পরিচয়
দেখেছি তোমায় কোন মাধবী পার্ব্বণে,
প্রকৃতির ঐশ্বৰ্য্যের সৌন্দর্য্যের সার!
এসেছিলে ধরে’ রূপ প্রতিমা ঊষার,
গন্ধর্ব্বশালায় কিম্বা আলেখ্য-ভবনে॥
মেঘাচ্ছন্ন কোন দূর অতীত শ্রাবণে,
এসেছিলে কাছে কিম্বা, করি অভিসার,
আঁধারের মাঝে করি রূপের প্রসার,
গগন-সীমান্তে কোন বিস্মৃত ভুবনে!
তোমা সনে ছিল জানি পূর্ব্ব-পরিচয়,—
মন কিন্তু যুগস্মৃতি করে না সঞ্চয়॥
ভাসিয়া চলেছি দোঁহে হাতে হাত ধরে’,
ছাড়াছাড়ি হবে কি গো, পাব যবে কূল?
অথবা মিলন হ’লে জীবনের পরে,
চিনিতে আবার হবে পরস্পরে ভুল ?
পাষাণী
কত না ক’রেছি আমি তোমায় আদর,
চঞ্চল হয়নি তব নয়ন-কুরঙ্গ।
সুবর্ণ কঠিন তব হৃদয়-নারঙ্গ,
খোলনি সরিয়ে কভু বুকের চাদর॥
যৌবনে আসেনি তব শ্রাবণ ভাদর,
ছাপিয়ে ওঠেনি বুকে বাসনা-তরঙ্গ।
মেঘ-রাগে বাঁধো নাই হৃদয়-সারঙ্গ,
তব মন নাহি জানে বিদ্যুৎ বাদর॥
তব প্রাণে ভালবাসা র’য়েছে ঘুমিয়ে,
জাগাতে পারিনি আমি হাজার চুমিয়ে!
বিরহে মিলনে কিম্বা হওনা কাতর,
তোমার অন্তরে নাই রক্ততপ্ত রতি।
দেবীর প্রতিমা তুমি, কেবল পাথর,—
মনো-দীপে এবে করি তোমার আরতি॥
পূরবী
সন্ধ্যার ছায়ায় লীন, মলিন পূরবী!
বিষাদ তোমার চোখে, অবসাদ প্রাণে।
মগ্ন তুমি হ’য়ে আছ সূৰ্য্যাস্তের ধ্যানে,
ধূম্ৰ তব কেশপাশে ধূপের সুরভি।
উদাসিনী তুমি, নও করুণ ভৈরবী,
উন্মনা তোমার গানে, মনে সন্ধ্যা আনে।
আঁখি খোঁজে শেষ আলো অস্তাচলপানে,
লেখে যথা চিত্রস্বর্ণে, হরফে আরবী,
সূৰ্য্য তার রূপকথা; পড়িতে না জানি,
নিশায় মিলিত দিবা স্বপ্ন হেন মানি।
শ্রান্তিভরা শান্তি আছে তব শ্লথ সুরে,
উদাসিনি! তব মন্ত্রে হ’য়েছি উদাস।
তোমার প্রণয়ী ছিল কবি নিশাপুরে,
হে পূরবী! কর মোরে তব সুরদাস॥
প্রতিমা
প্রতিমা গড়েছি আমি প্রাণপণ করে।
আঁধারে আবৃত কত খুঁজে গুপ্ত খণি,
এনেছি তারার মত জ্যোতিৰ্ম্ময় মণি,—
রত্ন দিয়ে দেবীমূৰ্ত্তি গড়িবার তরে।
স্ফটিকে গড়েছি অঙ্গ নিশিদিন ধরে,
পরায়েছি শ্যামশাটী মরকতে বুনি,
রক্তবিন্দু পার দুটি সুলোহিত চুনি
বিন্যস্ত করেছি আমি দেবীর অধরে॥
প্রজ্জ্বলিত ইন্দ্রনীলে খচিত নয়ন,
প্রান্তে লগ্ন প্রবালেতে গঠিত শ্রবণ,
মুকুতা-নিৰ্ম্মিত যুগ্ম ঘন-পীন-স্তন,
সুকঠিন পদ্মরাগে গঠিত চরণ।
অপূর্ব্ব সুন্দর মূৰ্ত্তি, কিন্তু অচেতন,—
না পারি পূজিতে কিম্বা দিতে বিসর্জ্জন!
