Site icon BnBoi.Com

সাত সাগরের মাঝি – ফররুখ আহমদ

Farrukh Ahmad

 আউলাদ

অনেক ঝড়ের দোলা পার হ’য়ে এল সে নাবিক।
অনেক ক্ষুধিত রাত্রি, আর বহু সামুদ্রিক
চঞ্চল করেছে তারে, অন্ধকারে হারায়েছে দিক,
কালা-পানি ঘিরে ঘিরে ডাকিয়াছে মৃত্যুর দূতীরা,
ভেঙে-পড়া জাহাজের বেকে যাওয়া খোল ভ’রে তার
উঠিয়াছে ব্যর্থতার দেসিক্ত চরম নিরাশা,
সম্মুখে ডেকেহে তারে হিংস্র-নীল তিমির পাথার;
অচেনা জগতে তবু সে নাবিক খুজে পেল বাসা।
যদিও দু’চোখ তার দুঃস্বপ্নের কালো ভয়ে ভরা
যদিও বিবর্ণ ওঠে লেগে আছে মৃত্যুর আস্বাদ,
তবু জীর্ণ জাহাজের ভাঙা খোল আজ জয়ে ভরা
পশ্চাতে জাগিয়েছে শুধু সে দুঃসহ স্মৃতির নিষাদ,
বহু ঝড় পার হয়ে এনেছে সে সম্পূর্ণ পশরা,
মানুষের আউলাদ ফিরেছে বিজয়ী সিন্দবাদ।
দুর্গম সমুদ্র পারে আরেক অচেনা লোকে
দেখিয়ে সে মানুষের ঘর
জীবন্ত কবর,
যেথা বাসা বেঁধে আছে দাম্ভিকের মৃত মরু মন
পাথর জমানো প্রহসন।
সারে সারে
কাতারে কাতারে
চলে ভারবাহী দল,
গাঁইতি, শাবল নিয়ে
কলম, লাঙল নিয়ে,
শ্রান্ত পদতল
চলে যাত্রীদল,
চলে ক্ষুধাতুর শিশু শীর্ণদাঁড়া, আর
চলিতেছে অসংখ্য কাতার
পার হ’য়ে মরু, মাঠ, বন।
মানুষের আদালত ঘরে
পাথর-জমানো প্রহসন।
চলে দল বেঁধে শিশু ওষ্ঠে তুলি জীবনের
পানপাত্র সুতীব্র বিস্বাদ
মানুষের বুভুক্ষু মুমূর্ষ আউলাদ!
জড়তার–
পাথর জমানো পথ,
এ বীভৎস সভ্যতার
গড়খাই কাটা পথ
আঁধারে ঢাকিয়া আকাশের
ডাকে তাহাদেরে।।
এ কোন পরিখা?
এখানে জ্বলিছে শুধু ক্ষুধাতু দিবসের শিখা
বিষাক্ত ধোঁয়ার কুজঝটিকা
মৃত্যুর বিকট বিভীষিকা।
মজলুম মনের বোঝা, ভারাক্রান্ত বেদনা অগাধ,
আমি মাকে লাথি খেয়ে চলে আজ আদমের মৃত আউলাদ,
শয়তানের ডরে;
বীভৎস করে;
জটিল গহ্বরে।
দল বেঁধে চলিছে শিশুরা মড়কের পথে,
কুৎসিত কুটিল প্রান্তে অন্ধকার শড়কে বিপথে
যেখানে প্রত্যেক প্রান্তে আজাজিল পাতিয়াছে ফাঁদ
তারি পানে, দুর্নিবার টানে চলে আজ মানুষের
দুর্বল, বিশীর্ণ আউলাদ।
আমি দেখি পথের দু’ধারে ক্ষুধিত শিশুর শব,
আমি দেখি পাশে পাশে উপচিয়া পড়ে যায়
ধনিকের গর্বিত আসব,
আমি দেখি কৃষাণের দুয়ারে দুর্ভিক্ষ বিভীষিকা,
আমি দেখি লাঞ্জিতের ললাটে জ্বলিছে শুধু অপমান টিকা,
গর্বিতের পরিহাসে মানুষ হয়েছে দাস,
নারী হ’ল লুণ্ঠিতা গণিকা।
অনেক মঞ্জিল দূরে পড়ে আছে মানুষের ঘাঁটি,
এখানে প্রেতের বহির্বাটি
এখানে আবর্তে পথহারা
চলিতেছে যারা
তাদেরে দিয়েছে ডাক জড়তার কুর আজদাহা,
শতকের সভ্যতার এরা আজ হ’ল তাই অন্ধ, গুমরাহা।
বাড়ায়ে এন্তের দল, বাড়বে ভ্রষ্টের দল,
নর-ঘাতকের সাথে, নারী-ঘাতকের হাতে
হ’ল এরা শোণিত-চঞ্চল
হ’ল এরা জালিম, নিষাদ,
মানুষের অমানুষ মৃত আউলাদ।
পায় পায় বাধা শৃঙ্খল-বন্ধন,
থেমে যায় জীবন-স্পন্দন,
মানুষের আদালতে
পাথর-জমানো প্রহসন।
এবার
জীবের প্রতীক এই মানুষের আদালতে নয়,
শয়তানের কাদা মাখা কালো পথে নয়–
এবার আব্বার আদালতে
আমাদের ফরিয়াদ,
ক্ষুধিত লুষ্ঠিত এই মানুষের রিক্ত ফরিয়াদ।
অনেক সভ্যতা জানি মিশেছে ধূলির নীচে, অনেক সামুদ
কত ফেরাউন, কত জালিম পিশাচ নমরুদ
মিশে গেল ধূলিতলে
নতুন যাত্রীর দল দেখা দিল দুর্গম উপলে
উড়ায়ে নিশান
সাথে করে নিয়ে এল জীবনের অ-শ্রান্ত তুফান।
শুনি আজ তাদেরি দামামা।
বাতাসে ওড়ে তাহাদের বিজয়ী আমামা
শুনি শুধু তাহাদেরি স্বর
বলিষ্ঠ বক্ষের তলে সুকোমল অন্তরের স্বর…
আর যেন ক্লিষ্ট নাহি হয়
আর যেন এস্ত নাহি হয়,
পথে দেখি-পীড়নের ফাঁদ,
আর যেন এই নাহি হয়
মানুষের ভবিষ্য দিনের আউলাদ।।

আকাশ-নাবিক

আখরোট বনে,
বাদাম খুবানি বনে
কেটেছে তোমার দিন।
হে পাখী শুভ্রতনু,
সফেদ পলকে চমকে বিজুরী, চমকে বর্ণধনু,
সোনালি, রুপালি রক্তিম রংগিন।

হালকা রেখায় আকাশ ফেলেছো চিরে,
পার হয়ে গেছ কত আলোকের স্তরে,
রৌদ্রে, শিশিরে, নোনা দরিয়ার নীরে,
ফিরেছো কখনো আকাশের তীরে তীরে,
হে বিহঙ্গ! জানতে না ভয়, কখনো পাওনি ডর।

ইরান বাগের বেদানা ওড়ায়ে এনেছো পক্ষপুটে,
স্বপ্ন দেখেছে দূর আকাশের সেতারা তোমার সুরে,
সহসা প্রকাশ আনারকলির পাপড়ি উঠেছে ফুটে,
লাজ-রক্তিম আনন্দ তার সকল বন্ধ টুটে,
দূর দিগন্ত পাড়ি দিয়ে তারে জাগাও তোমার সুরে;
আখরোট বনে
বাদাম খুবানি বনে।

পাকা খরমুজা ফেটে পড়ে কত
মিঠে শরবত বুকে,
তার চেয়ে মিঠে মিছরিও মানে হার,
তোমার তুতীর কণ্ঠ শিরীণঃ নার্গিস আঁখি তার
আনারকলির পাপড়ি নিয়ে সে খুঁজে ফেরে বন্ধুকে।
দিন রাত্রির মৌসুমে তার ফুলের জোয়ারে ভরা
তোমার পাখায় শিরীণ তোমার হয়েছে স্বয়ম্বরা।
স্বপ্ন-মেধুর কেটেছে অহর্নিশ।
আকুল আবেগে আঁখি মেলে নার্গিস;
আখরোট বনে
বাদাম খুবানি বনে।

মেহেদির শাখে থোকা থোকা ফোটে ফুল,
পাতার আড়ালে জাগে দ্বাদশীর চাঁদ,
কোন্ নির্জন গোলাব শাখায় অশান্ত বুলবুল,
সুরের বন্যা, জোছনা ভাসায় জোয়ারে রাতের বাঁধ;
মধুধন রাত, স্বপ্ন চোয়ানে শান্ত মুগ্ধ রাত,
গভীর আবেগে তোমার দুচোখে শিশির-অশ্রুপাত,
ঘুমায় শ্রান্ত তৃতী
ঘুমায় শ্রান্ত নার্গিস আঁখি জাগছে কেবল যূথী;
আখরোট বনে
বাদাম খুবানি বনে।

তোমার সকাল ররেছে পূবালি আকাশে রক্ত থালি
মেহেদীর রঙে, জাফরান রঙে অপূর্ব শুভ্রতা,
ঘুম-ভাঙা চোখে কলকণ্ঠির কত কথা ব্যাকুলতা,
রসে ফেটে পড়ে আনারকলির সুসম্পূর্ণ ডালি!
শুরু হয় ফের দিগন্ত অভিযান
শুরু হয় ফের নতুন প্রভাতী গান,
নিথর বিমানে, দূর সমুদ্র পানে
আকাশ-নাবিক জাগাও জোয়ার টান।

কবে তুমি হায় পড়েছ ধূলির পরে
জানি নাই, আজ দেখছি বাতাস বয়ে যায় হাহা-স্বরে।
বৃথা খোসা-ভাঙা বাদাম পাথরে পড়ে,
রসাল খুবানি মাটিতে পড়েছে ঝরে
তুমি শুধু নাই পাখী,
পড়ে আছো কোন নোনা ঘেরা অশ্রুর বন্দরে,
বাদামের খোসা ছড়ায় ধুলির পরে
তুমি শুধু নাই পাখী।

অকালমৃত্যু ঝরোকার কাছে এসে
হে পাখী! তোমার উঠছে আর্তস্বর,
তুমি দেখ কোন ক্ষুধিত ভয়ঙ্কর
হিংস্র চোখের দৃষ্টি-তীক্ষ্ণ শর
নিরাশা ধূসর কালো পটে ভাসে মৃত্যুর বন্দর।
কোথায় একলা ফিরছে তোমার তূতী,
সাপের ফণার কাছে এসে তার নিভে যায় অনুভূতি।

পারো না উড়তে! সেতারা কি ক্ষীয়মাণ?
চাঁদের ভাটার ঝড়-তরঙ্গে যুঝে সে হয়েছে ম্লান?
আজ কি তোমার পথে ও পাথারে আজদাহা মাথা নাড়ে?
আজ কি তোমার বুকের পাঁজরে দারুণ যক্ষ্মা বাড়ে
অনেক আগেই থেমেছে তোমার পথ চলবার গান,
সূর্য হয়েছে ম্লান,
শিরীণ কণ্ঠ ভুলেছে তোমার জোছনা রাতের দূতী।
এখানে শোনো না গোধূলি শান্ত শীষ
পেয়েছো শ্রান্ত দিনশেষে শুধু কালো রাত্রির বিষ,
হালকা পালক ওড়ে না তুফানে ঝড়ে,
ক্রমাগত শুধু নুয়ে পড়ে ভেঙে পড়ে,
হায় নীড়হারা ক্ষুধা মন্বন্তরে
সকল দুয়ার রুদ্ধ কোথায় ঠাঁই তার, ঠাঁই তার
এ অচেনা বন্দরে
ফেরে না তো পাখী তার পরিচিত ঘরে
আখরোট বনে।
বাদাম, খুবানি বনে।
সে কি ভুলে গেছে ঝড়ের আঘাতে তার পরিচিত ঘর!
তুফানে সে পাখী মেনেছে কি পরাজয়?
বুক চেরা স্বর ভাসছে বাতাসে তূতীর আর্তস্বর,
আজ কী জীবনে ঘনায়েছে পরাজয়
হে বিহঙ্গ! তুমি তো জীবনে কখনো পাওনি ডর,
কখনো তো তুমি মানো নাই পরাজয়!
সাত আকাশের সফেদ মুক্তি! কালো রাত্রির ফণা
গ্রাস করল কি তুমি ছিলে যবে সুপ্ত অন্যমনা?
তবু জানি তুমি এ অপমৃত্যু ছাড়ায়ে উঠতে পারো!
তবে কেন আছো পড়ে?
হে বিহঙ্গ এই জিঞ্জিরে প্রবল আঘাত হানো,
সাত আকাশের বিয়াবানে ফের উদার মুক্তি আনো;
এখানে থেক না পড়ে।

কথা ছিল তুমি, হে পাখী। কখনো মানবে না পরাজয়,
তোমার গানের মুক্ত নিশান উড়েছে আকাশময়,
দূর আকাশের তারা দেখছে তোমার এ পরাজয়;
তোমা পতন দেখে আজ পাখী সবে মানে বিস্ময়!

