- বইয়ের নামঃ খেয়া
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ রহমান বুকস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনাবশ্যক
কাশের বনে শূন্য নদীর তীরে
আমি তারে জিজ্ঞাসিলাম ডেকে ,
‘ একলা পথে কে তুমি যাও ধীরে
আঁচল – আড়ে প্রদীপখানি ঢেকে ।
আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা ,
দেউটি তব হেথায় রাখো বালা । ‘
গোধূলিতে দুটি নয়ন কালো
ক্ষণেক – তরে আমার মুখে তুলে
সে কহিল , ‘ ভাসিয়ে দেব আলো ,
দিনের শেষে তাই এসেছি কূলে । ‘
চেয়ে দেখি দাঁড়িয়ে কাশের বনে ,
প্রদীপ ভেসে গেল অকারণে ।
ভরা সাঁঝে আঁধার হয়ে এলে
আমি ডেকে জিজ্ঞাসিলাম তারে ,
‘ তোমার ঘরে সকল আলো জ্বেলে
এ দীপখানি সঁপিতে যাও কারে ।
আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা ,
দেউটি তব হেথায় রাখো বালা । ‘
আমার মুখে দুটি নয়ন কালো
ক্ষণেক – তরে রইল চেয়ে ভুলে ।
সে কহিল , ‘ আমার এ যে আলো
আকাশপ্রদীপ শূন্যে দিব তুলে । ‘
চেয়ে দেখি শূন্য গগনকোণে
প্রদীপখানি জ্বলে অকারণে ।
অমাবস্যা আঁধার দুই – পহরে
জিজ্ঞাসিলাম তাহার কাছে গিয়ে ,
‘ ওগো , তুমি চলেছ কার তরে
প্রদীপখানি বুকের কাছে নিয়ে ।
আমার ঘরে হয় নি আলো জ্বালা ,
দেউটি তব হেথায় রাখো বালা । ‘
অন্ধকারে দুটি নয়ন কালো
ক্ষণেক মোরে দেখলে চেয়ে তবে ,
সে কহিল , ‘ এনেছি এই আলো ,
দীপালিতে সাজিয়ে দিতে হবে । ‘
চেয়ে দেখি লক্ষ দীপের সনে
দীপখানি তার জ্বলে অকারণে ।
অনাহত
দাঁড়িয়ে আছ আধেক – খোলা
বাতায়নের ধারে
নূতন বধূ বুঝি ?
আসবে কখন চুড়িওলা
তোমার গৃহদ্বারে
লয়ে তাহার পুঁজি ।
দেখছ চেয়ে গোরুর গাড়ি
উড়িয়ে চলে ধূলি
খর রোদের কালে ;
দূর নদীতে দিচ্ছে পাড়ি
বোঝাই নৌকাগুলি—
বাতাস লাগে পালে ।
আধেক – খোলা বিজন ঘরে
ঘোমটা – ছায়ায় ঢাকা
একলা বাতায়নে ,
বিশ্ব তোমার আঁখির’পরে
কেমনে পড়ে আঁকা ,
তাই ভাবি যে মনে ।
ছায়াময় সে ভুবনখানি
স্বপন দিয়ে গড়া
রূপকথাটি – ছাঁদা ,
কোন্ সে পিতামহীর বাণী—
নাইকো আগাগোড়া ,
দীর্ঘ ছড়া বাঁধা ।
আমি ভাবি হঠাৎ যদি
বৈশাখের এক দিন
বাতাস বহে বেগে—
লজ্জা ছেড়ে নাচে নদী
শূন্যে বাঁধনহীন ,
পাগল উঠে জেগে—
যদি তোমার ঢাকা ঘরে
যত আগল আছে
সকলি যায় দূরে—
ওই – যে বসন নেমে পড়ে
তোমার আঁখির কাছে
ও যদি যায় উড়ে—
তীব্র তড়িৎহাসি হেসে
বজ্রভেরীর স্বরে
তোমার ঘরে ঢুকি
জগৎ যদি এক নিমেষে
শক্তিমূর্তি ধ ‘ রে
দাঁড়ায় মুখোমুখি—
কোথায় থাকে আধেক – ঢাকা
অলস দিনের ছায়া ,
বাতায়নের ছবি ,
কোথায় থাকে স্বপন – মাখা
আপন – গড়া মায়া—
