কাঠ-মল্লিকা
তুমি নহ রক্তজবা অথবা পলাশ,
আগুন জ্বালিয়ে বন আলো করে যারা,
—যে দিব্য অনলে পুড়ে কাম অঙ্গহারা,
যে আলো ধরায় করে নকল-কৈলাস!
তুমি নহ মানবের নয়ন-বিলাস,
রতি-ভর তনু তব হিম-বিন্দু পারা,—
গন্ধ তব ভেদ করি শ্যামপত্র-কারা,
মুক্ত হ’য়ে ব্যক্ত করে মন-অভিলাষ॥
গুপ্ত হয়ে থাক তুমি বন-অন্তঃপুরে।
মায়া তব গন্ধরূপে ছড়াও সুদূরে॥
আকাশ দেখনি কভু সুনীল বিপুল,
ঘনচ্ছায় বনে আছ, নেত্ৰ নত করি।
খুঁজিনি তোমায় আমি গন্ধসূত্র ধরি,
তাই তুমি মোর চির আকাশের ফুল!
গজল
নয়ন-গোলাপ তব করিতে উজ্জ্বল,
বুলবুলের সুরে আজি বেঁধেছি সেতার।
গাহিব প্রেমের গান পারসী কেতার,
ফুলের মতন লঘু রঙিলা গজল!
যে সুর পশিয়া কানে চোখে আনে জল,
সে সুর বিবাদী জেনো মোর কবিতার।
মম গীতে নত তব চোখের পাতার
সীমান্তে রচিয়া দিব দু’ছত্র কাজল!
বাজিয়ে দেখেছি ঢের বীণ ও রবাব,
পাইনি সে সুরে তব প্রাণের জবাব॥
আজ তাই ছাড়ি যত ধ্রুপদ ধামার,
চুট্কিতে রাখি সব আশা ভালবাসা।
দরদ ঈষৎ আছে এ গীতে আমার,—
সুরে ভাবে মিল আছে, দুই ভাসা ভাসা!
গোলাপ
রূপে গন্ধে মানি তুমি জগতে অতুল,
পূজায় লাগে না কিন্তু, অনাৰ্য্য গোলাপ!
দেমাকে দেবতাসনে করোনা আলাপ,—
ফুলের নবাব তুমি, নবাবের ফুল!
ইরাণের ভগ্নোদ্যানে বসি বুলবুল,
স্মরিয়া স্মরিয়া তোমা করিছে বিলাপ।
তুমি কিন্তু রমণীর কেশের কলাপ
আলো করে’ বসো, কিম্বা কর্ণে হও দুল॥
সোহাগে গলিয়া তুমি হও বা আতর,
গুম্ফাসনে বসে’ কর বেগম কাতর!
বিলাসের অঙ্গ লাগি তুমি হও জল,
নারীর আদুরে ফুল, সৌখীন গোলাপ!
নবাবেরই ভোগ্য তব রূপগুণবল,
নবাবের যোগ্য তুমি হকিমী জোলাপ!
চোরকবি
জ্বলন্ত অঙ্গার, চোর! তোর প্রতি শ্লোক,
দেহ আর মন যাহে একত্র গলিয়া,
হয়েছে পুষ্পিত, রূপে মর্ত্ত্য উজলিয়া,—
কামনার অগ্নিবর্ণ রক্তাক্ত অশোক!
অশুভদৰ্শন যার কুহকী আলোক,
চিতাগ্নির শিখাসম হুতাশে জ্বলিয়া,
মরণের ধূম্রদেহ চরণে দলিয়া,
রক্তসন্ধ্যারূপে রাজে, ছেয়ে কাব্যলোক॥
সেই রক্তপুষ্পে করি শক্তি-আরাধনা,
করেছিলে মশানেতে নায়িকা-সাধনা।
দিয়েছিল দেখা বিশ্ব বিদ্যারূপ ধরি’,
কনকচম্পকদামে সৰ্ব্বাঙ্গ আবরি,
সুপ্তোত্থিতা, শিথিলাঙ্গী, বিলোলকবরী,
প্রমাদের রাশিসম অবিদ্যা-সুন্দরী!
জয়দেব
ললিত লবঙ্গলতা তুলায় পবনে।
বর্ণে গন্ধে মাখামাখি, বসন্তে অনঙ্গে।
নূপুর-ঝঙ্কারে আর গীতের তরঙ্গে,
ইন্দ্রিয় অবশ হয় তব কুঞ্জবনে॥
উন্মদ মদনরাগ জাগালে যৌবনে,
রতিমন্ত্র কবিগুরু দীক্ষা দিলে বঙ্গে।
রণক্ষত-চিহ্ণ তাই অবলার অঙ্গে,
পৌরুষের পরিচয় আশ্লেষে চুম্বনে॥
পাণির চাতুরী হল নীবীর মোচন।
বাণীর চাতুরী কান্ত কোমল বচন॥
আদিরসে দেশ ভাসে, অজয়ে জোয়ার!
