উৎসর্গ – সাত সাগরের মাঝি
উৎসর্গ – সাত সাগরের মাঝি
বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ তামদ্দুনিক রূপকার
দার্শনিক মহাকবি, আল্লামা ইকবালের
অমর স্মৃতির উদ্দেশে–
তোমার নয়নে দীপ্তি সিকান্দার শাহার মতন।
নতুন পথের মোহে তৃপ্তিহীন তোমার অন্বেষা
(জিন্দিগীর নীল পাত্রে উসিত ঘন রক্ত নেশা
অনির্বাণ শিরাজীর) পাড়ি দেয় মরু, মাঠ, বন,
অথই দরিয়া তীর। হে বিজয়ী! তবু অনুক্ষণ।
ধ্যান করো কোন পথ, কোন রাত্রি অজানা তোমার,
এক নেশা না মিটিতে সাজ আসে দ্বিতীয় নেশার
এক সমুদ্রের শেষে জাগে অন্য সমুদ্র স্বনন?
যেথা ক্ষীয়মাণ মৃত পাহাড়ের ঘুমন্ত শিখরে
জীবনের ক্ষীণ সত্তা মূৰ্ছাতু, অসাড়, নিশ্চল;
মুহূর্তের পদধ্বনি জাগে না সে সুষুপ্ত পাথরে,
জ্বলে না রাত্রির তীর, নাহি জাগে স্বপ্ন সমুজ্জ্বল
প্রাণবন্ত মাদকতা; সে নির্জিত তমিস্রা সাগরে
দিনের দুর্জয় ঝড় আনিয়াছে হে স্বর্ণ-ঈগল।
১৫.১১.৪৪
এই সব রাত্রি
এই সব রাত্রি
এই সব রাত্রি শুধু এক মনে কথা কহিকার
নিজেদের সাথে,
পুরানো যাত্রীর দল যারা আজি ধূলির অতিথি
দাঁড়ালো পশ্চাতে।
কায়খসরুর স্বপ্ন কঙ্কালের ব্যর্থ পরিহাস
জীবাণুর তনু পুষ্টি করিয়াছে কবে তার লাশ!
শাহরিয়ার দেখে যায় কামনার নিস্ফল ব্যর্থতা,
জিঞ্জিরে আবব্ধ এক জীবনের চরম রিক্ততা।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার–
খরস্রোতা জীবনের কোল ঘেঁষে যেখানে অসাড়
অন্ধকার বালিয়াড়ি, তলদেশে যাত্রীরা নিশ্চল,
মৃত্যুর কুয়াশা মাঝে বিবর্ণ তুহিন তনুতল
আঘাতে সকল গান, সব কথা রিক্ত নিরুত্তাপ,
স’য়ে যায় কবরের, স’য়ে যায় ধূলির প্রতাপ,
এই সব রাত্রি শুধু একমনে সেই কথা শোনে,
সেতারা উড়িছে তার অন্ধকার দুরন্ত পবনে।
এই সব আঁধারের পানপাত্র, মর্মর নেকাব
ছাড়ায়ে হীরার কুচী, জ্বলিতেছে জুলেখার খাব,
লায়লির রঙিন শারাব। কেনানের ঝরোকার ধারে;
ঝরিছে রক্তিম চাঁদ আঁধারের বালিয়াড়ি পারে।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে ক’রে যায় ধ্যান,
আবার শুনিতে চায় কোহিতুর, সাফার আহ্বান
দূরচারী মুসাফির কাফেলার ঘণ্টার ধ্বনিতে
তারার আলোয় গলে মারোয়ার পাহাড়তলীতে
মৃদু-স্বপ্নে কথা ক’য়ে আবছায়া শুভ্রতা বিলোর,
এই সব ম্লান রাত্রি সূর্যালোকে হতে চায় তোর।।
ঝরোকা’য়
ঝরোকা’য়
মুসাফির জনতার মৃদুশ নিম্নমুখ নীল পেয়ালায়
মিশে গেল আকাশের ঝরোকায়।
সুরমা পাহাড়ে লুপ্ত অগ্নিবর্ণ গুলরুখ শিখা।
অন্ধ পরিক্রমা-শ্রান্ত সে তীব্র দাহিকা
স্মৃতি শুধু দুর বনান্তের।
শিরিষের
শাখা ছেড়ে আরো দূরে রজনীগন্ধার,
হেনার;
কিম্বা বাগদাদের
হাজার রাত্রির এক রাত এল নেমে!
হে প্রিয়া শাহেরজাদী। তুমি আজ কী অজ্ঞাত প্রেমে
জেগে ওঠো শঙ্কায়, লজ্জায়?
তোমার সকল প্রেম আবার লুকাতে চায়
নেকাব-প্রচ্ছায়?
বৃথা বাজে রিনিঝিনি
হীরার জেওর!