হে বিহঙ্গ। এ শুধু শ্রান্তি বুঝতে পারো না তুমি,
ক্ষণ-বিস্মৃতি জাগায় সামনে বালিয়াড়ি মরুভূমি
দেখছো কেবল তৃষ্ণায় ভরা কালো রাত্রির বিষ–
সূর্যোদয়ের পথে দেখ নাই মিঠে পানি; ওয়েসিস।
ডুবে গেছে চাঁদা আঁধারে যায় না দেখা?
হে পাখী! এখনো নেভেনি তোমার তারার শুভ্র রেখা,
তোমার জোছনা হয়নি আজো ম্লান
আখরোট বনে
বাদাম,,খুবানি বনে।

আজকে আবার সেখানে ফিরতে হবে।
পার হয়ে এই যক্ষ্মাবসাদ শ্রান্ত ব্যাধিতে ঘেরা,
পার হয়ে এই বজ্র নিপাত আকাশের বুক-চেরা
দিতে হবে ফের আঁধারের বুকে চাষ,
রাতে আনারকলিতে বন্ধ্যা মভূর অবকাশ,
আনতে নতুন বীজ যেতে হবে ফারাণের অভিযানে,
ভরাতে মাটির রুক্ষতা সেই প্রবল জোয়ার টানে।

তখন তোমার
ও-মুরভি তার
স্পর্শ করি গেছে বারে বারে;
প্রখর আতশী স্রোতে ভেসে আমি চাইনি তোমারে।

আজ আমি খুঁজে মরি
পাতায় পাতায়, ঘাসে ঘাসে,
পাই না তোমাকে। শুধু বহু দূর হতে গন্ধ আসে
ভেসে যায় মাঠ, মন মুহূর্তের রক্তিম প্রশ্বাসে।
তরপর ক্ষণদীপ্ত সে প্রান্তরপারে
পাই না তোমারে।

আজ তার গন্ধ আসে, মাত্রির নিশ্বাসে তৃষাতুর হৃদয় আমার
জানি যে তোমারো, তাই আগে বহু আগে বারবার
লায়লির ইশারায় বুকে পুরে তারুণ্যের লেলিহ আগুন
সবুজ দিগন্তু তার পাড়ী দিয়ে চলে গেছে কবে মজনুন
ধূসর জগতে।
পরতে পরতে
এঁকে গেছে, রেখে গেছে তারা
ওয়েসিস বুকে নিয়ে হেসেছে সাহারা;
স্বপ্ন মরুভূর
হয়তো জ্বলন্তু তার ক্ষুব্ধ বুকে দীউয়ানা সে সুর
চলিষ্ণু জীবন-স্রোতে ভাসমান গতির প্রবাহ
মুছে নিয়ে গেছে তার আকাশের দাহ
দিয়ে গেছে প্রশান্তি নিঝুম
মরুভূর ঘুম….

তোমাকে সুন্দর করে সে আমার প্রেম
অন্তরের ঘ্রাণ,
দিন রাত্রি ঝ’রে ঝরে পড়ে
দীর্ঘ পদ্মনাল বেয়ে পাপড়ির পরে….
ভরে ওঠে মনের আকাশ দীর্ঘশ্বাস অপরাহ্ন বেলা
পাপড়ির দ্বার রুধি পদ্মের সুরভি কোথায় চলেছে একেলা,

পিছে ফেলে পরিত্যক্ত পাপড়ির বাস,
ভেসে চলে মন, দূরে ভেসে চলে সুরভি প্রশ্বাস,
জানি না কোথায়–
বসে আছি অন্ধকারে নিশীথ-প্রচ্ছায়,
পাপড়ি যায় না দেখা, আজ শ্রান্ত ধমনীর আগ্নেয় উৎসব
শুধু একা করি অনুভব
তোমায় হারানো গন্ধ সুরভি-প্রশ্বাস,
মনে অলিন্দে শুধু দেখা দেয় তন্দ্রাতুর তোমার আকাশ।

মুগ্ধ মন আকুল সৌরভে
নাহি জানি ভুলেছে সে কবে
রজনীগন্ধার স্নিগ্ধ ভীরু বাতায়ন,
রুদ্ধ ফারা ঘর ভাঙি’ আজ সে করিছে দূরে কার অন্বেষণ!
নৈশ বাতাসের তীরে
আঁধারের বুক চিরে
নেমে আসে ঘুম।

মনে হয় আকাশ কুসুম
তোমার সন্ধান।
তবু লাগে জোয়ারের টান,
সুপ্তির অতলে যেয়ে হানা দেয় জাগ্রত চেতনা,
কী সহ বেদনায় লাগে বুকে সৌরভ-মূৰ্ছনা!
বন-চামেলির স্রোতে ভেসে যাই কোথায় সুদূরে
ভারাক্রান্ত তনু ছেড়ে মন আজ ফেরে ঘুরে ঘুরে–
দক্ষিণ বাতাসে
নিজেকে হারায়ে ফেলে ছুটে চলে ব্যাকুল আশ্বাসে।
পড়ে থাকে ধূলিমুঠি, পড়ে থাকে ভ্রান্ত অহংকার–
ব্যথাতুর হয়ে ওঠে সমগ্র চেতনা, সত্তা, মনের কিনার।
ধূলিতলে মিশে যায় রজনীগন্ধার-সুঠাম, সুগোল তনুতল,
ফোটায় বিত্ৰ দল, ঝরায়ে সুরভি অনর্গল
আরণ্য হেনার ঝড়ে সৌরভ মর্মরে–
ভুলে যেয়ে আবর্তের টান,
অন্তরের ঘ্রাণ,
পাপড়ির রূপ ছিঁড়ে বেজে সে গভীর মূলে সুরভি বিতান… এখন
প্রশান্ত বাতাসে শুধু জাগিতেছে শুলেনার বন,
থেমে গেছে যত কথা, গান,
তোমার হারানো স্মৃতি নিয়ে এল এ আকাশ-ভরানো তুফান।
তোমাকে সুন্দর করে সে আমার প্রেম–
অন্তরের ঘ্রাণ–
দিন রাত্রি ঝরে ঝরে পড়ে
পাপড়ির ‘পরে,
মনের আকাশে
এশান্ত সুপ্তির মত ব্যথা ভারাক্রান্ত তার গন্ধ ভেসে আসে।।

উৎসর্গ – সাত সাগরের মাঝি

উৎসর্গ – সাত সাগরের মাঝি

বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ তামদ্দুনিক রূপকার
দার্শনিক মহাকবি, আল্লামা ইকবালের
অমর স্মৃতির উদ্দেশে–

তোমার নয়নে দীপ্তি সিকান্দার শাহার মতন।
নতুন পথের মোহে তৃপ্তিহীন তোমার অন্বেষা
(জিন্দিগীর নীল পাত্রে উসিত ঘন রক্ত নেশা
অনির্বাণ শিরাজীর) পাড়ি দেয় মরু, মাঠ, বন,
অথই দরিয়া তীর। হে বিজয়ী! তবু অনুক্ষণ।
ধ্যান করো কোন পথ, কোন রাত্রি অজানা তোমার,
এক নেশা না মিটিতে সাজ আসে দ্বিতীয় নেশার
এক সমুদ্রের শেষে জাগে অন্য সমুদ্র স্বনন?

যেথা ক্ষীয়মাণ মৃত পাহাড়ের ঘুমন্ত শিখরে
জীবনের ক্ষীণ সত্তা মূৰ্ছাতু, অসাড়, নিশ্চল;
মুহূর্তের পদধ্বনি জাগে না সে সুষুপ্ত পাথরে,
জ্বলে না রাত্রির তীর, নাহি জাগে স্বপ্ন সমুজ্জ্বল
প্রাণবন্ত মাদকতা; সে নির্জিত তমিস্রা সাগরে
দিনের দুর্জয় ঝড় আনিয়াছে হে স্বর্ণ-ঈগল।

১৫.১১.৪৪

এই সব রাত্রি

এই সব রাত্রি

এই সব রাত্রি শুধু এক মনে কথা কহিকার
নিজেদের সাথে,
পুরানো যাত্রীর দল যারা আজি ধূলির অতিথি
দাঁড়ালো পশ্চাতে।
কায়খসরুর স্বপ্ন কঙ্কালের ব্যর্থ পরিহাস
জীবাণুর তনু পুষ্টি করিয়াছে কবে তার লাশ!
শাহরিয়ার দেখে যায় কামনার নিস্ফল ব্যর্থতা,
জিঞ্জিরে আবব্ধ এক জীবনের চরম রিক্ততা।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার–
খরস্রোতা জীবনের কোল ঘেঁষে যেখানে অসাড়
অন্ধকার বালিয়াড়ি, তলদেশে যাত্রীরা নিশ্চল,
মৃত্যুর কুয়াশা মাঝে বিবর্ণ তুহিন তনুতল
আঘাতে সকল গান, সব কথা রিক্ত নিরুত্তাপ,
স’য়ে যায় কবরের, স’য়ে যায় ধূলির প্রতাপ,
এই সব রাত্রি শুধু একমনে সেই কথা শোনে,
সেতারা উড়িছে তার অন্ধকার দুরন্ত পবনে।
এই সব আঁধারের পানপাত্র, মর্মর নেকাব
ছাড়ায়ে হীরার কুচী, জ্বলিতেছে জুলেখার খাব,
লায়লির রঙিন শারাব। কেনানের ঝরোকার ধারে;
ঝরিছে রক্তিম চাঁদ আঁধারের বালিয়াড়ি পারে।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে ক’রে যায় ধ্যান,
আবার শুনিতে চায় কোহিতুর, সাফার আহ্বান
দূরচারী মুসাফির কাফেলার ঘণ্টার ধ্বনিতে
তারার আলোয় গলে মারোয়ার পাহাড়তলীতে
মৃদু-স্বপ্নে কথা ক’য়ে আবছায়া শুভ্রতা বিলোর,
এই সব ম্লান রাত্রি সূর্যালোকে হতে চায় তোর।।

