লাশ (তেরশো পঞ্চাশে)
যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়,
কালো পিচ-ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়,
সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ‘পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর।
জানি মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরণীর ‘পর,
ক্ষুধিত অসাড় তনু বত্রিশ নাড়ীর তাপে প’ড়ে আছে
নিঁসাড় নিথর,
পাশ দিয়ে চলে যায় সজ্জিত পিশাচ, নারী নর
–পাথরের ঘর,
মৃত্যু কারাগার,
সজ্জিতা নিপুণা নটী বারাঙ্গনা খুলিয়াছে দ্বার
মধুর ভাষণে,
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ‘পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
প’ড়ে আছে মৃত মানবতা
তারি সাথে পথে মুখ গুঁজে।
আকাশ অদৃশ্য হ’ল দাম্ভিকের খিলানে, গম্বুজে
নিত্য স্ফীতোদর
এখানে মাটিতে এরা মুখ গুঁজে মরিতেছে ধরণীর ‘পর!
এ পাশব অমানুষী ক্রুর
নির্লজ্জ দস্যুর
পৈশাচিক লোভ
করিছে বিলোপ
শাশ্বত মানব-সত্তা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার,
ক্ষুধিত মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় রুধিয়া দুয়ার,
মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর;
সাক্ষ্য তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরণীর পর।
স্ফীতোদর বর্বর সভ্যতা–
এ পাশবিকতা,
শতাব্দীর ক্রূরতম এই অভিশাপ
বিষাইছে দিনের পৃথিবী।
রাত্রির আকাশ।
এ কোন্ সভ্যতা আজ মানুষের চরম সত্তাকে
করে পরিহাস?
কোন্ ইবলিস আজ মানুষেরে ফেলি মৃত্যুপাকে
করে পরিহাস?
কোন্ আজাজি আজ থি মারে মানুষের শবে?
ভিজায়ে কুৎসিত দেহ শোণিত আসবে
কোন্ প্রেত অট্টহাসি হাসে?
মানুষের আর্তনাদ জেগে ওঠে আকাশে আকাশে।
কোন্ প্রবৃত্তির কাছে আজ ওরা পড়িয়াছে বাঁধা?
গোলাবে পাপড়িতে তুড়িতেছে আবর্জনা, কাদা
কোন শয়তান?
বিষাক্ত কামনা দিয়ে কে ভরায় আকাশের রঙিন খিলান?
কার হাতে হাত দিয়ে নারী চলে কাম সহরী?
কোন্ সভ্যতার?
কার হাত অনায়াসে শিত কষ্ঠে হেনে যায় ছুরি?
কোন্ সভ্যতায়?
পাঁজরার হাড় কেটে নৃত্য সুর জেগে ওঠে কার?
শ্রমিকের রক্তপাতে পান-পাত্র মেতে ওঠে কার?
কোন্ সত্যতায়?
মানুষ তোমার হাতে করিয়াছে কবে আত্বদান,
তারি শোধ তুলে নাও হে জড়-সভ্যতা শয়তান।
শিশুর শোণিত হেসে অনায়াসে করিতেহে পান,
ধর্ষিতা নারীর দেহে অত্যাচার করি অম্লান,
জনতার সিঁড়ি বেয়ে উরে উঠি অতি অনায়াসে
তারে তুমি ফেলে যাও পথ-প্রান্তে নর্দমার পাশে।
জড়পিণ্ড হে নিঃস্ব সভ্যতা।
তুমি কার দাস?
অথবা তোমারি দাস কোন্ পশুদল।
মানুষের কল নিকৃষ্ট ভর।
যার অত্যাচারে আজ প্রশান্তি; মাটির ঘর : জীবন্ত কবর
মুখ গুঁজে পড়ে আছে ধরণীর ‘পর।
সুসজ্জিত-তনু যারা এই জড় সভ্যতার দাস,
যাদের পায়ের চাপে ঢুকরিয়া কেঁদে ওঠ পৃথিবী, আকাশ,
তারা দেবে নাকো চেয়ে কী কলুষ দুর্গন্ধ পুরীষে
তাদের সমগ্র সত্তা পশুদের মাঝে চলে মিশে।
কুক্কুর, কুক্কুরী
কোন্ ব্যাভিচারে তারা পরস্পর হানিতেছে ছলনায় ছুরি,
আনিছে জারজ কোন্ মৃত সভ্যতার পদতলে।
উরুর ইঙ্গিত দিয়ে তাদের নারীরা আজ মৃত্যু পথে চলে,
লোভের বিকট ক্ষুধা বুকে নিয়ে অত্যাচারী পুরুষেরা চলে,
মানুষের পথ ছেড়ে বহু নিয়ে মৃত্যুর অতলে।
তাহাদের শোষণের ত্রাস
করিয়ামে গ্রাস
প্রশান্তির ঘর,
যেথা মুখ গুঁজে আছে শীর্ণ শব ধরণীর ‘পর।
হে জড় সভ্যতা।
মৃত-সভ্যতার দল শীতমের শোষক সমাজ।
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিণ্ডে পদাঘাত হানি
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার -প্রান্তে টানি;
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও;
ধ্বংস হও তুমি ধ্বংস হও।।
শাহরিয়ার
শাহেরজাদীর ঝরোকায় এসে সাইমুম স্নায়ু শ্রান্ত শিথিল,
খোঁজে ওয়েসিস মরু-সাহারার চিড় খাওয়া দিল শূন্য নিখিল।
এ মৃত ঊষর বালুতে আবার জাগাবে আনার দানা;
কালো কামনায় লাগাম ধরবে টানি?