হে ছলনাময়ী অন্ধ পুরুষের, পৌরুষের কেড়ে নাও
শ্রান্ত ঘুমঘোর,
ছড়াও পরাগ রক্তাধরা
জাফরানের মধু-গন্ধ ভরা।
রাত্রি আজ গাঢ় ঘন! মন
দক্ষিণ হাওয়ায় ভেসে মুসাফিয় উজানী-পবন,
গন্ধ খুঁজে ফেরে।
আকাশেরে করিয়া চৌচির
তার কান্না লুটে পড়ে
উত্তর সাগর তীরে দক্ষিণের সামুদ্রিক ঝড়ে,
সন্ধান করে সে ইতস্তত
নীড় তার শ্রাবণের পাখীদের মত।
গন্ধ আসে দূরান্তর হ’তে।
হে প্রিয়! ভেসেছি আমি দীর্ঘ নওবাহারে ঘন নীল স্রোতে,
তারার ইশায়া নিয়ে চলিয়াছ এক মনে ভেসে
সুগভীর সুরের পাখাতে,
স্তব্ধ রাতে
বেতস প্রান্তর ঘিরে
তিমির সমুদ্র ছিঁড়ে
চাঁদের দুয়ারে,
যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চলে উত্তাল পাথারে,
প্রান্তরে তারার ঝড়ে
সেই সুরে ঝ’রে পড়ে
বিবর্ণ পালক,
নিমেষে রাঙায়ে যায় তোমার নিষ্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক,
তীর-তীব্র গতি নিয়ে জুটে যায় পাশ দিয়ে উষ্কার ইশারা,
মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রের নল ঝড় তুলে যায় সাড়া
উদ্দাম চঞ্চল;
তবু অচপল
গভীর সিন্ধুর
সুদুর্গম মূল হ’তে তোলো তুমি রাত্রিতরা সুর।
ডাহুকের ডাক…
সকল বেদনা যেন, সব অভিযোগ যেন
হয়ে আসে নীরব নির্বাক।
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখী।
যাও ডাকি কি
অবাধ মুক্তির মত।
ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনি না তোমার সুর, নিজেদের বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।
এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,
তুমি বও
তোমার শৃখল-মুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবনমৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর।
তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক,
পূর্ণ করি বুক
অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না।
বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা;
ক্রমে তা’ও থেমে যায়,
প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়;
গাঢ়তর হ’ল অন্ধকার।
মুখোমুখি ব’সে আছি সব বেদনায়
ছায়াচ্ছন্ন গভীর হরে।
রাত্রি ঝ’রে পড়ে
পাতায় শিশিরে…
জীবনের দীর তীরে…
মরণের তীরে তীরে…
বেদনা নির্বাক।
সে নিবিড় আচ্ছন্ন তিমিরে
বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কণ্ঠ ঘিরে দু বনে ওঠে শুধু
তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক।।
ডাহুক
রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক …
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পলক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
অবিশ্রাম ঝরে ঝরে পড়ে
শিশির পাখার ঘুম,
গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
নিভে যায় কামনা চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
কোন ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখীর
সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে,
ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে।
তুমি কি এখনো জেগে আছো?
তুমি কি গুন্ছে পেতে কান?
তুমি কি শুনছো সেই নভঃগামী শব্দের উজান?
ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী।
চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী,
মন্থর হাওয়ায়।
সাথী তন্দ্রাতুর।
রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া পড়ে যায় ডাহুকের সুর।
শুধু সুর ভাসে
বেতন বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষয়ে আসে
রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্ন সাঁতোয়া আকাশে।
মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর!
তবু জানি তুমি সুর নও,
তুমি শুধু সুরযন্ত্র। তুমি শুধু বও
আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর
অপরূপ সুর …
অফুরান সুরা …
ম্লান হয়ে আসে নীল জোছনা বিধুরা
ডাহুকের ডাকে!
হে পাখী! হে সুরাপাত্র! আজো আমি
চিনিনি তোমাকে।
হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা,
বিচিত্র তুলিতে আঁকা
বর্ণ সুকুমার।
কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনায়
যার ব্যথা-তিক্ত রসে জমে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ,
ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ
সেই সুর পারি না চিনিতে।
মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী
পা ভরা সাকী।
উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি
বাতে নিভৃত একাকী।
হে অচেনা শারাবের ‘জাম’!
নেয়ার পিপাসার উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম
সূর্যের অজানা দেশে
যদি সূর্য বন্দী এখন আঁধারের ঝরোকা’কে
পূর্ব দিগন্তে জেগেছে আলোর গান :
সাত আকাশের যৌবন অম্লাল।
তবে সুর তোলো নীল জোয়ারের আলোকিত ঝর্ণাতে।
হে পাখী তোমার এ জড়তা ঘুচে যাক,
তোর শীর্ণ ক্লিন্নতা মুছে যাক
কালো রাত্রির সাথে-ক্ষীয়মাণ ঝরোকাতে।
আর আতশী গান,
আবার জাগুক দিগন্ত সন্ধান,
আরক্ত আভা তোমার তৃতীর কণ্ঠ রবে না ঢাকা,
আবার মেলবে রক্তিম আঙরাখা
নীল আকাশের তারার বনের স্বপ্নমুখর মনে
আখরোট বনে
বাদাম, খুবানি বনে।