সীমা
সেটুকু তোর অনেক আছে
যেটুকু তোর আছে খাঁটি ,
তার চেয়ে লোভ করিস যদি
সকলি তোর হবে মাটি ।
একমনে তোর একতারাতে
একটি যে তার সেইটে বাজা ,
ফুলবনে তোর একটি কুসুম
তাই নিয়ে তোর ডালি সাজা ।
যেখানে তোর বেড়া সেথায়
আনন্দে তুই থামিস এসে ,
যে কড়ি তোর প্রভুর দেওয়া
সেই কড়ি তুই নিস রে হেসে ।
লোকের কথা নিস নে কানে ,
ফিরিস নে আর হাজার টানে ,
যেন রে তোর হৃদয় জানে
হৃদয়ে তোর আছেন রাজা—
একতারাতে একটি যে তার
আপন মনে সেইটি বাজা ।
হার
দের হারের দলে বসিয়ে দিলে ,
জানি আমরা পারব না ।
হারাও যদি হারব খেলায় ,
তোমার খেলা ছাড়ব না ।
কেউ – বা ওঠে , কেউ – বা পড়ে ,
কেউ – বা বাঁচে , কেউ – বা মরে ,
আমরা নাহয় মরার পথে
করব প্রয়াণ রসাতলে—
হারের খেলাই খেলব মোরা
বসাও যদি হারের দলে ।
আমরা বিনা পণে খেলব না গো ,
খেলব রাজার ছেলের মতো ।
ফেলব খেলায় ধনরতন
যেথায় মোদের আছে যত ।
সর্বনাশা তোমার যে ডাক—
যায় যদি যাক সকলি যাক ,
শেষ কড়িটি চুকিয়ে দিয়ে
খেলা মোদের করব সারা ।
তার পরে কোন্ বনের কোণে
হারের দলটি হব হারা ।
তবু এই হারা তো শেষ হারা নয় ,
আবার খেলা আছে পরে ।
জিতল যে সে জিতল কি না
কে বলবে তা সত্য করে ।
হেরে তোমার করব সাধন ,
ক্ষতির ক্ষুরে কাটব বাঁধন ,
শেষ দানেতে তোমার কাছে
বিকিয়ে দেব আপনারে ।
তার পরে কী করবে তুমি
সে কথা কেউ ভাবতে পারে ।
হারাধন
বিধি যেদিন ক্ষান্ত দিলেন
সৃষ্টি করার কাজে
সকল তারা উঠল ফুটে
নীল আকাশের মাঝে ।
নবীন সৃষ্টি সামনে রেখে
সুরসভার তলে
ছায়াপথে দেবতা সবাই
বসেন দলে দলে ।
গাহেন তাঁরা , ‘ কী আনন্দ !
এ কী পূর্ণ ছবি !
এ কী মন্ত্র , এ কী ছন্দ ,
গ্রহ চন্দ্র রবি ! ‘
হেনকালে সভায় কে গো
হঠাৎ বলি উঠে ,
‘ জ্যোতির মালায় একটি তারা
কোথায় গেছে টুটে ! ‘
ছিঁড়ে গেল বীণার তন্ত্রী ,
থেমে গেল গান ,
হারা তারা কোথায় গেল
পড়িল সন্ধান ।
সবাই বলে , ‘ সেই তারাতেই
স্বর্গ হতে আলো—
সেই তারাটাই সবার বড়ো ,
সবার চেয়ে ভালো । ‘
সেদিন হতে জগৎ আছে
সেই তারাটির খোঁজে—
তৃপ্তি নাহি দিনে , রাত্রে
চক্ষু নাহি বোজে ।
সবাই বলে , ‘ সকল চেয়ে
তারেই পাওয়া চাই । ‘
সবাই বলে , ‘ সে গিয়েছে
ভুবন কানা তাই ! ‘
শুধু গভীর রাত্রিবেলায়
স্তব্ধ তারার দলে—
‘ মিথ্যা খোঁজা , সবাই আছে ‘
নীরব হেসে বলে ।
০১.উৎসর্গ (খেয়া)
বিজ্ঞানাচার্য শ্রীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বসু
করকমলেষু
বন্ধু , এ যে আমার লজ্জাবতী লতা
কী পেয়েছে আকাশ হতে
কী এসেছে বায়ুর স্রোতে
পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে
সে যে প্রাণের কথা ।
যত্নভরে খুঁজে খুঁজে
তোমায় নিতে হবে বুঝে ,
ভেঙে দিতে হবে যে তার
নীরব ব্যাকুলতা ।
আমার লজ্জাবতী লতা ।
বন্ধু , সন্ধ্যা এল , স্বপনভরা
পবন এরে চুমে ।
ডালগুলি সব পাতা নিয়ে
জড়িয়ে এল ঘুমে ।
ফুলগুলি সব নীল নয়ানে
চুপিচুপি আকাশপানে
তারার দিকে চেয়ে চেয়ে
কোন্ ধেয়ানে রতা ।
আমার লজ্জাবতী লতা ।
বন্ধু , আনো তোমার তড়িৎ – পরশ ,
হরষ দিয়ে দাও ,
করুণ চক্ষু মেলে ইহার
মর্মপানে চাও ।
সারা দিনের গন্ধগীতি
সারা দিনের আলোর স্মৃতি
নিয়ে এ যে হৃদয়ভারে
ধরায় অবনতা—
আমার লজ্জাবতী লতা ।
বন্ধু , তুমি জান ক্ষুদ্র যাহা
ক্ষুদ্র তাহা নয় ,
সত্য যেথা কিছু আছে
বিশ্ব সেথা রয় ।
এই – যে মুদে আছে লাজে
পড়বে তুমি এরি মাঝে
জীবনমৃত্যু রৌদ্রছায়া
ঝটিকার বারতা ।
আমার লজ্জাবতী লতা ।
কলিকাতা
১৮ আষাঢ় , ১৩১৩