আজ মনে হল কারে পেয়েছি— কারে যে
পেয়েছি সে কথা জানি না ।
আজ কী লাগি উঠিছে কাঁপিয়া কাঁপিয়া
সারা আকাশের আঙিনা— কিসে যে
পুরেছে শূন্য জানি না ।
এই বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে ,
আলোক আমার তনুতে— কেমনে
মিলে গেছে মোর তনুতে ।
তাই এ গগনভরা প্রভাত পশিল
আমার অণুতে অণুতে ।
আজ ত্রিভুবন – জোড়া কাহার বক্ষে
দেহ মন মোর ফুরালো— যেন রে
নিঃশেষে আজি ফুরালো ।
আজ যেখানে যা হেরি সকলেরি মাঝে
জুড়ালো জীবন জুড়ালো— আমার
আদি ও অন্ত জুড়ালো ।
মুক্তিপাশ
ওগো , নিশীথে কখন এসেছিলে তুমি
কখন যে গেছ বিহানে
তাহা কে জানে ।
আমি চরণশবদ পাই নি শুনিতে
ছিলেম কিসের ধেয়ানে
তাহা কে জানে ।
রুদ্ধ আছিল আমার এ গেহ ,
কতকাল আসে – যায় নাই কেহ ,
তাই মনে মনে ভাবিতেছিলেম
এখনো রয়েছে যামিনী—
যেমন বন্ধ আছিল সকলি
বুঝি – বা রয়েছে তেমনি ।
হে মোর গোপনবিহারী ,
ঘুমায়ে ছিলেম যখন , তুমি কি
গিয়েছিলে মোরে নেহারি ।
আজ নয়ন মেলিয়া একি হেরিলাম
বাধা নাই , কোনো বাধা নাই—
আমি বাঁধা নাই ।
ওগো যে আঁধার ছিল শয়ন ঘেরিয়া
আধা নাই , তার আধা নাই—
আমি বাঁধা নাই ।
তখনি উঠিয়া গেলেম ছুটিয়া ,
দেখিনু কে মোর আগল টুটিয়া
ঘরে ঘরে যত দুয়ার – জানালা
সকলি দিয়েছে খুলিয়া—
আকাশ – বাতাস ঘরে আসে মোর
বিজয়পতাকা তুলিয়া
হে বিজয়ী বীর অজানা ,
কখন যে তুমি জয় করে যাও
কে পায় তার ঠিকানা ।
আমি ঘরে বাঁধা ছিনু , এবার আমারে
আকাশে রাখিলে ধরিয়া
দৃঢ় করিয়া ।
সব বাঁধা খুলে দিয়ে মুক্তিবাঁধনে
বাঁধিলে আমারে হরিয়া
দৃঢ় করিয়া ।
রুদ্ধদুয়ার ঘরে কতবার
খুঁজেছিল মন পথ পালাবার ,
এবার তোমার আশাপথ চাহি
বসে রব খোলা দুয়ারে—
তোমারে ধরিতে হইবে বলিয়া
ধরিয়া রাখিব আমারে ।
হে মোর পরানবঁধু হে ,
কখন যে তুমি দিয়ে চলে যাও
পরানে পরশমধু হে ।
মেঘ
আদি অন্ত হারিয়ে ফেলে
সাদা কালো আসন মেলে
পড়ে আছে আকাশটা খোশ – খেয়ালি ,
আমরা যে সব রাশি রাশি
মেঘের পুঞ্জ ভেসে আসি ,
আমার তারি খেয়াল , তারি হেঁয়ালি ।
মোদের কিছু ঠিক – ঠিকানা নাই ,
আমরা আসি , আমরা চলে যাই ।
ওই – যে সকল জ্যোতির মালা
গ্রহতারা রবির ডালা
জুড়ে আছে নিত্যকালের পসরা ,
ওদের হিসেব পাকা খাতায়
আলোর লেখা কালো পাতায় ,
মোদের তরে আছে মাত্র খসড়া—
রঙ – বেরঙের কলম দিয়ে এঁকে
যেমন খুশি মোছে আবার লেখে ।
আমরা কভু বিনা কাজে
ডাক দিয়ে যাই মাঝে মাঝে ,
অকারণে মুচকে হাসি হামেশা ।
তাই বলে সব মিথ্যে নাকি ।
বৃষ্টি সে তো নয়কো ফাঁকি ,
বজ্রটা তো নিতান্ত নয় তামাশা ।
শুধু আমরা থাকি নে কেউ ভাই ,
হাওয়ায় আসি হাওয়ায় ভেসে যাই ।
লীলা
আমি শরৎশেষের মেঘের মতো
তোমার গগন – কোণে
সদাই ফিরি অকারণে ।
তুমি আমার চিরদিনের
দিনমণি গো—
আজো তোমার কিরণপাতে
মিশিয়ে দিয়ে আলোর সাথে
দেয় নি মোরে বাষ্প ক’রে