ঝরোকা’য়

ঝরোকা’য়

মুসাফির জনতার মৃদুশ নিম্নমুখ নীল পেয়ালায়
মিশে গেল আকাশের ঝরোকায়।
সুরমা পাহাড়ে লুপ্ত অগ্নিবর্ণ গুলরুখ শিখা।
অন্ধ পরিক্রমা-শ্রান্ত সে তীব্র দাহিকা
স্মৃতি শুধু দুর বনান্তের।
শিরিষের
শাখা ছেড়ে আরো দূরে রজনীগন্ধার,
হেনার;
কিম্বা বাগদাদের
হাজার রাত্রির এক রাত এল নেমে!
হে প্রিয়া শাহেরজাদী। তুমি আজ কী অজ্ঞাত প্রেমে
জেগে ওঠো শঙ্কায়, লজ্জায়?
তোমার সকল প্রেম আবার লুকাতে চায়
নেকাব-প্রচ্ছায়?
বৃথা বাজে রিনিঝিনি
হীরার জেওর!
হে ছলনাময়ী অন্ধ পুরুষের, পৌরুষের কেড়ে নাও
শ্রান্ত ঘুমঘোর,
ছড়াও পরাগ রক্তাধরা
জাফরানের মধু-গন্ধ ভরা।
রাত্রি আজ গাঢ় ঘন! মন
দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে মুসাফিয় উজানী-পবন,
গন্ধ খুঁজে ফেরে।
আকাশেরে করিয়া চৌচির
তার কান্না লুটে পড়ে
উত্তর সাগর তীরে দক্ষিণের সামুদ্রিক ঝড়ে,
সন্ধান করে সে ইতস্তত
নীড় তার শ্রাবণের পাখীদের মত।
গন্ধ আসে দূরান্তর হ’তে।
হে প্রিয়! ভেসেছি আমি দীর্ঘ নওবাহারে ঘন নীল স্রোতে,
তারার ইশায়া নিয়ে চলিয়াছ এক মনে ভেসে
সুগভীর সুরের পাখাতে,
স্তব্ধ রাতে
বেতস প্রান্তর ঘিরে
তিমির সমুদ্র ছিঁড়ে
চাঁদের দুয়ারে,
যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চলে উত্তাল পাথারে,
প্রান্তরে তারার ঝড়ে
সেই সুরে ঝ’রে পড়ে
বিবর্ণ পালক,
নিমেষে রাঙায়ে যায় তোমার নিষ্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক,
তীর-তীব্র গতি নিয়ে জুটে যায় পাশ দিয়ে উষ্কার ইশারা,
মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রের নল ঝড় তুলে যায় সাড়া
উদ্দাম চঞ্চল;
তবু অচপল
গভীর সিন্ধুর
সুদুর্গম মূল হ’তে তোলো তুমি রাত্রিতরা সুর।
ডাহুকের ডাক…
সকল বেদনা যেন, সব অভিযোগ যেন
হয়ে আসে নীরব নির্বাক।
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখী।
যাও ডাকি কি
অবাধ মুক্তির মত।
ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনি না তোমার সুর, নিজেদের বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।
এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,
তুমি বও
তোমার শৃখল-মুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবনমৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর।
তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক,
পূর্ণ করি বুক
অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না।
বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা;
ক্রমে তা’ও থেমে যায়,
প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়;
গাঢ়তর হ’ল অন্ধকার।
মুখোমুখি ব’সে আছি সব বেদনায়
ছায়াচ্ছন্ন গভীর হরে।
রাত্রি ঝ’রে পড়ে
পাতায় শিশিরে…
জীবনের দীর তীরে…
মরণের তীরে তীরে…
বেদনা নির্বাক।
সে নিবিড় আচ্ছন্ন তিমিরে
বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কণ্ঠ ঘিরে দু বনে ওঠে শুধু
তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক।।

ডাহুক

রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক …

এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।

ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পলক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
অবিশ্রাম ঝরে ঝরে পড়ে
শিশির পাখার ঘুম,
গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
নিভে যায় কামনা চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
কোন ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখীর
সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে,
ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে।

তুমি কি এখনো জেগে আছো?
তুমি কি গুন্‌ছে পেতে কান?
তুমি কি শুনছো সেই নভঃগামী শব্দের উজান?
ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী।
চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী,
মন্থর হাওয়ায়।
সাথী তন্দ্রাতুর।

রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া পড়ে যায় ডাহুকের সুর।
শুধু সুর ভাসে
বেতন বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষয়ে আসে
রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্ন সাঁতোয়া আকাশে।

মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর!
তবু জানি তুমি সুর নও,
তুমি শুধু সুরযন্ত্র। তুমি শুধু বও
আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর
অপরূপ সুর …
অফুরান সুরা …
ম্লান হয়ে আসে নীল জোছনা বিধুরা
ডাহুকের ডাকে!
হে পাখী! হে সুরাপাত্র! আজো আমি
চিনিনি তোমাকে।

হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা,
বিচিত্র তুলিতে আঁকা
বর্ণ সুকুমার।
কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনায়
যার ব্যথা-তিক্ত রসে জমে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ,
ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ
সেই সুর পারি না চিনিতে।

মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী
পা ভরা সাকী।
উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি
বাতে নিভৃত একাকী।
হে অচেনা শারাবের ‘জাম’!
নেয়ার পিপাসার উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম
সূর্যের অজানা দেশে
যদি সূর্য বন্দী এখন আঁধারের ঝরোকা’কে
পূর্ব দিগন্তে জেগেছে আলোর গান :
সাত আকাশের যৌবন অম্লাল।

তবে সুর তোলো নীল জোয়ারের আলোকিত ঝর্ণাতে।

হে পাখী তোমার এ জড়তা ঘুচে যাক,
তোর শীর্ণ ক্লিন্নতা মুছে যাক
কালো রাত্রির সাথে-ক্ষীয়মাণ ঝরোকাতে।
আর আতশী গান,
আবার জাগুক দিগন্ত সন্ধান,
আরক্ত আভা তোমার তৃতীর কণ্ঠ রবে না ঢাকা,
আবার মেলবে রক্তিম আঙরাখা
নীল আকাশের তারার বনের স্বপ্নমুখর মনে
আখরোট বনে
বাদাম, খুবানি বনে।

তুফান

দুর্বার তরঙ্গ এক বয়ে গেল তীর-তীব্র বেগে,
বলে পেল : আমি আছি যে মূহূর্তে আমি গতিমান
যখনি মারাই গতি সে মুংতে আমি আর নাই।
–ইকবাল

সে তুফান থেমে গেছে, সাইমুমের সে দুর্ধষ পাখা–
সাহারার সূর্য-ঝড় লুপ্ত হিম-শর্বরী-আতলে,
অন্ধ, মূক আঁধারের অজগর বিশ্র ফণা তলে
দূরচারী বেদুইন-থর রশি আজ মেঘে ঢাকা,
আজ মরু-বালুকাতে লুপ্ত তার বিজয়ী পতাকা,
সেই গতিহারা ঝঞ্জা ধূলিলীন অস্তিত্ববিহীন
দুর্ভিক্ষ মড়কে আজ গণিতেছে তার শেষ দিন
ক্ষুধার কাফনে তার সর্বগ্রাসী মৃত্যু অংগরাখা
সে বিপুল প্রাণ-বহ্নি তবু আজো মরে নাই জানি
হে বলিষ্ঠ! যদি তুমি নেমে এস এ-পথে বারেক
এই মৃত মরুতটে যদি তুমি দাঁড়াও সন্ধানী,
মানুষের এ মিছিলে দিতে পারো যদি গতিবেগ,
অনায়াসে সেই ঝড় আবার তুলিবে তারা টানি,
মৃত মাঠ দিয়ে যাবে সাহারার উদ্দম আবেগ।।

 দরিয়ার শেষ রাত্রি

রাত্রে ঝড় উঠিয়াছিল; সুবেসাদিকের ম্লান রোশনিতে সমুদ্রের
বুক এখন শান্ত। কয়েকজন বিমর্ষ মারা সিন্দবাদকে
ঘিরিয়া জাহাজের পাটাতনে আসিয়া দাঁড়াইল।

১ম মাল্লা
কাল রাত জেগে আওয়াজ পেয়েছ, কোনো?
জিঞ্জির আর দাড় উঠেছিল দুলে।

২য় মাল্লা
বুঝি সী-মোরগ সাথীহারা তার দরিয়ার শেষ রাতে
ঝড় বুকে পুরে বসেছিল মাস্তলে!

৩য় মাল্লা
যেন সুলেমান নবীর শিকলে বন্দী বিশাল জিন
হাতি চাপড়ায়ে কেঁদেছিল কাল সারারাত … সারারাত,
পাল মুড়ি দিয়ে পাটাতনে শুয়ে শুনেছি কান্না সেই
সমস্ত গায় লেগেছিল তার হতাশার কশাঘাত,

বন্দী সে জিন কেঁদেছিল বুঝি দূর ও’তানের তরে
কাল রাতে তার আওয়াজ শুনেছি দরিয়ার হাহাস্বরে;
সেই সাথে সাথে আমার মনেও জেগেছিল আহাজারি,
ছুটেছিল যেথা জিন্দিগী মোর বাগদাদ বন্দরে।

৪র্থ মাল্লা
দজ্‌লার পাশে খিমার দুয়ারে হাসিন জওয়ানি নিয়ে
যেখানে আমার জীবনের খা’ব মন ছুটেছিল সেথা,
কাফেলার বাঁশী বয়ে এনেছিল জহরের মত ব্যথা।
কলিজার সেই রুদ্ধ বেদনা শুনেছি ঝড়ের স্বরে।

৫ম আলী
বুক চেপে ধরে সেই ঝড়ে পাটাতনে পেতে কান
এনেছি সুদূর আঞ্জির শাখে টাঙানো দোলার গান,
দুধের বাচ্চা কেঁদে উঠেছিল আমার বুকের পরে,
শুনেছি আমি সে-শিশুর কান্না কাল রাত্রির ঝড়ে।
সাত সফরের সাথী তুমি জান পাথরে গড়া এ মুঠি,
বেদনা-নিসাড় দোলনার সুরে পড়েছিল পাশে লুটি
বেঁহুশ হালতে খুঁজেছি আঁধারে দুখানা কোমল ডানা
কিশতীর মুখ যোরাও এবার শুনব না আর মানা।

সিন্দবাদ
শুনতে কি পাও দূর ওতানের টান
মাঝি মাল্লার দল!
দরিয়ার বুকে শেষ হল সন্ধান?
ডাকছে খাকের গভীর স্নেহ অটল?

৬ষ্ঠ মাল্লা
কাল মালে ঝড়ের কান্না শুনেছি একলা জেগে,
শুনেছি কান্না রাত জেগে দূর মরুভুর কূলে কূলে,
বাদামের খোসা এসেছিল এক ভেসে তুফানের বেগে,
আমার বুকের সকল পর্দা উঠেছিল দুলে দুলে,
এসেছিল এক সী-মোরগ তার চঞ্চতে মাটি বয়ে
আমার আতশী রগের রক্ত গলেছিল আঁসু হয়ে–
দুলে উঠেছিল আবছা আলোয় দরিয়ার নোনা পানি,
নাড়ী-ঘেঁড়া ব্যথা মউজের মুখে জেগেছিল কাতরানি;
শুনেছি আমার পুরানো মাটির টান–
তারার চেরাগে করেছি আমার দিগন্ত সন্ধান।

৭ম মাল্লা
ডাকে বাগদাদী খেজুর শাখায় শুক্লা রাতের চাঁদ,
মাগির বুঝি দজলার বুকে ফেলে জ্যোছনার জাল,
কোমল কুয়াশা মেহে যেথা মাটি পেতেছে নতুন ফাঁদ;
ঘরে ফেরবার সময় হয়েছে আজ।

সিন্দবাদ
নতুন দ্বীপের পত্তনি নিয়ে পেতেছি সেখানে খিমা,
জরিপ করেছি সাত সাগরের সীমা;
ঝড়ের ঝাপটা কাটায়ে এসেছি পাড়ি দিয়ে টাইফুন,
রূহা দ্বীপে নেমে শুকায়েছি মোরা আহত গায়ের ঘুণ…;
পার হয়ে কত এসেছি নিরালা দরিয়ার বিভীষিকা
মাস্তুলে ফিরে জ্বালায়েছি দেখ সফরের শিখা….