উচ্ছৃঙ্খল রাতের ভুলের আজ বুঝি শেষ নাই,
ভুলের মাটিতে ফুটবে না ফুল জানি।।
হাজার নাজুক কুমারীর মুখ ভাসায়ে লোহুর স্রোতে
ছুটেছিল সিয়া জিন্দিগী নিয়ে যে পশু মৃত্যুপারে,
হাজার ইশারা ডেকে ডেকে গেছে তারে
থামেনি তবু সে অন্ধ ছুটেছে পথ হতে ভুল পথে…
মনে পড়ে সেই নওল ঊষার হাসিন পিয়ারা দিল
গ্লানি-কলঙ্কে মুছে গেছে হায় আমার সারা নিখিল,
সারা মনে ভাসে রক্তের লাল ছোপ,
সারা গায় জাগে কলুষিত বদফাল,
জাগে জঘন্য লালসার কালো পাপ,
শারিয়ারের নীল আকাশের সিতারা করে বিলাপ…
শিরায় আমার জাগেনাকো আর জোছনা-শারাব ধারা
আগুনের মত জ্বলে বুকে ইনসাফ,
সাত আলিশান চাদোয়ার নীচে যেন এ গোর আজাব
জড়োয় জড়ানো কিংখাবে জাগে এ মন সর্বহারা,
খুঁজে ফেরে শুধু দিলের দোসর তার;
চিড় খেয়ে বুকে জেগে ওঠে শুধু সাথীহারা হাহাকার।
হাজার রাতের কাহিনী তোমার
হাজার রাতের গান,
ধরে মাহতাব সে রঙিন খাব
জাগে সুর-সন্ধান।
সেতারের তারে যে শূন্য ব্যর্থতা
ম্লান পেরেশান শূন্য শিথান শুনে যাই কথা।
মনে পড়ে শুধু অসংখ্য বদকার,
কোন কুহকিনী আঙ্গস্তরী স্মৃতি,
ঢেকেছে আমার মুক্ত নীল কিনার,
জিন্দিগী মোর হল আজ শোকগীতি।
পিয়াসী এ মন সুদূর সওদাগর
নয়া জৌলুসে হারানো ভিটাতে বাধিতে চায় সে ঘর!
চাঁদির তখতে চাঁদ ডুবে যায়
পাহাড় পেতেছে জানু,
নতুন আকাশে জীবনের সুর
জাগাও হাসিন বানু।
অথচ জানি এ জিন্দিগী ঘোরে যেন এক পরোয়ানা
বাঁকা সড়কের পথে মেলে ফের কমজোর লোভী ডানা,
তুফানের মাঝে হতে চায় বানচাল
জানে সে কোথায় সূর্য তবুও টানে সে আঁধি আড়াল,
ফিরে ফিরে চায় ডুবতে অন্ধ পাঁকে
ঢেলে যেতে চায় জহরের জ্বালা জীবনের প্রতি বাঁকে।
ছুটেছে সে আজ অন্ধের বেগে পাহাড় যেখানে ঢালু,
ম্লান সাহারায় পড়ে আছে হায় মুর্দার মত বালু,
যে বিরাণ মাঠে ফোটে না আনার দানা,
সেই নিরন্ধ্র মাঠে এ অন্ধ মন ছোটে একটানা,
উল্কা-আহত পথে পথে ফেরে কাঁদি। জুলমাত-ম্লান ডেরায় চেরাগ জ্বালাও শাহেরজাদী!
আমার মাটিতে ছড়াও আনার দানা,
হে উজীর-জাদী! আজ তুমি আর শুনে না কারুর মানা,
হাজার নাজুক কমনীয় মুখ যেখানে ভাসছে আর
আতশী দহনে খুনের তুফানে জ্বলছে শাহরিয়ার।