সুরা
সুরার সুরত্ব জানি আমি আর তুমি!
সুরা-তৈলে মনোবাতি ছড়ায় আলোক,
মনের মন্দিরে বাজে মন্দিরা ঢোলক,—
একথা ওমার জানে, হাফিজ্ আর রুমি॥
রাত্রি বাড়ে, মাত্রা চড়ে, পাত্ৰাধর চুমি।
আকাশেতে চাঁদ ঝোলে, আলোর গোলক,
নীলাম্বরী-আড়ে দোলে মোতির নোলক,
শূন্যে উড়ে তাই ধরি, শয্যা শেষে ভূমি!
জড়েতে চৈতন্যরূপী তরল আগুন,
তোমার পরশে মাঘ গলিয়া ফাগুন!
হাবুডুবু খাই সবে ভবসিন্ধু-নীরে,
ঢোকে ঢোকে পেটে ঢোকে লবণ তরল।
সুরাসুরে তাই মথি তুলিয়াছে তীরে,
প্রকৃতির খাঁটি রস, অমৃত-গরল!
স্বপ্ন-লঙ্কা
স্বপ্নলোকে আছে মোর স্বর্ণপুরী লঙ্কা,
যেথা বাজে মির্গেল, ডান ও ঘাগর।
শিখি নাই এক লম্ফে লঙ্ঘিতে সাগর,—
সেতুর বন্ধন করি, নাই হেন টঙ্কা!
সে রাজ্যে সজোরে বাজে অনঙ্গের ডঙ্কা,
কঙ্কাবতী যেথা মেলি নয়ন ডাগর,
মোর পথ চেয়ে করে বাসর জাগর,—
স্বপ্নে আমি যাই সেথা, নাহি করি শঙ্কা॥
লীন হ’য়ে প্রিয়া-অঙ্কে, সুবর্ণ পালঙ্কে,
কলঙ্কের মত রই জড়ায়ে শশাঙ্কে!
মিলনের অহঙ্কারে সালঙ্কার কঙ্কা,
নূপুরে কঙ্কনে তোলে বীণার ঝঙ্কার,
রশনায় দেয় মুহু বিজয়-টঙ্কার,—
সে শব্দে চমকি জাগি, হেরি নবডঙ্কা!
স্মৃতি
কত দিন কত দেশে কতশত ভোরে,
অসংখ্য ফুলেতে ভরা কত ফুলবনে,
ফিরেছি অলসভাবে, এক, আনমনে,—
তুলিনি পূজার লাগি কিন্তু সাজি ভরে’॥
কত দিন কত দেশে সারানিশি ধরে’,
থেকেছি বসিয়া আমি মন্দিরের কোণে,
স্নিগ্ধদৃষ্টি কতশত দেবতার সনে,—
করিনি প্রণাম কিন্তু জুড়ি’ দুই করে॥
আগে শুধু করে’ গেছি এই সব ভুল।
এখন দেবতা কোথা, কোথা সেই ফুল!
আজি সে ফুলের গন্ধ রয়েছে সঞ্চিত
অস্পষ্ট স্মৃতির মত, সব মন ছেয়ে।
দেবতার স্থিরনেত্র, পূর্ব্বপরিচিত,
রত্নদীপ-শিখা সম, দূরে আছে চেয়ে!
হাসি
যতই দিই না আমি হাসিতে উড়িয়ে,
সমাজের সংসারের অন্ধ ক্রূর বল,—
সে ত শুধু খেলামাত্র, শুধু বাক্ছল,
এখনো যায়নি প্রাণ একান্ত জুড়িয়ে॥
নয়ন যখন দিই হাসিতে মুড়িয়ে,
লুকিয়ে তাহার নীচে থাকে অশ্রুজল।
বৃথা কাজ! জীবনের প্রতি ব্যর্থ পল
স্মৃতিতে একত্র করা, অতীতে কুড়িয়ে॥
জেনে শুনে ছুটি মোরা আলেয়ার পিছে,
সে আলো নিভিলে তাই কান্নাকাটি মিছে॥
জীবনের দিবসের স্বল্প পরিসর,
ঘিরে তারে আছে ঘন অনন্তের ছায়া।
যদিচ ধরেছি সবে দু’দিনের কায়া,—
হাসির, কাজের, তবু আছে অবসর।
হাসি ও কান্না
সত্য কথা বলি, আমি ভাল নাহি বাসি
দিবানিশি যে নয়ন করে ছলছল,
কথায় কথায় যাহে ভরে আসে জল,—
আমি খুঁজি চোখে চোখে আনন্দের হাসি॥
আর আমি ভালবাসি বিদ্রুপের হাসি,
ফোটে যাহা তুচ্ছ করি আঁধারের বল,
উজ্জ্বল চঞ্চল যার নিৰ্ম্মম অনল
দগ্ধ করে পৃথিবীর শুষ্ক তৃণরাশি॥
হৃদয়ে কৃপণ হ’য়ে ধনী হ’তে চায়,—
সুখ তারা দেয় নাকো, তাই দুঃখ পায়॥
তাই আমি নাহি করি দুঃখেতে মমতা,
সুখী যারা, তারা মোর মনের মানুষ।
হাসিতে উড়ায় তারা নিষ্ঠুর ক্ষমতা,
মনে জেনে বিশ্ব শুধু রঙিণ ফানুষ॥