১ম মাল্লা
আজ বাগদাদ ডাকে কোথা বহু দূরে।
যাব স্রোত ফুঁড়ে যাব সব বাঁক ঘুরে
হাতীর হাড়ের সওদা নিয়েছি, নিয়েছি কাবাব-চিনি,
আলমাস আর গওহর দিয়ে বেসাতি করেছি পূরা,
শেষ কেরছি এ পিপুল, মরিচ, এলাচের বিকি-কিনি;
কিশতীর মুখ ঘোরাও এবার দরিয়ার বন্ধুরা।

সিন্দাবাদ
ভীরু কমজোর…

২য় মাল্লা
ভয় পাই নাকো, কমজোর নই মোরা।
হালের মুঠির মত আমাদের কব্জা, সিন্দবাদ।
দরিয়ার মত দারাজ সিনায় আজ নামে পেরেশানি;
এড়াতে পারি না-ঐ শোনো ডাকে বহুদূরে বাগদাদ…

৩য় মাল্লা
মোরা মুসলিম দরিয়ার মাঝি মওতের নাই ভয়
খিজিরের সাথে পেয়েছি আমরা দরিয়ার বাদশাই,
খাকে গড়া এই ওজুদের মাঝে নিত্য জাগায় সাড়া
বাগদাদী মাটি; কিশতীর মুখ এবার ঘোরাও ভাই!

সিন্দবাদ
কাল ঝোড়ো রাতে দাঁড়ের আঘাতে দামী জেওরের মত
হীরা জওহর ফুটেছিল কত দরিয়ার নীল ছাঁচে,
সফরের মায়া টানছে আমাকে দূর হতে আরো দূরে–
নোনা দরিয়ার আকাশ আমার জাগছে বুকের কাছে;
আল্লার এই অশেষ আলমে অফুরান রূপ, রস
জমে গাঢ় হয়ে দূর সফরের আশা যেন হীরাকষ–

৪র্থ মাল্ল
দরিয়া-সোঁতায় বুঝে হল কত জিন্দিগী পয়মাল,
লোন হল হাজারো সে জান মাল
পেরেশান তনু…

সিন্দবাদ
তবুও শ্রান্তিশেষে
বাগদাদ ফের নতুন সফর দেখবে আগামী কাল।
আহা ভুলে গেলে আকীকে গড়া এ দরিয়া নীল মহল,
নামে জিলকদ রাতের শাজাদী তের তবকের চাঁদ,
ভুলে গেলে তার সকল স্বপ্ন সাধ,
ভুলে গেছে তার সুদূর আশা সফল!

জাজিমের বুকে ছড়ানো পাথর দানা!
ডাকছে আবার তোমাদের সাথী মাল্লা সিন্দবাদ,
চলো ফুঁড়ে চলি আকাশের শামিয়ানা;

কালো মওতের মুখোমুখি হয়ে জংগী জোয়ান ফিরে
দরিয়া-সেতায় টেনে তুলি চললা তুফানের মাতামাতি।
ভুলে যেও না এ মাল্লার জিন্দিগী,
শুরু করে ফের নতুন সফর আজি,
দেখ, মাস্তুলে জ্বেলেছি নতুন বাতি;
মৌসুমী-হাওয়া পাল ভরে ওঠে বাজি।

৫ম মাল্লা
শুধু দু’ঘড়ির বিশ্রাম নেব পাতার খিমায় মোর,
করব না হেলা মাটির গভীর টান।
আজ কত দূরে কোথায় সে বন্দর?
কোথায় আমার খেজুর-বীথির গান।

৬ষ্ঠ মাল্লা
বার দরিয়ায় পেয়েছি আমরা জীবনের তাজাঘ্রাণ–
পেয়েছি আমরা কিশতী-ভরানো জায়ফল, সন্দল;
দরিয়ার ঝড়ে আহত ক্ষণিক নিতে চাই বিশ্রাম;
মাটির মমতা বোঝে শুধু এক দরিয়ার মাঝিদল।

৭ মাল্লা
ভাঙে দরিয়ার ঘূর্ণী তুফানে জীর্ণ প্রাচীন মন,
সবুজ ঘাসের শিয়রে বাতাস বয়ে যায় অনুখন
অঙে না, নিত্য গড়ে নেয়া মন নতুন মাটির ঘর–
কিশতীর মুখ খুঁজে ফেরে তার আশ্রয় বন্দর–

৮ম মাল্লা
হাজার আঘাত গায়ে টেনে তাই বেসাতি করেছি পূরা।

সিন্দবাদ
কিশতীর মুখ ঘোরাও এবার দরিয়ার বন্ধুরা।
(মাল্লার দল তুমুল কলরবে জাহাজের হালের দিকে ছুটিয়া গেল)

মাল্লাগণ সমস্বরে
কিশতীর মুখ ঘোরাও এবার দরিয়ার বন্ধুরা…

নিশান

আধো চাঁদ আঁকা নিশান আমার! নিশান আমার!
তুমি একদিন এনেছিলে বান-জীবন তুফান!
জুলফিকারের, খালেদী বাজুর তুমি সওয়ার,
উমরের পথে বিশ্বের দ্বারে হে অম্লান,
পার হয়ে গেছ বিয়াবান আর খাড়া পাহাড়
সবল হাতের কব্জায় যবে ছিলে সওয়ার।
কমজোর বাজু পারে না বইতে ও গুরুভার,
সঙ্গ দিলে আজ ওড়ে না নিশান মানবতার;
চারদিকে আজ দেখছে সে তাই মৃত্যু তার।
কার হাতে তুমি সওয়ার হয়েছ আল হেলাল?
আরাফাত মাঠ পড়ে আছে মন নাই বেলাল।
তাই বিমর্ষ আকাশ-কিনার, দিনের মিনার;
পারি না ওড়াতে সেখানে নিশান-নিশান আমার।
অথবা পছু দুর্বল আজ ঈমান তাই
পরাজিতের এ দুয়ারে জেহাদী নিশান নাই,
আজ প’ড়ে আছি খেলার পুতুল আজাজিলের,
মুমিনের দিল হারায়ে আমরা মৃত দিলের
বোঝা ব’য়ে যাই ফরমান মেনে প্রবৃত্তির
তাই ক্রমাগত দূর সরে যায় দিনের তীর ….
অন্ধ বধির মৃত্যুর নীড়, আসে শিকল,
শাসনে, শোষণে সারা তনুমন জরা-বিকল।
আজকে তোমাকে ডাক দিই তাই হে অপচল।
হে জুলমাতের সফেদ মুক্তি, চির অটল।
তুমি ফিরে এসো আমাদের হাতে। শুদ্র উষার
সাফা মারোয়ার তাজা প্রাণ নিয়ে পথিক হেরার
জ্বালায়ে যাও এ মৃত জনপদ সিপাহসালার,
ভেঙে ফেলো এই জগদ্দলের মৃত্যু দুয়ার।
হে নিশান ফের ইঙ্গিত দাও মানবতার,
হে নিশান ফের ইঙ্গিত দাও
মৃত যাত্রীকে পথ চলার,
ইঙ্গিত দাও মানবতার সে
পূর্ণ চাদের ভরা-বিকাশ।
মানবতাহীন মানুষের বুকে
যেখানে উঠেছে নাভিশ্বাস,
বঞ্চিত তনু মনের আকাশ
খা’ক হয়ে যেথা জ্বলে আকাশ,
চৈত্র-দগ্ধ পোড়া মাটি ম্লান
নিষ্প্রভ নীল শূন্যাকাশ,
সেখানে জাগাও সাড়া সু-প্রবল
দাও আহ্বান পথ চলার;
সেখানে তোমার ইশারা জানাও মানবতার।
তায়েফের পথে শোণিত স্নানের আমন্ত্রণ,
জেরুজালেমের দুস্তর মাঠ
পাড়ি দিতে করে পরাণপণ।
নিশান আমার! নিশান আমার!
একী নির্দেশ সীমা-বিলোপ।
সবুজের কন, কেতকীর বন
সে কি শুধু হবে মনসা-ঝোপ।
সেখানে কি তুমি জাগবে না আর নিশান আমার?
সেখানে কি তুমি জেগেছে আবার নিশান আমার?
আউয ধানের দেশে মদিনার রক্ত গোলাব
সকল আশার পূর্ণতা নিয়ে মেলবে কলাপ,
বন্য ঝড়ের বৈশাখী পাখা নিশান আমার
আধো চাঁদ আঁকা, হায় মেঘ ঢাকা নিশান আমার।
পথে প্রান্তরে লুষ্ঠিত আজ যার জীবন,
যে মৃতদলের সম্মুখে ব্যুহ রচে মরণ
তাদের আকাশে জাগালে আজ এ কিসের পণ :
বাঁচাতে হবে এ ধূলি-লুষ্ঠিত গণ-জীবন।
এই অতুলন জীবন বাঁচাতে হবে,
পায়রার খোপ ছেড়ে কবুতর ভাসবে আবার নভে,
অনেক দিনের জরা-বিশীর্ণ পায়রা সে
মুক্ত হাওয়ার আবাদ হায় পায় না সে,
তারে দিতে হবে নতুন হাওয়ার
আবাদ আর নেব চেতন,
পায়রার খোপে মহা-বিস্তৃতি
সিন্ধুতীরের উজ্জীবন।
বিরাট আকাশ ভরানো দিল।
উমরের সেই মহান দারাজ
দিগন্ত পারে ছড়ানো দিল।
নিশান আমার কি স্বপ্ন তুমি দেখছো আজ;
নিশান আমার শীর্ণ মুঠিতে
পেতে চাও তুমি মহা-নিখিল?
ক্ষুধিত মাটিতে সে নয় তাজমহল,
মানুষের মাঠে বিরান মাটিতে
এবার ফলাবে তাজা ফসল,
এবার নিশান থামবে না তুমি
গড়তে শিলার তাজমহল,
এবার তোমার যাত্রা যেখানে
ক্ষুধা বিশীর্ণ অশ্রুজল,
এবার তোমার যাত্রা সে-পথে
যেথা উমরের পায়ের ছাপ,
জং ধ’রে যেথা প’ড়ে আছে হায়
আলির হাতের জুলফিকার,
পিঠে বোঝা নিয়ে ক্ষুধিতের দ্বারে
চলে একটানা পথ তোমার;
দেখো সিরাজাম-মুনীরা জ্ব’লছে
মুছে দিতে সব ফাঁকা প্রলাপ…
গুঁড়ো করে দিতে কুয়াশার ভিতে
মান জড়তার অবির গতি,
নাস্তিকতার টুটি ছিঁড়ে নিতে
সায়ফুল্লার ঠিকরে জ্যোতি।
যেথা কবন্ধে মৃত জড়বাদ;
সেখানে জীবন চিরন্তন।
নিশান আমার করবে কি ফের
সফেদ নূরের বীজ বপন?
নিশান আমার। নিশান আমার।
এতদিন হ’ল সময় তবে?
আজ কি অন্ধ নফসের সব
জিন্দানখানা ভাঙতে হবে?
পিছু ঠেলা দিয়ে জড় রোগীদের
দেবে কি আবার বিপুল গতি;
আল-বোর্জের অচল শিখরে
বহাবে কি প্রাণ স্রোতস্বতী।
নিশান আমার। একদিন তুমি হে দূত উষার
খালেদের হাতে, তারেকের হাতে, হ’য়েছ সওয়ার,
উমর আলির হাতের নিশান নবীজীর দান।
আমাদের কাছে নিশান তোমার শিখা হ’ল ম্লান।
তুমি আনো ফের হেজাজ মাঠের মরু সাইমুম
ভাঙো আঁধারের শিখর ওড়াও জড়তার ঘুম,
তুমি আনো সাথে মানবতার সে নির্ভীক ঝড়
প্রলয়াকাশের বুকে জীবনের দাও স্বাক্ষর,
আউষ ধানের দেশে মদিনার সৌরভ ভার
ঝড় বৈশাখে জাগো নির্ভীক, জাগো নিশঙ্ক হেলাল আবার!
হও প্রতিষ্ঠ আকাশে আকাশে নিশান আমার
নিশান আমার।।