তোমার পরশনি ।
তোমা হতে পৃথক হয়ে
বৎসর মাস গনি।
ওগো , এমনি তোমার ইচ্ছা যদি ,
এমনি খেলা তব ,
তবে খেলাও নব নব ।
লয়ে আমার তুচ্ছ কণিক
ক্ষণিকতা গো—
সাজাও তারে বর্ণে বর্ণে ,
ডুবাও তারে তোমার স্বর্ণে ,
বায়ুর স্রোতে ভাসিয়ে তারে
খেলাও যথা – তথা ।
শূন্য আমায় নিয়ে রচ
নিত্যবিচিত্রতা ।
ওগো , আবার যবে ইচ্ছা হবে
সাঙ্গ কোরো খেলা
ঘোর নিশীথরাত্রিবেলা ।
অশ্রুধারে ঝরে যাব
অন্ধকারে গো—
প্রভাতকালে রবে কেবল
নির্মলতা শুভ্রশীতল ,
রেখাবিহীন মুক্ত আকাশ
হাসবে চারি ধারে ।
মেঘের খেলা মিশিয়ে যাবে
জ্যোতিসাগরপারে ।
» শুভক্ষণ
ওগো মা , রাজার দুলাল যাবে আজি মোর
ঘরের সমুখপথে ,
আজি এ প্রভাতে গৃহকাজ লয়ে
রহিব বলো কী মতে ।
বলে দে আমায় কী করিব সাজ ,
কী ছাঁদে কবরী বেঁধে লব আজ ,
পরিব অঙ্গে কেমন ভঙ্গে
কোন্ বরনের বাস ।
মা গো , কী হল তোমার , অবাক নয়নে
মুখপানে কেন চাস ।
আমি দাঁড়াব যেথায় বাতায়নকোণে
সে চাবে না সেথা জানি তাহা মনে—
ফেলিতে নিমেষ দেখা হবে শেষ ,
যাবে সে সুদূর পুরে ,
শুধু সঙ্গের বাঁশি কোন্ মাঠ হতে
বাজিবে ব্যাকুল সুরে ।
তবু রাজার দুলাল যাবে আজি মোর
ঘরের সমুখপথে ,
শুধু সে নিমেষ লাগি না করিয়া বেশ
রহিব বলো কী মতে ।
শেষ খেয়া
দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা-পরা ওই ছায়া
ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ।
ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া
গেয়ে গেল কাজ-ভাঙানো গান।
নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ যাবার মুখে যায় যারা
ফেরার পথে ফিরেও নাহি চায়,
তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া—
সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়।
ওরে আয়
আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিনশেষের শেষ খেয়ায়।
সাঁজের বেলা ভাঁটার স্রোতে ও পার হতে একটানা
একটি-দুটি যায় যে তরী ভেসে।
কেমন করে চিনব ওরে ওদের মাঝে কোন্খানা
আমার ঘাটে ছিল আমার দেশে।
অস্তাচলে তীরের তলে ঘন গাছের কোল ঘেঁষে
ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়,
ডাকলে আমি ক্ষণেক থামি হেথায় পাড়ি ধরবে সে
এমন নেয়ে আছে রে কোন্ নায়।
ওরে আয়
আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিনশেষের শেষ খেয়ায়।
ঘরেই যারা যাবার তারা কখন গেছে ঘরপানে,
পারে যারা যাবার গেছে পারে;
ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে
সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে।
ফুলের বার নাইকো আর,
ফসল যার ফলল না—
চোখের জল ফেলতে হাসি পায়—
দিনের আলো যার ফুরালো, সাঁজের আলো জ্বলল না,
সেই বসেছে ঘাটের কিনারায়।
ওরে আয়
আমায় নিয়ে যাবি কে রে
বেলাশেষের শেষ খেয়ায়।
—————–
আষাঢ়, ১৩১২