ভুল
ভাল তোমা বেসেছিনু, মিছে কথা নয়।
যেদিন একেলা তুমি ছিলে মোর সাথী,
বকুলের তলে বসি, মনে মন গাঁথি।
—বকুলের গন্ধ বল কতদিন রয়?
সেদিন পৃথিবী ছিল অন্ধকারময়,
ঘন মেঘে ঢেকেছিল নক্ষত্রের বাতি,
সে তিমির চিরেছিল বিদ্যুৎ-করাতি।
—বিদ্যুতের আলো কিন্তু কতক্ষণ রয়?
স্বপ্ন মোরা ভুলে যাই নিদ্রা গেলে টুটে,
শাদা চোখে সব দেখি নেশা গেলে ছুটে॥
নিভানো আগুন জানি জ্বলিবে না আর,
মনে কিন্তু থেকে যায় স্মৃতিরেখা তার,—
হৃদিলগ্ন আমরণ পারিজাত-হার।
হৃদয়ের ভুল শুধু জীবনের সার!
মানব-সমাজ
ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত মানব-সমাজ।
মাটির প্রদীপ জ্বেলে সারানিশি জাগে,
ছোট ঘরে দ্বোর দিয়ে ছোট সুখ মাগে,
সাধ করে’ গায়ে পরে পুতুলের সাজ॥
কেনা আর বেচা, আর যত নিত্য কাজ,
চিরদিন প্রতিদিন ভাল নাহি লাগে।
আর কিছু আছে কি না, পরে কিম্বা আগে,
জানিতে বাসনা মোর মনে জাগে আজ॥
বাহিরের দিকে মন যাহার প্রবণ,—
সে জানে প্রাণের চেয়ে অধিক জীবন॥
মন তার যায় তাই সীমানা ছাড়িয়ে,
করিতে অজানা দেশ খুঁজে আবিষ্কার।
দিয়ে কিন্তু মানবের সাম্রাজ্য বাড়িয়ে,
সমাজের তিরস্কার পায় পুরস্কার!
মুষ্কিল-আশান
ছেলেবেলা একদিন প্রতিমা-ভাসান
একেলা দেখিতে যাই, ঘর ছেড়ে দূরে।
পথ ভুলে রাত্রিবেলা মরি ঘুরে ঘুরে,
ভয়েতে বিহ্বল দেখি সুমুখে শ্মশান!
অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে হই পরিশান,
কাঁপে বুক, ঝরে আঁখি, বাক্য নাহি স্ফুরে।
সহসা মশাল হাতে, ভিখারীর সুরে,
পথিক আসিল হাকি “মুষ্কিল-আশান”!
তস্বীর মালা হাতে, গায়ে আলখাল্লা,
মুখেতে মুখস্থ বুলি “লা-আল্লা-ইলাল্লা!”.
আজিও নিরাশা বুকে চাপালে পাষাণ,
কানেতে না পশে মোর দুনিয়ার হাল্লা।
হৃদয়-ফকির জপে “লা-আল্লা-ইলাল্লা”,
আকাশেতে শুনি বাণী “মুষ্কিল-আশান”।
রজনীগন্ধা
রাত্রি হাতে সঁপে দেয় দিবা যবে সন্ধ্যা,
পরায়ে তাহার অঙ্গে গাঢ় লাল আলো,
—নিশা যারে ক্রোড়ে ধরে দিয়া বাহু কালো—
সেই লগ্নে ফোটাে তুমি, রে রজনীগন্ধা!
রাত্রির পরশে যবে পৃথ্বী হ’য়ে বন্ধ্যা,
না পারে ফুটাতে ফুল রূপে জম্কালো,
তুমি সেই অবসরে বুক খুলে ঢালো,
গোপনে সঞ্চিত গন্ধ, লো রজনীগন্ধা!
দিবসের প্রলোভনে তুমি নহ বশ্যা।
হৃদয় তোমার তাই অসূৰ্য্যম্পশ্যা॥
আমার আসিবে যবে জীবনের সন্ধ্যা,
দিবসের আলো যবে ক্রমে হবে ঘোর,
কানেতে পশিবে নাকো পৃথিবীর সোর,—
মোর পাশে ফুটো তুমি, হে রজনীগন্ধা!
