বালিকা-বধূ
বাঙ্গলার যত নব যুবা কবিবঁধু,
যুবতী ছাড়িয়ে এবে ভজিছে বালিকা।
তাদের চাপিয়া ক্ষুদ্র হৃদয়-নালিকা,
চোঁয়াতে প্রয়াস পায় তাজা প্রেম-মধু!
গৌরীদানে লভে কবি কচিখুকি বধূ,
কবিহস্তে কিন্তু ত্ৰাণ পায় না কলিকা।
কুঁড়ি ছিঁড়ি ভরে তারা কাব্যের ডালিকা,
দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মুখে যাচে শীধু!
পবিত্র কবিত্বপূর্ণ প্রেমে হ’য়ে ভোর,
বালিকার বিদ্যালয়ে ঢোকে কবি চোর!
বলিহারি কবি-ভৰ্ত্তা M. A. আর B. A.
বাল-বধূ লতিকার ঝুলিবার তরু!
মানুষ মরুক্ সবে গলে রজ্জু দিয়ে,
বেঁচে থাক্ কবিতার যত কাম-গরু!
বাহার
নটীবেশে তুমি এস, রাগিণী বাহার!
অঙ্গরাগ ধরি নব উজ্জ্বল শ্যামল,
মালতীর মালা চুলে, করেতে কমল,
চরণে তাড়না করি শীতের নীহার॥
বিলাসী পবন সনে উদ্যানবিহার
কর তুমি, অঙ্গে মাখি মল্লি-পরিমল।
নেত্রপুটে ধরি’ আভা কৌমুদী-কোমল,
ধরায় সলীল সুর দাও উপহার॥
তোমার পাপিয়াকণ্ঠ কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে,
বসন্তের তানে দাও দিগন্ত ছাপিয়ে॥
স্বরে গেঁথে সাত-ন’র বৈজয়ন্তী-হার,
ঝুলিয়ে দুলিয়ে দাও আকাশের গলে!
শোক দুঃখ ভয় বাধা করি’ পরিহার,
উঠুক প্রাণের দীপ মুহূৰ্ত্তেক জ্বলে’।
বিশ্ব-ব্যাকরণ
বিজ্ঞান রচেছে নব বিশ্ব-ব্যাকরণ।
ক্রিয়া কিম্বা কৰ্ম্ম নাই, শেখায় বেদান্ত,—
ক্রিয়া আছে, কর্ত্তা নাই, বিজ্ঞান-সিদ্ধান্ত,
আগাগোড়া কৰ্ম্ম শুধু, নাহিক করণ॥
সকলি বিশেষ্য, কিম্বা সবই বিশেষণ,
এই নিয়ে দ্বন্দ্ব নিত্য, লড়াই প্রাণান্ত!
সন্ধি কি সমাস সৃষ্টি, সমস্যা একান্ত,—
মীমাংসা করিতে চাই ধাতু-বিশ্লেষণ॥
সৰ্ব্বনাম রূপ আছে, নাহিক অব্যয়।
কেবল বচনে হয় সৃষ্টির অন্বয়॥
প্রকৃতির সূত্র আছে, নাই অভিধান,
জড় করে’ তাই জ্ঞানী রচে মুগ্ধবোধ।
পণ্ডিতের পক্ষে তারই মুখস্থ বিধান,—
আমরা নিৰ্ব্বোধ, তাই চাই অর্থবোধ!
বিশ্বকোষ
বিশ্বের সবাই মোরা পাঠকপাঠিকা।
পাতা তার খোলা আছে ঠিক মাঝখানে,
দেখামাত্র বুঝি মোরা স্পষ্ট তার মানে,
বাজে কাজ করা তার আদ্যোপান্ত টীকা॥
ধরণীকে চূর্ণ করি, জ্ঞানের বটিকা
গড়ে কিন্তু তিতো করে’ দর্শনে বিজ্ঞানে,
সে গুলি মূর্খেতে গেলে, বুজে চোখ কানে,—
জানেনা তাহার মূল্য নয় বরাটিকা!
বিশ্বসনে দিনরাত শুধু বোঝাপড়া,
সে ত নয় ঘর করা, করা সে ঝগড়া!
নয়নেতে আছে আলো, মনে ভালবাসা,
অন্ধকার জীবনের অপর পৃষ্ঠেতে।
সুখ দুঃখ দুই কহে প্রণয়ের ভাষা,—
সে ভাষা না বুঝে, খোঁজে মানে অদৃষ্টেতে॥
বিশ্বরূপ
কে জানে কাহার বিশ্ব,—দৃশ্য চমৎকার!
আলোকে আঁধারে এই খোলা আর মেলা,
জড়েতে চৈতন্যে এই লুকোচুরি খেলা,
তারি মাঝে মূল তানে ওঠে ঝনৎকার॥
দেখে শুনে হতবুদ্ধি আমি সনৎকার!