ডাকো কল্কি, ম্লেচ্ছ আসে, করে করবাল,
ধূমকেতু-কেতু সম উজ্জ্বল করাল,
বঙ্গভূমি পদে দলে তুরুষ্ক সোয়ার!
তাজমহল
সাজাহাঁর শুভ্রকীৰ্ত্তি, অটল সুন্দর!
অক্ষুণ্ণ অজর দেহ মৰ্ম্মরে রচিত,
নীলা পান্না পোখ্রাজে অন্তর খচিত।
তুমি হাস, কোথা আজ দারা সেকন্দর?
সকলি সদর তব, নাহিক অন্দর,
ব্যক্ত রূপ স্তরে স্তরে রয়েছে সঞ্চিত।
প্রেমের রহস্যে কিন্তু একান্ত বঞ্চিত,
ছায়ামায়াশূন্য তব হৃদয়-কন্দর!
মুম্তাজ! তাজ নহে বেদনার মূৰ্ত্তি।
—শিল্প-সৃষ্টি-আনন্দের অকুষ্ঠিত স্ফূর্ত্তি॥
আঁখিতে সুর্ম্মা-রেখা, অধরে তাম্বূল,
হেনায় রঞ্জিত তব নখাগ্র রাতুল,
জরিতে জড়িত বেণী, রুমালে স্তাম্বূল,—
বাদ্শার ছিলে তুমি খেলার পুতুল!
ধরণী
কে বলে পৃথিবী এবে হয়েছে প্রাচীন?
আজিও বসন্তে এসে কোকিল পাপিয়া
মুক্তকণ্ঠে তারস্বরে ডাকে “পিয়া” “পিয়া”,—
বাৰ্দ্ধক্যের পক্ষে সেত নহে সমীচীন!
বাৰ্দ্ধক্যের স্বপ্ন দেখে যত অৰ্ব্বাচীন,
যৌবন যাহার রাখে ভয়েতে চাপিয়া।
হ্যা দেখ, প্রাণের টানে উঠেছে কাঁপিয়া,
চিরকেলে গুলিখোর পাণ্ডুবৰ্ণ চীন্!
আকাশে বিদ্যুৎ আজো খেলে তলোয়ার,
চাঁদের চুম্বনে ওঠে সাগরে জোয়ার।
পূৰ্ণিমা আজিও ঘুরে আসে পক্ষে পক্ষে,
আজিও প্রকৃতি আছে সবুজ, সৌখীন্,
নরনারী আজো ধরে পরস্পরে বক্ষে,—
অমানুষে পরে শুধু ডোর ও কৌপীন্!
ধুতুরার ফুল
ভাল আমি নাহি বাসি নামজাদা ফুল,—
নারীর আদর পেয়ে যারা হয় ধন্য,
ফুলের বাজারে যারা হইয়াছে পণ্য,
কবিরা যাদের নিয়ে করে হুলস্থূল।
বিলাসীর কিন্তু যারা অতি চক্ষুশূল,
রূপে গন্ধে ফুল মাঝে যাহারা নগণ্য,
বসন্ত কি কন্দর্পের যারা নয় সৈন্য,
যার দিকে কভু নাহি ঝোঁকে অলিকুল,—
আমি খুঁজি সেই ফুল, হইয়া বিহ্বল,
যাহার অন্তরে আছে গন্ধ-হলাহল।
নয়নের পাতে যার আছে ঘুমঘোর,
চির দিবাস্বপ্নে যারা আছে মশ্গুল।
তাদের নেশায় আমি হতে চাই ভোর,—
ভালবাসি তাই আমি ধুতুরার ফুল॥
পত্রলেখা
অষ্টাদশ বর্ষ দেশে অাছ পত্ৰলেখা!
শুক-মুখে শুনিয়াছি তোমার সন্দেশ।
তাম্বুল-করঙ্ক করে, রক্ত পট্টবেশ,
প্ৰগল্ভ বচন, রাজ-অন্তঃপুরে শেখা॥
কাব্য-রাজ্যে তব সনে নিমেষের দেখা।
সুবর্ণ-মেখলাস্পর্শী মুক্ত তব কেশ,—
অশ্বপৃষ্ঠে রাজপুত্র যায় দূর দেশ,
অঙ্কে তার আঁকা তুমি বিদ্যুতের রেখা!
চন্দ্রাপীড় মুগ্ধনেত্রে হেরে কাদম্বরী,—
রক্তাম্বরে রাখো তুমি হৃদয় সম্বরি॥
গিরি পুরী লঙ্ঘি, সিন্ধু কান্তার বিজন,
মনোরথে নীলাম্বরে ভ্ৰমি যবে একা,—
মম অঙ্কে এসে বস’, কবির সৃজন,
তাম্বূল-করঙ্ক করে তুমি পত্ৰলেখা!