রূপক
কখনো অন্তরে মোর গভীর বিরাগ,
হেমন্তের রাত্রিহেন থাকে গো জড়িয়ে,
—যাহার সর্ব্বাঙ্গে যায় নীরবে ছড়িয়ে
কামিনী ফুলের শুভ্র অতনু পরাগ॥
বাসনা যখন করে হৃদয় সরাগ,
শিশিরে হারানো বর্ণ, লীলায় কুড়িয়ে,
চিদাকাশে দেয় জ্বেলে, বসন্ত গড়িয়ে
কাঞ্চন ফুলের রক্ত চঞ্চল চিরাগ॥
কভু টানি, কতু ছাড়ি, মনের নিঃশ্বাস।
পক্ষে পক্ষে ঘুরে আসে সংশয় বিশ্বাস॥
বসন্তের দিবা, আর হেমন্ত-যামিনী,
উভয়ের দ্বন্দ্বে মেলে জীবনের ছন্দ।
দিবাগাত্রে রঙ আছে, নিশাবক্ষে গন্ধ,—
সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত সার কাঞ্চন কামিনী॥
রোগ-শয্যা
যখনি চেয়েছি আমি, পরি বীরসজ্জা,
কাম্যরাজ্য-বিজয়ের ধরি দৃপ্ত আশা,
দ্রুতবেগে যাই লঙ্ঘি শতদ্রু বিপাশা,—
তখনি পেয়েছি আমি শুধু রোগশয্যা॥
ব্যথায় ভরিয়া ওঠে মম অস্থি মজ্জা,
সৰ্ব্বাঙ্গের মুখে ফোটে ব্যর্থ আৰ্ত্তভাষা,
সঙ্কল্পের ধ্বংস করে দেহ কৰ্ম্মনাশা,
রোগেতে লাঞ্ছিত হ’য়ে মন মানে লজ্জা॥
দেহের আশ্রয়ে থাকি দিন দুই চার,
তাই সই তার নীচ অন্ধ অত্যাচার॥
দেহের পীড়নে মনে আসে না বিকার,
শয্যাপ্রান্তে পাত্রপূর্ণ আছে ভালবাসা,
যাহাতে মিটাই তীব্র রোগীর পিপাসা,—
সে সুধার লাগি করি রোগের স্বীকার॥
শিখা ও ফুল
সতৃষ্ণ রসনা মেলি মনের পাবক,
মনোজবা রূপ ধরি ওঠে যবে হাসি,
—গলিত লোহিত ক্ষুব্ধ প্রবালের রাশি,—
সে শিখা পরায় তব চরণে যাবক॥
তুষারে গঠিত ফুল, স্তবকে স্তবক,
মনোমাঝে জাগে যবে শুভ্ৰ হাসি হাসি’,
সে ফুলে অঞ্জলি ভরে’ দিই রাশি রাশি,
যূথি জাতি শেফালিকা কুন্দ কুরুবক॥
তুমি চাহ রূপস্পর্শ উল্ট বিলকুল,—
ফুলের আগুন, কিম্বা আগুনের ফুল॥
আমি কিন্তু ক’রে যাব কুসুমের চাষ,
যতদিন এ হৃদয় না হয় উষর।
জ্বেলে রাখি বহ্নি জবাকুসুমসঙ্কাশ,—
যে বহ্নি নিভিলে হয় জগৎ ধূসর!
শিব
রজতগিরিতে হেরি তব শুভ্রকায়া,
চন্দ্র তব ললাটের চারু আভরণ,
তব কণ্ঠে ঘনীভূত সিন্ধুর বরণ,—
বিশ্বরূপ জানি আমি তব দৃশ্য মায়া॥
যার স্ফূর্ত্তি চরাচর, সে ত তব জায়া।
নিজদেহে করিয়াছ বিশ্ব আহরণ,
তাই হেরি কৃত্তি তব চিত্র-আবরণ,—
জীবনের আলোশ্লিষ্ট মরণের ছায়া!
তোমার দর্শন পাই মূৰ্ত্তিমান মন্ত্রে,
যজ্ঞসূত্রে বাঁধা যাহা হৃদয়ের তন্ত্রে॥
সেই রূপ রেখে দেব ভরিয়া নয়নে,—
শিবমূর্ত্তি হেরি বিশ্বে, দেহ এ ক্ষমতা।
ধরিতে পারি না আমি নেত্ৰে কিম্বা মনে,
আকারবিহীন কোন বিশ্বের দেবতা॥
সনেট
পেত্রার্কা-চরণে ধরি করি ছন্দোবন্ধ,
যাঁহার প্রতিভা মর্ত্ত্যে সনেটে সাকার।
একমাত্র তাঁরে গুরু করেছি স্বীকার,
গুরুশিষ্যে নাহি কিন্তু সাক্ষাৎ সম্বন্ধ!
নীরব কবিও ভাল, মন্দ শুধু অন্ধ।
বাণী যার মনশ্চক্ষে না ধরে আকার,
তাহার কবিত্ব শুধু মনের বিকার,
এ কথা পণ্ডিতে বোঝে, মূর্খে লাগে ধন্ধ
ভালবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন,
শিল্পী যাহে মুক্তি লভে, অপরে ক্ৰন্দন॥
ইতালীর ছাঁচে ঢেলে বাঙ্গালীর ছন্দ,
গড়িয়া তুলিতে চাই স্বরূপ সনেট।
কিঞ্চিৎ থাকিবে তাহে বিজাতীয় গন্ধ,—
সরস্বতী দেখা দিবে পরিয়া বনেট!