নিশান-বরদার

দিন রাত্রির বোঝা হ’ল আজ দুঃসই গুরুভার,
স্খলিত পথীর আয়োজন চলে পশ্চাৎ যাত্রার,
চারদিকে বন মরণ শর্তে জীবনের অধিকার–
এখানে তোমার নিশান ওড়াও হে নিশান বরদার।
ঘন হয়ে এল দুঃখের রাত তিমির নিবিড়তর
এবার তোমার আলোয় নিশান এ-পথে প্রকাশ ক’রো,
সূর্যের ঝড়ে এই আঁধারের মরাপাতা ফেলো ছিঁড়ে
মৃত্যুর তীরে তীরে
ওড়াও তোমার প্রথম উষার দীপ্ত বহি শিখা
আলোর তুফানে ভাসাও জীণ শেহেলা কুজঝটিকা।
তোমার নিশান উড়ছে কোথায় নির্জন প্রান্তরে,
জনারণ্যের এখানে শূন্য শাখা,
নীড় ছেড়ে তার স্বপ্নের পাখী বহুদিন পলাতকা
জরাস্থবির গুমরি মরে–
হে নিশান-বরদার।
ইব্রাহিমের পথ বেয়ে যার শুরু হ’ল যাত্রার,
কমলিওয়ালার ডেরায় যে পেল ঠাঁই
সেই কাহফিল-ওয়ারার নিশান শারাবন তহুরার
কাফুর সুবাস বয়ে নিয়ে আসে পার হ’য়ে কান্তার; তু
মি আনো সেই আলোর ইশারা ভাঙো এ তিমির দ্বার
মৃতারণ্যের এ মনে আবার তুমি তার করো ঠাঁই।
মুক্ত কা’বার ভেঙেছে ‘লাত’ ‘মানাত’
কালের কোঠায় তবু বদলিয়ে হাত
মনে মনে বাসা বেঁধেছে লাত মানাত
মরু মজ্জায় আদ সামুদের জড়তার কালোরাত।
কোথায় আলোর দূত।
মাথা চাড়া দিয়ে কাঁটা বনে জাগে আদ সামুদ।
চারদিকে কারা ফেলে বিষাক্ত শ্বাস,
কারা বয়ে আনে করোটিতে মৃতাসব,
শবের মিছিলে ভিড় করে আসে শব;
মুখে বয়ে আনে চরম সর্বনাশ।
সে পাশবতায় আজ উদ্যত ফণা
বিষাক্ত করে সুদূর সম্ভাবনা,
ভেঙে পড়ে তার পূহ আঘাতে স্বপ্নের চারাগাছ,
সাত মানাতের সরে নাচে পিশাচ
আধো জীবন্ত তনু;
রং চটা তার আকাশে কখন নিজেহে বর্ণধনু।
সে সিঁদরাতুল-মুনতাহার
পথ লোলা বুলবুলি,
প্রতি মুহূর্তে আবিল করে সে
এই ধরণীর ধূলি,
ম্লান ভূলতে আজ সে বিবর গড়ি
দী দিনেরে ক’রেছে কখন বিষাদ শর্বরী।
তার করে বীভৎস চীৎকারে–
কেঁপে ওঠে বারে বারে
উষর মাটির বক্ষে অনুর্বর
দুঃস্বপ্নের ঘর।
শঙ্কিত তার দিনের আকাশ,
বিভীষিকা ভরা ঘুম,
ছিন্ন ডেরার দুয়ারে আঘাত
হানে মরু সাইমুম,
তার কলিজার রক্তে রঙিন গ’ড়ে ওঠে ইমারত,
তার কঙ্কাল বিছায়ে জালিম মাপে মিনারের পথ;
পথে পথে আজ শোন তার হাহাকার
হে নিশনি-বরদার।
এখানে তোমার নিশান ওড়াও, নিশান ওড়াও বীর,
এখানে শুধুই আবছায়া রাত্রির
তিমির নিবিড়তর,
এখানে তোমায় সূর্য প্রকাশ করো।
জনারণ্যের শাখায় শাখায় আগে প্রাণ-ব্যাকুলতা
আনো আনো তার বিপুল তৃষার দুকূলে উচ্ছলতা
সর স্রোতোধার;
হে নিশান-বরদার।।

পাঞ্জেরি

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে
নিরাশায় ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী;
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি’
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,–ও কি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী!
পাঞ্জেরি!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি;
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি।।

পুরানো মাজারে

পুরানো মাজারে শুয়ে মানুষের কয়খানা হাড়
শোনে এক রাতজাগা পাখীর আওয়াজ। নামে তার
ঘনীভূত রাত্রি আরো ঘন হ’য়ে স্মৃতির পাহাড়।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে। জানি;–মুসাফির-ধূলির অতিথি
প্রচুর বিভ্রমে, লাস্যে দেখেছিল যে তন্বী পৃথিবী
পুঞ্জীভূত স্মৃতি তার জীবনের ব্যর্থ শোক-গীতি :
রাতজাগা পাখীর আওয়াজ : জমা আঁধারের টিবি–
যেন এক বালুচর, দুই পাশে তরঙ্গ-সঙ্কুল
জীবনের খরস্রোত, নিশ্বাণ বিভ্র বালুচরে
কাফনের পাশ দিয়ে বেজে চলে দৃঢ় পাখোয়াজ।
পুরানো ইটের কোলে শোনে কারা সংখ্যাহীন ভুল
ঝরেছে অপরাজেয় অগণিত মৃত্যুর গহ্বরে।
মাজার কাঁপায়ে তোলে রাতজাগা পাখীর আওয়াজ।।

 বন্দরে সন্ধ্যা

গোধূলি-তরল সেই হরিণের তনিমা পাটল
-অস্থির বিদ্যুৎ, তার বাঁকা শিঙে ভেসে এল চাঁদ,
সাত সাগরের বুকে সেই শুধু আলোক-চঞ্চল;
অন্ধকার ধনু হাতে তীর ছোড়ে রাত্রির নিষাদ।
আরব সমুদ্র-স্রোতে ক্রমাগত দূরের আহ্বান,
তরুণীর মুখ থেকে মুছে গেছে দিনের রক্তিমা,
এ দিকে হরিণ আনে বাঁকা শিঙে চাঁদ : রমজান;
ক্ষীণাঙ্গীর প্রতীক্ষায় যৌবনের প্রাচুর্য; পূর্ণিমা।
যোল পাপড়িতে ঘেরা ঘোড়শীর সে পূর্ণ যৌবনে
আসিল অতিথি এক বন্দরের শ্রান্ত মুসাফির!
সূর্যাস্তের অগ্নিবর্ণ সেহেলির বিমুগ্ধ স্বপনে,
নিভৃত ইঙ্গিত তার ডেকে নেয় পুস্পিত গহনে;
অনেক সমুদ্র তীরে স্বপ্নময় হ’ল এ শিশির,
তারার সেনালি ফুল ছিটে পড়ে রাত্রির অঙ্গনে।।

বা’র দরিয়ায়

সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ায় শাদা তাজী!
খুরের হলকা,–ধারালো দাঁড়ের আঘাতে ফুলকি জ্বলে
সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ঘোরে দরিয়ায় শালা তাজী….
কেশর ফোলানো পালে লাগে হাওয়া, মালে দোলে চাঁদ,
তারার আগুনে পথ বেছে নেয় স্বপ্নেরা সারারাত,

তাজী ছুটে চলে দূরন্ত গতি দুর্বার উচ্ছল;
সারারাত ভরি তোলপাড় করি দরিয়ার নোনাজল।

আদমসুরাত মুছে যায়, জ্বলে দিগন্তে শুকতারা,
জ্বলন্ত খুনে প্রভাতের হাওয়া লাগে,
সুবে সাদিকের স্পন্দন যেন আরো মৃদু হয়ে আসে;
কেশর ফোলানো পাল নুয়ে যায় প্রশান্তি প্রশ্বাসে।

সিন্ধু ঈগল পাড়ি দেয় পাশে ফেন উত্তাল রাত,
ঝলসায় কালো মেহরাবে তাজা মুক্ত নীল প্রভাত,
বাজে দ্রুত তালে দৃঢ় মাস্তুলে কাফা হাওয়ার ছড়ে,
ঘোরে উদ্দাম সিন্ধু ঈগল সমুদ্র-নীল ঝড়ে,
তুফানের ছাঁচে ঘূর্ণাবর্তে সুগঠিত তার তনু,
পুষ্ট পালকে পিছলিয়া পড়ে প্রবল বর্ণধনু
দুই রঙা স্রোতে কোথা দূরে দূরে ঘুরে ফেরে দিনমান
ফিরে আসে মৃত বুস্তানে ফের নও বাহারের গান;
দীর্ঘছন্দা নারিকেল শাখে মুক্তি উঠেছে বাজি
সন্দিপের তীরে তীরে কোথা পাখিরা ধরেছে গান;
সিন্ধু ঈগল বালুচরে বুঝি নীড় করে সন্ধান
সমুদ্র থেকে সমুদ্রে ছোটে দরিয়ার শাদা তাজী।

এবার কোথায় কোন্ বন্দরে মাঝি।
ভিড়বে কিশতী মুখ।
থামবে কোথায় দরিয়ার শাদা তাজী।

কত স্রোত আর ঘূর্ণি তুফান পাড়ি দিয়ে অবহেলে;
কত লাল, নীল, জরদ, প্রভাত; সন্ধ্যা এসেছি ফেলে;
আমাদের তাজী ফেন উচ্ছল মুখ
থামবে না বুঝি সব স্রোত থেমে গেলে।

তুফানের মাঠ পাড়ি দেওয়া তার একী দুরন্ত নেশা।
দাঁড়ের আঘাতে জিঞ্জিরে তার নীল নেশা ওঠে বাজি
আমাদের মনে দরিয়ার মত্ততা।
কোথায় উল্কা ছুটেছে মাতাল তাজী?
দূরে বহু দূরে বন্দর গেছে মিশে
দিগকাওসের কোলে,
সূর্যের ঝাঁজ জমে ওঠে পাল ভরে
নতুন পথের বাঁকা ধনু আসে সরে
সমুদ্র কল্লোলে;
তীব্র নেশায় দুরন্ত গতিবেগে
বুঝি পথ লোলে দরিয়ার শাদা তাজী!