প্রিয়া
কারো প্রিয়া সুললিত সারিগান গেয়ে,
—রক্তিম-কপোল ঊষা জাগে যবে হেসে,—
রূপোর ঢে’য়ের পরে তালে তালে ভেসে,
দক্ষিণ পবন সনে আসে তরী বেয়ে॥
কারো প্রিয়া মেঘসম চতুৰ্দ্দিক ছেয়ে,
অকালের প্রলয়ের অমানিশা বেশে,
দুরন্ত পবনে ক্ষিপ্ত ঘনকৃষ্ণ কেশে,
প্রচণ্ড ঝড়ের মত আসে বেগে ধেয়ে॥
তুমি প্রিয়ে এ হৃদয়ে পশি ধীরে ধীরে,
বহিছ প্রাণের মত প্রতি শিরে শিরে।
প্রচ্ছন্ন রূপেতে আছ আচ্ছন্ন করিয়া
আমার সকল অঙ্গ, সকল অন্তর।
সকল ইন্দ্রিয় মোর জ্যোতিতে ভরিয়া,
যোগাও প্রাণের মূলে রস নিরন্তর॥
ফুলের ঘুম
বরফ ঢাকিয়াছিল ধরণীর বুক
অখণ্ড শীতল শুভ্র চাদর পরিয়ে।
রাশি রাশি চন্দ্রালোক নিঃশব্দে ঝরিয়ে,
আপাণ্ডুর করে’ ছিল নীলিমার মুখ॥
সেদিন ছিল না ফুটে শিরীষ কিংশুক,
গিয়েছিল বর্ণ গন্ধ সকলি মরিয়ে।
তুষারের জটাভার শিরেতে ধরিয়ে
বৃক্ষলতা সমাধিস্থ ছিল হয়ে মূক॥
পাতার মৰ্ম্মর আর জল-কলরব,
হিমের শাসনে ছিল নিস্তব্ধ নীরব॥
পৃথিবীর বুক হতে তুষার সরিয়ে
সেদিন দেখিনি আমি, কোথায় গোপনে,
সুযুপ্ত ফুলেরা সবে নয়ন ভরিয়ে
রেখেছিল বসন্তের রক্তিম স্বপনে!
বন্ধুর প্রতি
বড় সাধ ছিল তব, করে ধরি’ বীণ,
বাজাতে অপূর্ব্ব রাগ যৌবনের সুরে,
মুমূর্ষু মুমুক্ষু সবে দিয়ে যমপুরে,
তব গীতমন্ত্রে ধরা করিতে নবীন!
কল্পনার ছিল তব চক্ষে দূরবীণ।
অসীম আকাশদেশে দূর হতে দূরে
খুঁজিতে কোথায় কোন্ নব জ্যোতি স্ফুরে,
যার আলো জয় করে অাঁধার প্রবীণ॥
আবিষ্কার কর নাই কোন নব তারা।
আজিও ধরণী ধরে পুরাণো চেহারা॥
আকাশেতে উড়েছিলে রঙীণ পতঙ্গ,
পূৰ্ব্বাহ্ণেই গেছে তব পাখা দু’টি ঝরে’,
সে পক্ষ ধূনন-ধ্বনি আজ গেছে মরে’—
মাটির বুকেতে সুখে শুয়ে আছে অঙ্গ!
বসন্তসেনা
তুমি নও রত্নাবলী, কিম্বা মালবিকা,
রাজোদ্যানে বৃন্তচ্যুত শুভ্ৰ শেফালিকা।
অনাঘ্ৰাত পুষ্প নও, আশ্রমবালিকা,—
বিলাসের পণ্য ছিলে, ফুলের মালিকা॥
রঙ্গালয় নয় তব পুষ্পের বাটিকা,
অভিনয় কর নাই প্রণয়-নাটিকা।
তব আলো ঘিরে ছিল পাপ-কুজ্ঝটিকা,—
ধরণী জেনেছ তুমি মৃৎ-শকটিকা!
নিষ্কণ্টক ফুলশরে হওনি ব্যথিতা।
বরেছিলে শরশয্যা, ধরায় পতিতা॥
কলঙ্কিত দেহে তব সাবিত্রীর মন
সারানিশি জেগেছিল, করিয়ে প্রতীক্ষা
বিশ্বজয়ী প্রণয়ের, প্রাণ যার পণ।—
তারি বলে সহ তুমি অগ্নির পরীক্ষা!
বাঙ্গলার যমুনা
তুমি নহ শ্যামা তন্বী বৃন্দাবন-পাশে,
তীরে যার সারি সারি কদম্ব বকুল,
কৃষ্ণ যেথা বেণুতানে মাতায় গোকুল,
নৃত্য করে লীলাভরে গোপীসনে রাসে॥
উজান বহ না তুমি ঢলিয়া বিলাসে,—
সুমুখে ছুটিয়া চল উদ্দাম ব্যাকুল,
মাটি নিয়ে খেলা কর, ভেঙ্গে দুটি কূল,
সীমায় আবদ্ধ নহ, পরশ’ আকাশে!
আরম্ভেতে ব্ৰহ্মপুত্র, শেষেতে যমুনা।
সৃষ্টি আর প্রলয়ের দেখাও নমুনা॥
অহৰ্নিশি ভাঙ্গাগড়া, এই তব রীতি,
মুক্তকণ্ঠে গাও তুমি জীবনের গান।
জগৎ গতির লালা, সৃষ্টিছাড়া স্থিতি।
বাঙ্গলার নদী তুমি, বাঙ্গলার প্রাণ!