উড়িয়া যায় সবি ।
তখন তোমার ঘোমটা – খোলা
কালো চোখের কোণে
কাঁপে কিসের আলো ,
ডুবে তোমার আপন – ভোলা
প্রাণের আন্দোলনে
সকল মন্দ ভালো ।
বক্ষে তোমার আঘাত করে
উত্তাল নর্তনে
রক্ততরঙ্গিণী ।
অঙ্গে তোমার কী সুর তুলে
চঞ্চল কম্পনে
কঙ্কণকিঙ্কিণী ।
আজকে তুমি আপনাকে
আধেক আড়াল ক’রে
দাঁড়িয়ে ঘরের কোণে
দেখতেছ এই জগৎটাকে
কী যে মায়ায় ভরে ,
তাহাই ভাবি মনে ।
অর্থবিহীন খেলার মতো
তোমার পথের মাঝে
চলছে যাওয়া – আসা ,
উঠে ফুটে মিলায় কত
ক্ষুদ্র দিনের কাজে
ক্ষুদ্র কাঁদা – হাসা ।
অনুমান
পাছে দেখি তুমি আস নি , তাই
আধেক আঁখি মুদিয়ে চাই ,
ভয়ে চাই নে ফিরে ।
আমি দেখি যেন আপন – মনে
পথের শেষে দূরের বনে
আসছ তুমি ধীরে ।
যেন চিনতে পারি সেই অশান্ত
তোমার উত্তরীয়ের প্রান্ত
ওড়ে হাওয়ার’পরে ।
আমি একলা বসে মনে গণি
শুনছি তোমার পদধ্বনি
মর্মরে মর্মরে ।
ভোরে নয়ন মেলে অরুণরাগে
যখন আমার প্রাণে জাগে
অকারণের হাসি ,
যখন নবীন তৃণে লতায় গাছে
কোন্ জোয়ারের স্রোতে নাচে
সবুজ সুধারাশি—
যখন নব মেঘের সজল ছায়া
যেন রে কার মিলন – মায়া
ঘনায় বিশ্ব জুড়ে ,
যখন পুলকে নীল শৈল ঘেরি
বেজে ওঠে কাহার ভেরী ,
ধ্বজা কাহার উড়ে—
তখন মিথ্যা সত্য কেই – বা জানে ,
সন্দেহ আর কেই – বা মানে ,
ভুল যদি হয় হোক !
ওগো , জানি না কি আমার হিয়া
কে ভুলালো পরশ দিয়া ,
কে জুড়ালো চোখ ।
সে কি তখন আমি ছিলেম একা ,
কেউ কি মোরে দেয় নি দেখা ।
কেউ আসে নাই পিছে ?
তখন আড়াল হতে সহাস আঁখি
আমার মুখে চায় নি নাকি ।
এ কি এমন মিছে ।
অবারিত
ওগো , তোরা বল্ তো এরে
ঘরে বলি কোন্ মতে ।
এরে কে বেঁধেছে হাটের মাঝে
আনাগোনার পথে ।
আসতে যেতে বাঁধে তরী
আমারি এই ঘাটে ,
যে খুশি সেই আসে—আমার
এই ভাবে দিন কাটে ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
কী কাজ নিয়ে আছি , আমার
বেলা বহে যায় যে , আমার
বেলা বহে যায় রে ।
পায়ের শব্দ বাজে তাদের ,
রজনীদিন বাজে ।
ওগো , মিথ্যে তাদের ডেকে বলি ,
‘ তোদের চিনি না যে ! ‘
কাউকে চেনে পরশ আমার ,
কাউকে চেনে ঘ্রাণ ,
কাউকে চেনে বুকের রক্ত ,
কাউকে চেনে প্রাণ ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
ডেকে বলি , ‘ আমার ঘরে
যার খুশি সেই আয় রে , তোরা
যার খুশি সেই আয় রে । ‘
সকালবেলায় শঙ্খ বাজে
পুবের দেবালয়ে—
ওগো , স্নানের পরে আসে তারা
ফুলের সাজি লয়ে ।
মুখে তাদের আলো পড়ে
তরুণ আলোখানি ;
অরুণ পায়ের ধুলোটুকু
বাতাস লহে টানি ।
ফিরিয়ে দিতে পারি না যে
হায় রে—
ডেকে বলি , ‘ আমার বনে
তুলিবি ফুল আয় রে তোরা ,
তুলিবি ফুল আয় রে । ‘