দূর বন্দরে দীপ্ত সূর্য, আমাদের গতিমান
জাহাজের পাল স্রোতের নেশায় ভরা,
যেথা দিগন্তে সবৃজা হেরেমে ভাসে পরীদের গান,
নেকাব দোলায়ে আদিম বনানী জাগছে নৃত্যপরা;
দরিয়া-মরুর মরীচিকা পানে মাতাল
দুঃসাহসী ছুটছে অঙ্ক তাজী।

হয়তো সে ভুল, হয়তো সে ভুল নয়
তুফানের মুখে জমা হয় বিষ, জমা হয় সংশয়,
জাহাজের হাল নির্মম হাতে ঘোরাও এবার মাঝি।
এ পথের শেষ, এ গতির শেষ কোথা,
কোথায় মাতাল ছুটছে অন্ধ তাজী।

জমা হয় কালো টাইফুন মেঘ
পাটাতনে লাগে দোলা,
শংকায় নীল থেমে যায় মৃদু আবর্ত কল্লোল,
প্ন শেষের আসন্ন বৈশাখী,
শিকলে শিকলে হেষা ওঠে, পালে লাগে টাইফুন দোল
নির্মম হাতে হাল টেনে ধরো মাঝি।
আঁধির পাহাড়, অজগর ঢেউ, শোনো,
শব্দিত ঐ সাপের ফণার ত্রাস,
কালো ঐ মৃত্যু সর্বনাশ।
পাল খুলে নাও, যেতে হবে ঝড় ঠেলে
চমকাক পাশে কালো আজদহা লোল জিভ ঘন ঘন …
আবুরুজের চূড়া যেন এক উড়ে আসে কালো দেউ
বজ্রের বেগে পাটাতনে ভাঙে পাহাড়ের মত ঢেউ,
দিনের আকাশে একী জুলমাত মাঝি!
ঐ দেখ আসে মউজের পর মউজের কালো সারি;
ঐ দেখ সাথে নীল আসমানে চম্‌কায় তলওয়ার,
পাল ফেটে গেল, মাদ্ভুল ভাঙে বুঝি
ঝড়ের চাবুকে পাটাতনে ওঠে সকরুণ হাহাকার

এই দরিয়ায় ডুবলো বুঝি এবার
আমাদের শাদা তাজী।

পাক বারিলা আল্লার শান–এই মউজের বুকে
মরদের মত হাল সামলাও মাঝি!

নিপুণ হাতের বলিষ্ঠ পেশী যদি পড়ে যায় ছিঁড়ে
তবে তুরন্ত বদলায়ে নাও হাত,
এক লহমার গাফলতে জেনো এই মৃত্যুর তীরে
ডোবালে অতলে প্রবল ঝঞ্ঝাঘাত।
বল্প টানো এ ফেনিলাবর্তে
পার হয়ে এই ঝড়
সমুদ্র থেকে সমুদ্র ঘুরে পথ খুঁজে পাবে তাজী!

পাড়ি দিয়ে তুমি এসেছ দরিয়া কতো,
কিশতীর মুখ বাঁচায়ে এনেছ বহু টাইফুনে যুঝি;
ছিঁড়ে গেছে শিরা, উড়ে গেছে এক হাত;
আর হাতে তুমি হাল যোরায়েছ তুফানের সাথে যুঝি।

দরিয়ার মাঝি। তোমার ওজুদে পাথর গলানো খাক!
পাথর পারানো কুঅত তোমারে-দিয়াছে আল্লা পাক!
চলো বেমার দরিয়ার ঢেউ ছিঁড়ে,
আবুরুজের মতো এ মউজ ঘিরে।
ঝলসাতে থাক তোমার হালের চাকা,
চম্‌কাতে থাক তোমার চোখের তারা,
দরিয়া সেতায় যেখানে এ তাজী ভেসে চলে দিশাহারা
দাঁড়াও সেখানে ভেঙে চলো এই মউজের কালো পাখা।
পার হয়ে রাত ম্লান জুলমাত ঘেরা।
পারে নিয়ে যাবে ভাসমান এই ডেরা
দরিয়ার শাদা তাজী।
সরন্দিপের ঘাটে নোঙ্গর ফেলবে আবার মাঝি।
তোমার সঙ্গে দরিয়া তুফানে পরিচয় সুনিবিড়।
লাখো মউজের জুলমাত ঘেরা কালো সামিয়ানা টুটি,
তুলে নিয়ে গেছে তোমার জোরালো মুঠি;
চাঁদ আলোয় দেখেছি আমার সরন্দিপের তীর।
এবার যদি এ তাজী হয় বানচাল
তক্তায় ভেসে পাড়ি দেব কালাপানি,
হাজার জীবন হয় যদি পয়মাল
মানব না পরাজয়!
ধরো অচপল আবার হালের মুঠি;
শেষ ঢেউয়ে আর করব না সংশয়।

দরিয়া তুফান জয় করে মোরা দাঁড়ায়েছি দেখ মাঝি।
ভেসে গেছে শুধু মাল্লা সাতশো, আর
উড়ে গেছে শুধু সামনের এক পাটাতন তক্তার,
দেখ ক্ষত তনু সুদৃঢ় মাস্তুল
প্রশান্ত ভাবে মাপে দরিয়ার মুক্ত নীল কিনার,
দেখ আসমানে ফোটে সেতারার কলি,
আরশির মতো নিটোল পানিতে মুখ দেখে বকাওলি।
এসেছি এখন তুফান বিজয়ী খিজিরের এলাকায়
এবারের ঝড় পাড়ি দিয়ে মোবা ফিরেছি রিজয়ী মাঝি!
দেখ আমাদের নিশান উড়ছে নীল আকাশের গায়
কেশর ফোলানোপাল নিয়ে ফের ছুটছে সফেদ তাজী।।

লাশ (তেরশো পঞ্চাশে)

যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরণীর ‘পর,
ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ীর তাপে প’ড়ে আছে
নিঁসাড় নিথর,
পাশ দিয়ে চলে যায় সজ্জিত পিশাচ, নারী নর
–পাথরের ঘর,
মৃত্যু কারাগার,
সজ্জিতা নিপুণা নটী বারাঙ্গনা খুলিয়াছে দ্বার
মধুর ভাষণে,
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
প’ড়ে আছে মৃত মানবতা
তারি সাথে পথে মুখ গুঁজে।
আকাশ অদৃশ্য হ’ল দাম্ভিকের খিলানে, গম্বুজে
নিত্য স্ফীতোদর
এখানে মাটিতে এরা মুখ গুঁজে মরিতেছে ধরণীর ‘পর!
এ পাশব অমানুষী ক্রুর
নির্লজ্জ দস্যুর
পৈশাচিক লোভ
করিছে বিলোপ
শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,
ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার,
মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;
সাক্ষ্য তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর পর।
স্ফীতোদর বর্বর সভ্যতা–
এ পাশবিকতা,
শতাব্দীর ক্রূরতম এই অভিশাপ
বিষাইছে দিনের পৃথিবী।
রাত্রির আকাশ।
এ কোন্ সভ্যতা আজ মানুষের চরম সত্তাকে
করে পরিহাস?
কোন্ ইবলিস আজ মানুষেরে ফেলি মৃত্যুপাকে
করে পরিহাস?
কোন্ আজাজি আজ থি মারে মানুষের শবে?
ভিজায়ে কুৎসিত দেহ শোণিত আসবে
কোন্ প্রেত অট্টহাসি হাসে?
মানুষের আর্তনাদ জেগে ওঠে আকাশে আকাশে।
কোন্ প্রবৃত্তির কাছে আজ ওরা পড়িয়াছে বাঁধা?
গোলাবে পাপড়িতে তুড়িতেছে আবর্জনা, কাদা
কোন শয়তান?
বিষাক্ত কামনা দিয়ে কে ভরায় আকাশের রঙিন খিলান?
কার হাতে হাত দিয়ে নারী চলে কাম সহরী?
কোন্ সভ্যতার?
কার হাত অনায়াসে শিত কষ্ঠে হেনে যায় ছুরি?
কোন্ সভ্যতায়?
পাঁজরার হাড় কেটে নৃত্য সুর জেগে ওঠে কার?
শ্রমিকের রক্তপাতে পান-পাত্র মেতে ওঠে কার?
কোন্ সত্যতায়?
মানুষ তোমার হাতে করিয়াছে কবে আত্বদান,
তারি শোধ তুলে নাও হে জড়-সভ্যতা শয়তান।
শিশুর শোণিত হেসে অনায়াসে করিতেহে পান,
ধর্ষিতা নারীর দেহে অত্যাচার করি অম্লান,
জনতার সিঁড়ি বেয়ে উরে উঠি অতি অনায়াসে
তারে তুমি ফেলে যাও পথ-প্রান্তে নর্দমার পাশে।
জড়পিণ্ড হে নিঃস্ব সভ্যতা।
তুমি কার দাস?
অথবা তোমারি দাস কোন্ পশুদল।
মানুষের কল নিকৃষ্ট ভর।
যার অত্যাচারে আজ প্রশান্তি; মাটির ঘর : জীবন্ত কবর
মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরণীর ‘পর।
সুসজ্জিত-তনু যারা এই জড় সভ্যতার দাস,
যাদের পায়ের চাপে ঢুকরিয়া কেঁদে ওঠ পৃথিবী, আকাশ,
তারা দেবে নাকো চেয়ে কী কলুষ দুর্গন্ধ পুরীষে
তাদের সমগ্র সত্তা পশুদের মাঝে চলে মিশে।
কুক্কুর, কুক্কুরী
কোন্ ব্যাভিচারে তারা পরস্পর হানিতেছে ছলনায় ছুরি,
আনিছে জারজ কোন্ মৃত সভ্যতার পদতলে।
উরুর ইঙ্গিত দিয়ে তাদের নারীরা আজ মৃত্যু পথে চলে,
লোভের বিকট ক্ষুধা বুকে নিয়ে অত্যাচারী পুরুষেরা চলে,
মানুষের পথ ছেড়ে বহু নিয়ে মৃত্যুর অতলে।
তাহাদের শোষণের ত্রাস
করিয়ামে গ্রাস
প্রশান্তির ঘর,
যেথা মুখ গুঁজে আছে শীর্ণ শব ধরণীর ‘পর।
হে জড় সভ্যতা।
মৃত-সভ্যতার দল শীতমের শোষক সমাজ।
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার -প্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও;
ধ্বংস হও তুমি ধ্বংস হও।।

শাহরিয়ার

শাহেরজাদীর ঝরোকায় এসে সাইমুম স্নায়ু শ্রান্ত শিথিল,
খোঁজে ওয়েসিস মরু-সাহারার চিড় খাওয়া দিল শূন্য নিখিল।

এ মৃত ঊষর বালুতে আবার জাগাবে আনার দানা;
কালো কামনায় লাগাম ধরবে টানি?
উচ্ছৃঙ্খল রাতের ভুলের আজ বুঝি শেষ নাই,
ভুলের মাটিতে ফুটবে না ফুল জানি।।

হাজার নাজুক কুমারীর মুখ ভাসায়ে লোহুর স্রোতে
ছুটেছিল সিয়া জিন্দিগী নিয়ে যে পশু মৃত্যুপারে,
হাজার ইশারা ডেকে ডেকে গেছে তারে
থামেনি তবু সে অন্ধ ছুটেছে পথ হতে ভুল পথে…

মনে পড়ে সেই নওল ঊষার হাসিন পিয়ারা দিল
গ্লানি-কলঙ্কে মুছে গেছে হায় আমার সারা নিখিল,
সারা মনে ভাসে রক্তের লাল ছোপ,
সারা গায় জাগে কলুষিত বদফাল,
জাগে জঘন্য লালসার কালো পাপ,
শারিয়ারের নীল আকাশের সিতারা করে বিলাপ…
শিরায় আমার জাগেনাকো আর জোছনা-শারাব ধারা
আগুনের মত জ্বলে বুকে ইনসাফ,
সাত আলিশান চাদোয়ার নীচে যেন এ গোর আজাব
জড়োয় জড়ানো কিংখাবে জাগে এ মন সর্বহারা,
খুঁজে ফেরে শুধু দিলের দোসর তার;
চিড় খেয়ে বুকে জেগে ওঠে শুধু সাথীহারা হাহাকার।

হাজার রাতের কাহিনী তোমার
হাজার রাতের গান,
ধরে মাহতাব সে রঙিন খাব
জাগে সুর-সন্ধান।

সেতারের তারে যে শূন্য ব্যর্থতা
ম্লান পেরেশান শূন্য শিথান শুনে যাই কথা।
মনে পড়ে শুধু অসংখ্য বদকার,
কোন কুহকিনী আঙ্গস্তরী স্মৃতি,
ঢেকেছে আমার মুক্ত নীল কিনার,
জিন্দিগী মোর হল আজ শোকগীতি।
পিয়াসী এ মন সুদূর সওদাগর
নয়া জৌলুসে হারানো ভিটাতে বাধিতে চায় সে ঘর!

