে না গো জীবনে।
সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে।
৮ আষাঢ়, ১৩১৭
যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নীচে,
সব-হারাদের মাঝে।
যখন তোমায় প্রণাম করি আমি,
প্রণাম আমার কোন্খানে যায় থামি,
তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে
সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে
সবার পিছে, সবার নীচে,
সব-হারাদের মাঝে।
অহংকার তো পায় না নাগাল যেথায় তুমি ফের,
রিক্তভূষণ দীনদরিদ্র সাজে–
সবার পিছে, সবার নীচে,
সব-হারাদের মাঝে।
ধনে মানে যেথায় আছে ভরি
সেথায় তোমার সঙ্গ আশা করি–
সঙ্গী হয়ে আছ যেথায় সঙ্গিহীনের ঘরে
সেথায় আমার হৃদয় নামে না যে
সবার পিছে, সবার নীচে,
সব-হারাদের মাঝে।
১৯ আষাঢ়, ১৩১৭
যেন শেষ গানে মোর সব রাগিণী পূরে
যেন শেষ গানে মোর সব রাগিণী পূরে–
আমার সব আনন্দ মেলে তাহার সুরে।
যে আনন্দে মাটির ধরা হাসে
অধীর হয়ে তরুলতায় ঘাসে,
যে আনন্দে দুই পাগলের মতো
জীবন-মরণ বেড়ায় ভুবন ঘুরে–
সেই আনন্দ মেলে তাহার সুরে।
যে আনন্দ আসে ঝড়ের বেশে,
ঘুমন্ত প্রাণ জাগায় অট্ট হেসে।
যে আনন্দ দাঁড়ায় আঁখিজলে
দুঃখ-ব্যথার রক্তশতদলে,
যা আছে সব ধুলায় ফেলে দিয়ে
যে আনন্দে বচন নাহি ফুরে
সেই আনন্দ মেলে তাহার সুরে।
১১ শ্রাবণ, ১৩১৭
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে
পরাও যারে মণিরতন-হার–
খেলাধুলা আনন্দ তার সকলি যায় ঘুরে,
বসন-ভুষণ হয় যে বিষম ভার।
ছেঁড়ে পাছে আঘাত লাগি,
পাছে ধুলায় হয় সে দাগি,
আপনাকে তাই সরিয়ে রাখে সবার হতে দূরে,
চলতে গেলে ভাবনা ধরে তার–
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,
পরাও যারে মণিরতন-হার।
কী হবে মা অমনতরো রাজার মতো সাজে,
কী হবে ওই মণিরতন-হারে।
দুয়ার খুলে দাও যদি তো ছুটি পথের মাঝে
রৌদ্রবায়ু-ধুলাকাদার পাড়ে।
যেথায় বিশ্বজনের মেলা
সমস্ত দিন নানান খেলা,
চারি দিকে বিরাট গাথা বাজে হাজার সুরে,
সেথায় সে যে পায় না অধিকার,
রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে,
পরাও যারে মণিরতন-হার।
বোলপুর, ২ শ্রাবণ, ১৩১৭
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা করি;
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর
ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।
সময় যেন হয় রে এবার
ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার,
সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে
অমর হয়ে রব মরি।
যে গান কানে যায় না শোনা
সে গান সেথায় নিত্য বাজে,
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব
সেই অতলের সভামাঝে।
চিরদিনের সুরটি বেঁধে
শেষ গানে তার কান্না কেঁদে,
নীরব যিনি তাঁহার পায়ে
নীরব বীণা দিব ধরি।
শান্তিনিকেতন, ১২ পৌষ, ১৩১৬
লেগেছে অমল ধবল পালে
লেগেছে অমল ধবল পালে
মন্দ মধুর হাওয়া।
দেখি নাই কভু দেখি নাই
এমন তরণী বাওয়া।
কোন্ সাগরের পার হতে আনে
কোন্ সুদূরের ধন!
ভেসে যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায়
সব চাওয়া সব পাওয়া।
পিছনে ঝরিছে ঝর ঝর জল,
গুরু গুরু দেয়া ডাকে–
মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ
ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।
ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার
হাসিকান্নার ধন।
ভেবে মরে মোর মন–
কোন্ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র,
কী মন্ত্র হবে গাওয়া।
শান্তিনিকেতন, ৩ ভাদ্র, ১৩১৫