সুনীল আকাশ-সিন্ধু, কোথা তার বেলা,
সারি সারি ভাসে তারা, জ্যোতিষ্কের ভেলা,
কোথা যায় নাহি জানি, নহি গণৎকার!
বিশ্বটানে মন যায় বিশ্বেতে ছড়িয়ে।
অন্তর থাকিতে চায় বাহিরে জড়িয়ে॥
আমি চাই টেনে নিয়ে ছড়ানো প্রক্ষিপ্ত,
অন্তরে সঞ্চিত করি আঁধার আলোক,
প্রতীক রচনা করি চিত্রিত সংক্ষিপ্ত,—
চতুর্দ্দশ পদে বদ্ধ চতুর্দ্দশ লোক!
ব্যর্থজীবন
মুখস্থে প্রথম কভু হইনি কেলাসে।
হৃদয় ভাঙ্গেনি মোর কৈশোর-পরশে।
কবিতা লিখিনি কভু সাধু-আদিরসে।
যৌবন-জোয়ারে ভেসে, ডুবিনি বিলাসে
চাটুপটু বক্তা নহি, বড় এজলাসে।
উদ্ধার করিনি দেশ, টানিয়া চরসে।
পুত্রকন্যা হয় নাই বরষে বরষে।
অশ্রুপাত করি নাই মদের গেলাসে!
পয়সা করিনি আমি, পাইনি খেতাব।
পাঠকের মুখ চেয়ে লিখিনি কেতাব॥
অন্যে কভু দিই নাই নীতি-উপদেশ।
চরিত্রে দৃষ্টান্ত নহি, দেশে কি বিদেশে।
বুদ্ধি তবু নাহি পাকে, পাকে যদি কেশ
তপস্বী হব না আমি জীবনের শেষে!
ব্যৰ্থ বৈরাগ্য
এসেছে নূতন দিন, ধরি যোগীবেশ।
কালকের ফুল যত গিয়েছে শুকিয়ে,
কালকের ভুল যত গিয়েছে চুকিয়ে,
আগেকার জীবনের পালা হ’ল শেষ॥
ঝরা-ফুলে ভরা বিশ্ব, গন্ধ নাহি লেশ।
জীবনের বেশিভাগ দিয়েছি ফুঁকিয়ে,
বাকিটুকু মৃত্যুপানে পড়েছে ঝুঁকিয়ে,
যে সুর বাজিত কানে, নাহি তার রেশ॥
জীবনের স্রোত চলে দক্ষিণবাহিনী।
উত্তরে পড়িয়া থাকে পূর্ব্বের কাহিনী॥
উপরে উঠিছে ভাসি নব ভয় আশা,
বিরাম মানে না স্রোত, বহে খরধার।
আবার ফেলিতে হবে জীবনের পাশা,—
খেলা নিয়ে কথা শুধু, মিছে জিত হার!
ভর্ত্তৃহরি
যোগী তুমি, ভোগী তুমি, তুমি রাজকবি।
দেখেছ কখনো বিশ্ব শুধু নারীময়,
আবার দেখেছ বিশ্ব শুধু ব্রহ্মময়,
সুবৰ্ণে গৈরিকে আঁকো সেই দুই ছবি॥
ক্ষণিকের জ্যোতিকণা জানো শশিরবি,
বিশ্বরূপে মুগ্ধ তবু, সৌন্দর্য্যে তন্ময়।
অসীম আঁধার-মগ্ন অনন্ত সময়
আত্মজ্যোতি-দীপালোকে শূন্য দেখ সবি॥
নাস্তিকের শিরোমণি, অস্তিকের রাজা!
তব ধৰ্ম্ম মনোরাজ্যে বহুরূপী সাজা॥
নাহি জান কারে বলে ভয় কিম্বা আশা।
ভুক্তি মুক্তি তোমা কাছে সমান অসার।
সত্য শুধু মানবের অনন্ত পিপাসা,—
রত্ন দিয়ে তাই গাঁথো বৈরাগ্যের হার!
ভাষ
পদধূলি দেহ মোরে, মহাকবি ভাষ!
ভারতের নাটকের আদিম আচার্য্য!
ধন্য হব তব কাব্য করি শিরোধাৰ্য্য,
পত্রে পত্রে স্ফুরে যার বালার্ক আভাস
শুদ্ধ স্বরে গেয়েছিলে প্রসন্ন বিভাস,
পরিষদ ছিল তব মহাপ্রাণ আর্য্য।
সে যুগের কবিমুখে ছিল না উচ্চার্য্য
বৃন্দাবনী প্রণয়ের গদগদ ভাষ॥
স্বাধ্যায়-পবিত্র তব শূর-মুখ-বাণী।
সরাগিণী অরোগিণী তব বীণাপাণি॥
তব কাব্য গৌরবের ধরে ইতিহাস।
তুমি জানো সমরস বীর ও করুণ।
সে শুধু কাতর, যার নয়নে বরুণ।
তোমার নাটকে তাই জ্বলে পরিহাস॥