চাঁদির তখতে চাঁদ ডুবে যায়
পাহাড় পেতেছে জানু,

নতুন আকাশে জীবনের সুর
জাগাও হাসিন বানু।

অথচ জানি এ জিন্দিগী ঘোরে যেন এক পরোয়ানা
বাঁকা সড়কের পথে মেলে ফের কমজোর লোভী ডানা,
তুফানের মাঝে হতে চায় বানচাল
জানে সে কোথায় সূর্য তবুও টানে সে আঁধি আড়াল,
ফিরে ফিরে চায় ডুবতে অন্ধ পাঁকে
ঢেলে যেতে চায় জহরের জ্বালা জীবনের প্রতি বাঁকে।

ছুটেছে সে আজ অন্ধের বেগে পাহাড় যেখানে ঢালু,
ম্লান সাহারায় পড়ে আছে হায় মুর্দার মত বালু,
যে বিরাণ মাঠে ফোটে না আনার দানা,
সেই নিরন্ধ্র মাঠে এ অন্ধ মন ছোটে একটানা,
উল্কা-আহত পথে পথে ফেরে কাঁদি। জুলমাত-ম্লান ডেরায় চেরাগ জ্বালাও শাহেরজাদী!
আমার মাটিতে ছড়াও আনার দানা,
হে উজীর-জাদী! আজ তুমি আর শুনে না কারুর মানা,
হাজার নাজুক কমনীয় মুখ যেখানে ভাসছে আর
আতশী দহনে খুনের তুফানে জ্বলছে শাহরিয়ার।

সাত-সাগরের মাঝি

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা’।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা ।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু, তুমি জাগলে না?
সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ,
অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।
হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো;
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে,
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ
মেঘ তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙে চলে সব বাঁধ ।
তবু তুমি জাগো, কখন সকাল ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু, তুমি জাগলে না?

দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?
কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভির,
হে মাঝি ! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,
নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির ।

তুমি দেখছো না, এরা চলে কোন আলেয়ার পিছে পিছে ?
চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরও নিচে !
হে মাঝি ! তোমার সেতারা নেভেনি একথা জানো তো তুমি,
তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূমি,
দেখ জমা হল লালা রায়হান তোমার দিগন্তরে;
তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে!

তোমার জাহাজ হয়েছে কি বানচাল,
মেঘ কি তোমার সেতারা করে আড়াল?
তাই কি অচল জাহাজের ভাঙা হাল
তাই কি কাঁপছে সমুদ্র ক্ষুধাতুর
বাতাসে ফাঁপানো তোমার ও ফাঁকা পাল?
জানি না, তবুও ডাকছি তোমাকে সাত দরিয়ার মাঝি,
প্রবাল দ্বীপের নারিকেল শাখা বাতাসে উঠেছে বাজি?
এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নেইকো আর,
সাত সমুদ্র নীল আকাশে তোলে বিষ ফেনভার,
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
বেসাতি তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে?
ঘুমঘোরে তুমি শুনছ কেবল দুঃস্বপ্নের গাঁথা।

উচ্ছৃঙ্খল রাত্রির আজো মেটেনি কি সব দেনা?
সকাল হয়েছে। তবু জাগলে না?
তবু তুমি জাগলে না?

তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,
যেখানে ধূলিতে কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,
যেখানে মুগ্ধ ইয়াসমিনের শুভ্র ললাট চুমি
পরীর দেশের স্বপ্ন সেহেলি জাগে গুলেবকাওলি!

ভুলেছ’ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চ’লেছে ভেসে
অজানা ফুলের দেশে,
ভুলেছ’ কি সেই জামরুদ তোলা স্বপ্ন সবার চোখে
ঝলসে চন্দ্রলোকে,
পাল তুলে কোথা জাহাজ চলেছে কেটে কেটে নোনা পানি,
অশ্রান্ত সন্ধানী।
দিগন্ত নীল-পর্দা ফেলে সে ছিঁড়ে
সাত সাগরের নোনা পানি চিরে চিরে।

কোন্্ অজ্ঞাত বন্দরে এসে লাগলো সেই জাহাজ
মনে পড়ে নাকো আজ,
তবুও সেখানে ভ’রেছে জাহাজ মারজানে মর্মরে
এইটুকু মনে পড়ে।
কবে যে তোমার পাল ফেটে গেছে উচ্ছৃঙ্খল ঝড়ে,
তোমার স্বপ্নে আজ অজগর দুঃস্বপ্নেরা ফেরে!
তারা ফণা তোলে জীর্ণ তোমার মৃত্যুর বন্দরে
তারা বিষাক্ত করেছে তোমার নুয়ে পড়া আকাশেরে।

তবু শুনবে কি, তবু শুনবে কি সাত-সাগরের মাঝি
শুকনো বাতাসে তোমার রুদ্ধ কপাট উঠেছে বাজি;
এ নয় জোছনা-নারিকেল শাখে স্বপ্নের মর্মর,
এ নয় পরীর দেশের ঝরোকা নারঙ্গী বন্দর
এবার তোমার রুদ্ধ কপাটে মানুষের হাহাকার,
ক্ষুধির শিশুর কান্নায় শেষ সেতারের ঝংকার।

আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।

কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,
আজকে কঠিন ঝড়ের বাতাস দ্বারে করে কষাঘাত,
সর্প-চিকন জিহ্বায় তার মৃত্যুর ইঙ্গিত,
প্রবল পুচ্ছ আঘাতে তোমার রঙীন মিনার ভাঙে।
হে মাঝি! তবুও থেমো না দেখে এ মৃত্যুর ইঙ্গিত,
তবুও জাহাজ ভাসাতে হবে এ শতাব্দী মরা গাঙে।

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,
এখানে এখন অজ¯্র ধারা উঠছে দু’চোখ চেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ…

কাঁকর বিছানো পথ,
কত বাধা, কত সমুদ্র, পর্বত,
মধ্যদিনের পিশাচের হামাগুড়ি,
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি’,
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন,
তবু দেখা যায় দুরে বহু দূরে হেরার রাজ-তোরণ…
শাহী দরজার সকল কপাট অনেক আগেই খোলা,
অনেক আগেই সেখানে দ্বাদশী জোছনা দিয়েছে দোলা।

হে মাঝি! তোমার নোঙ্গর তুলবে না?
এখনো কি আছে দেরী?
হে মাঝি! তোমার পাল আজ খুলবে না?
এখনো কি তার দেরী?

বাতাসে কাঁপছে তোমার সকল পাল
এবার কোরোনা দেরী,
নোনা পানি যদি ছুঁয়েছে তোমার হাল
তা’হলে কোরোনা দেরী,
এবার তা’হলে বাজাও তোমার যাত্রার জয়ভেরী,
আসুক যাত্রী পথিক, হে মাঝি এবার কোরোনা দেরী।

দেরী হয়ে গেছে অনেক জানো তা তুমি,
ফিরে গেছে কত জাহাজ-ভাসানো দরিয়ার মৌসুমী,
কত এলাচের দানা উড়ে গেছে ঝড়ে
দারুচিনি-শাখা ভেঙেছে বনান্তরে,
মেশ্কের বাস বাতাস নিয়েছে লুটি’
মৃত্যু এখন ধরেছে তোমার টুটী,
দুয়ারে জোয়ার ফেনা;
আগে বহু আগে ঝরেছে তোমার সকল হাসনাহেনা।

সকল খোশবু ঝরে গেছে বুস্তানে,
নারঙ্গী বনে যদিও সবুজ পাতা–
তবু তার দিন শেষ হয়ে আসে ক্রমে–
অজানা মাটির অতল গভীর টানে
সবুজ স্বপ্ন ধূসরতা বয়ে আনে
এ কথা সে জানে
এ কথা সে জানে।

তুব সে সাগাবে সব সঞ্চয়ে নারঙ্গী রক্তিম,
যদিও বাতাসে ঝরছে ধূসর পাতা;
যদিও বাতাসে ঝরছে মৃত্যু হিম,
এখনো যে তার জ্বলে অফুরান আশা;
এখনো যে তার স্বপ্ন অপরিসীম।

হে মাঝি! এবার তুমিও পেয়োনা ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝরে নারঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন
ভিড় করে- যেথা জাগছে হেরার রাজ-তোরণ।

সে পথে যদিও পার হতে হবে মরু
সে পথে যদিও দরিয়ার নোনা পানি
তবুও সে পথে আছে মঞ্জিল, জানি আছে ছায়াতরু
পথে আছে মিঠে পানি।

তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথ শেষে সন্ধানী!
হেরার তোরণ মিলবে সম্মুখে জানি।
তবে নোঙ্গর তোলো
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো ॥

সিন্দবাদ

কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;

নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!

আহা, সে নিকষ আকীক বিছানো কতদিন পরে ফিরে
ডেকেছে আমাকে নীল আকাশের তীরে,
ডেকেছে আমাকে জিন্দিগী আর মওতের মাঝখানে
এবার সফর টাবে আমাকে কোন্ স্রোতে কেবা জানে!

ঘন সন্দল কাফুরের বনে যোরে এ দিল বেঁহুশ,
হাতীর পাতের সাঁজোয়া পরেছে শিলাদৃঢ় আবলুস,
পিপুল বনের ঝাঁজালো হাওয়ায় চোখে যেন ঘুম নামে;
নামে নির্ভীক সিন্ধু ঈগল দরিয়ার হাম্মামে।

কেটেছে রঙিন মখমল দিন ওজুদে চিনা সরে,
তবু দূচারী সফরের ঢেউ ভেসে এল বন্দরে,
হাতীর হাওদা ওঠাও মাহুত কিংখাব কর শেষ;
আজ নিতে হবে জংগী সাঁজোয়া মান্নার নীল বেশ।
রোষে ফুলে ওঠে কালাপানি যেন সুবিশাল আজদাহা,
মউজের মুখে ভাসছে কিশতী শ্বেত,
জানি না এবার কোন স্রোতে মোরা হব ফিরে গুমরাহা
কোথায় খুলবে নওল উষার রশ্মিধারা সফেদ;
কোথায় জাহাজ হবে ফিরে বানচাল,
তক্তায় ভেসে কাটবে আবার দরিয়ায় কতকাল;
সে কথা জানি না, মানি না সে কথা দরিয়া ডেকেছে নীল!
খুলি জাহাজের হালে উদ্দাম দিগন্ত ঝিলমিল,
জংগী জোয়ান দাঁড় ফেলে করি দরিয়ার পানি চাষ,
আফতাব যোরে মাথার উপরে মাহ্তাব ফেলে দাগ;
তুফান ঝড়িতে তোলপাড় করে কিশতীর পাটাতন;
মোরা নির্ভীক সদ্রস্রোতে দাঁড় ফেলি বারো মাস।
সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে বেকার নওজোয়ান
ভাবে জীবনের সব মধু ললাটে কমজোর ভীরু প্রাণ,
এ আশ্চর্য আমাদের কাছে। কিশতী ভাসায়ে স্রোতে
আমরা পেয়েছি নিত্য নতুন জীবনের তাজা ঘ্রাণ।

পাকে পাকে ঘুরে তীরবেগে ছুটে আবর্তে দিশাহারা,
ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিঁড়ে খেয়ে আকাশে জাগায়ে সাড়া,
জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুঁড়ায়ে পাপের মাথা;
দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমে স্বপ্ন রয়েছে পাতা।

হাজার দ্বীপের বদ রুমের উপরে লানত হানি
কিশতীর মুখ ফেরায়েছি মোরা টানি’–
বুরাঈর সাথে পেয়েছি ভালাই অফুরাণ জিন্দিগী,
আবলুস-ঘন আঁধারে পেখম খুলেছে রাতের শিখী।
আর থেকে থেকে দমকা বাতাসে নারিকেল শাখে হাওয়া
লোলায়েছে সব পেরেশানি, শুরু হয়েছে গজল গাওয়া,
সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে কেটেছে স্বপ্ন রাত
শুনেছি নেশার ঘোর কেটে যেতে এসেছে নয়া প্রভাত।

জড়ো করি লাল, পোখরাজ আর ইয়াকুত ভরা দিন
দরিয়ার বুকে নামায়েছি ফের বে-দেরেগ সংগিন,
সমুদ্র-সিনা ফেড়ে ছুটে চলে কিশতী, স্বপ্ন সাধ;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!

আজ নির্ভীক মাল্লার দল ছোটে দরিয়ার টানে
পান করি সিয়া সুতীব্র জ্বালা কলুষিত বিয়াবানে
হারামি মওত ঢাকে সারা মন দেহ
গলিজ শহরতলীতে আবার জেগে উঠে সন্দেহ
বিষ নিশ্বাসে জিন্দিগী ফের কেঁদে ওঠে বিস্বাদ
নতুন পানিতে সফর এবার হে মাঝি সিন্দবাদ

কালো আকীকের মত এ নিকষ দরিয়ার বুক ছিঁড়ে
চলো সন্দল বন-সন্ধানে অজানা দ্বীপের তীরে,
হালের আঘাতে নোনা পানি ছুড়ে রাহা খোঁজো গুমরাহা,
পার হয়ে যাও আয়েশী রাতের ফাঁদ;
পাথর জমানা দরিয়ার তীরে মওতের বুকে আহা,
কাফুরের মত নতুন জীবন ডাকছে সিন্দবাদ।

জড়তার রাত শেষ হয়ে এল আজ,
কেটেছে পকা নরম আয়েশ আশরতে বহুদিন,
মর্চে ধরেছে কজায়; ম্লান তাজ।
আজ ফুঁড়ে চলে দরিয়ার সংগিন,
ভাঙো এ নরম মখমলে ছাওয়া দিন;
মাতমি-লেবাস ফেলে আজ পরে মাল্লার নীল সাজ।

আমরা মনি না, সুখা মাটি ও তাকায় শংকাকুল,
দরিয়ার ডাকে এক লহমায় ভাঙে আমাদের ভুল,
প্রকাশিত নীল দিন;
দেখে সফরের প্রসারিত পথ দিগন্ত-স্রোতলীন।

আনি আলমাস, গওহর লুটে আনি জমিদ লাল,
নিথর পাতাল বালাখানা থেকে ওঠাই রাঙা প্রবাল,
এরা জিঞ্জিরে আটক চিড়িয়া হীন কামনায় বুড়া–
শিরার্থী মত! পাথর হানিয়া করি সব মাথা গুঁড়া।

রাতে জেগে শুনি খোদর আলমে বিচিত্র কল্লোল
অর টি পড়ে মধ্য সাগরে জাহাজে জাগায় দোল,
আমরা নাবিক জংগী জোয়ান ইশারা পেয়েছি কত
মউজের মুখে তাই ভেসে যাই তুকরা খড়ের মত।
বজ্র আওয়াজ থামায়ে গভীর দরিয়ায় ওঠে চাঁদ
দিলে দুয়ারে মাথা ঠুকে মরে নাবিক সিন্দবাদ।
ভেঙে ফেলো আজ থাকে মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল-অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দবাদ।

স্বর্ণ-ঈগল

আল-বোরজের চূড়া পার হ’ল বে স্বর্ণ-ঈগল
গতির বিদ্যুৎ নিয়ে, উদ্দাম ঝড়ের পাখা মেলে,
ডানা-ভাঙা আজ সে ধুলায় যায় তারে পায় ঠেলে
কঠিন হেলার কোটি গর্বোদ্ধত পিশাচের দল।
মাটিতে লুটানো আজ সেই স্বর্ণপক্ষ, তনুতল!
আলো, বাতাসের সাথী, তুফানের সওয়ার নির্ভীক
অন্তিম লগ্নের ছায়া দেখে আজ সে মৃত্যু-যাত্রিক,
অতল কূপের তীরে পাষাণ-সমাধি, জগদ্দল।
সূর্য আজ ডুব দিল অক্সাসের তটরেখা পারে,
আসন্ন সন্ধ্যায় কালি নিয়ে এল পুঞ্জীভূত শোক,
পাহাড় ভুলের বোঝা রুদ্ধপথে দাঁড়ালো নির্মম।
এখানে বহে না হাওয়া এ বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ধারে,
এই অজগর রাত্রি গ্রাসিয়াছে সকল আলোক,
সোহরাবের লাশ নিয়ে জেগে আছে নিঃসঙ্গ রুস্তম।

 হে নিশান-বাহী

নিশান কি ঝড়ে পড়ে গেছে আজ মাটির ‘পরে?
আধো চাঁদ-আঁকা সেই শাশ্বত জয়-নিশান?
বহু মৃত্যর প্রলয়-আঘাতে, প্রবল ঝড়ে
নুয়ে গেছে সেই প্রথম দিনের জয়-নিশান?
হামাগুড়ি দিয়ে কারা চলে ঐ পতাকীদল?
কার ক্রন্দনে ভরিছে শূন্য জলস্থল?
নিশান কি আজ প’ড়ে গেছে ভূঁয়ে,
নিশান-বাহ কি চলে মাটি ছুঁয়ে
শিয়রে কি তার কঠিন বাধার জগদ্দল? “
বুক চাপা দেওয়া ধন মিথ্যার জগদ্দল?
হে নিশান বাহী। আজো সম্মুখে রাতের সীমা
দৃষ্টি রোধে কি তিমিরাচলের ঘন ম্লানিমা?
আজো সম্মুখে বন্ধুর পথ বালিয়াড়ির
সঙ্গী বিহীন জনতা-মুখর সাগরতীর?
ঐ দেখো স্রোতে অরূপ আলোতে সূর্যতরী
তীক্ষ্ণ আলোর তুফানে ছিঁড়িহে এ শর্বরী,
এই কালো রাত জমাট-তুহিন হিম-অতল,
ছিঁড়ে চ’লে যায় আলোর ছোঁয়ায় গলানো জল।
পাওনি এখনো আলোর পরশ নবজীবন?
মৃত শব হতে হয়নি কি আজো উজ্জীবন,
এখনো সূর্য ভাঙেনি কি এই রাতের সীমা,
এখনো তোমায় পথ ছেয়ে আছে ঘনম্নানিমা?
হি নিশান-বাহী। তাই আছো নুয়ে?
তাই কি পতাকা আছে মাটি ছুঁয়ে?
তবু এই চলা জানি উদয়ের পূর্বাভাস,
কালো কুয়াশার পর্দায় ঢাকা
তোমার সূর্য, আলো, আকাশ।
পায়ের তলায় প্রবল অশ্বখুরে
মরুবালুকার ফুলিঙ্গ উঠে নিমেষে মিলায় দূরে,
ওড়ে বাতাসের শিখার শিখরে মুক্তি লাল,
শ্বেত পতাকায় শাস্তিচিহ্ন আল-হেলাল।
সেই উদ্দাম রণতরঙ্গ মানে না বাধা,
পলকে পলকে জ্বলে তার খুরে অগ্নিশিখা।
আলোর প্লাবনে কে নিশান-বাহী অগ্রগামী,
ঝড়ের দাপটে ভাঙে শতকের কুজঝটিকা।
আমাকে জাগাও তোমার পথের ধারে,
আমাকে জাগাও এ বিজন কান্তারে,
আমাকে জাগাও যেখানে সেনানী। মানে না বাধন রবি,
আমাকে জাগাও যেখানে দীপ্ত সে মদিনাতুন্নবী,
বিশ্বকরুণা, মুক্তি পদা-বেদনা লাল
বহিছে চিত্ত-সুরভিত-শ্বেত আল হেলাল।
আজ দেখি হেথা ভাঙে গড়ে শর্বরী বিস্বাদ,
পাপড়ি খোলার মুহূর্তে জাগে মুমূর্ষ অবসাদ।
কোথায় নিশান, কালের পাখায় মিলালো কোথা সে-দিন,
সেই অভিযান-স্মৃতি নিয়ে আছে মরুভূমি ধুলিলীন,
জরাগ্রস্ত এ খাপদ ভূমির রজনী-স্বপ্নহীন,
প্রবল বাধার পাহারায় হেথা উদ্যত সংগীন।।
হে নিশান-বাহী। অশ্বরের প্রবল ধ্বনি
যায় না শোনা,
আজ অগণন ক্ষুধিত মুখের আর্তধ্বনি
যায় না গোণা।
কোথায় তোমার বীর-সঙ্গীর উদ্বোধন?
ফিরে আসে আজ নিরাশ হাওয়ায় শূন্যমন।
মাটি ছোঁওয়া হায় তোমার নিশান ওড়ে না ঝড়ে;
তোমার সাথীরা পথে প্রান্তরে জরায় মরে।
হে নিশান-বাহী! ওড়াও তবুও আধেক চাঁদ,
ভাঙো বারবার রাত্রির দ্বার মৃত্যুবাঁধ
হয়তো এখানে জাগিবে না আজ শস্ত্রধ্বনি,
ভাঙা শিরদাঁড়া হবে শঙ্কিত মৃত্যু গণি;
হে নিশান-বাহী! ওড়াও তবুও ওড়াও
হেলাল রশি আকাশে আকাশে ছড়াও।
নিশান তোমার যদি না ওড়ে;
নিশান তোমার প্রবল ঝড়ে
যদি বা কখনো ধূলায় পড়ে
তবুও দিনের স্বপ্নসাধ
এ ধূলি-ধূসর পথের ‘পরে।
জানি এই-দল ভাঙা মিছিল
বিজয়ী মুঠিতে নেবে নিখিল,
খুলি রাত্রির তিমির খিল
জাগাবে সূর্য; জাগাবে নীল।।
এখনো তোমার দৃষ্টিতে জাগে সুদূরের ইঙ্গিত–
সমুদ্রপথ আবিস্কারের বিপুল সম্ভাবনা,
নিমেষে আকাশ পার হয়ে এসে বসুধার সঙ্গীত
শুনিবার সাধ এখনো তোমার যায়নি অন্যমনা।
তুমি বেঁচে আছে, আজো বেঁচে আছে-সেনানীর তরবারী;
আধো চাঁদ আজো সঙ্গী তোমার যে আল-হেলালধারী।
তোমার তনুর অণুতে অণুতে সেই অশ্রুত সুর,
জাগ্রত মান হেরিছে সমুদ্র অশ্রুর।
আছে তার পার, সাগর-বেলার তীরে ভয় পেয়োনাকো
আধো চাঁদ আঁকা হে নিশানধারী, এ মিনতি মোর রাখো–
যেথা সমুদ্র হিংস্র ক্ষুধায় আঁধার-নীল
যেথা আবর্ত-সঙ্কুল স্রোত বাধা কুটিল।।

Exit mobile version