- বইয়ের নামঃ সনেট-পঞ্চাশৎ
- লেখকের নামঃ প্রমথ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
BERNARD SHAW
সভ্যতার প্রিয়শত্রু, বার্ণার্ড্ শ,
সমাজের তুমি দেখ শৃঙ্খল আচার,
শিকল-বিকল-মন মানুষ নাচার,
তব শাস্ত্র শুনে তাই তারা হয় থ!
মানুষেতে ভালবাসে হ য ব র ল,
তারি লাগি সয় তারা শত অত্যাচার।
স্পষ্ট বাক্যে প্রাণ পায়, যে করে বিচার,—
অন্যের পায়ের নীচে পড়ে’ যায় দ!
মানবের দুঃখে মনে অশ্রুজলে ভাসো,—
অপরে বোঝে না, তাই নাটকেতে হাসো॥
হয় মোরা মিছে খেটে হই গলদ্ঘর্ম্ম,
নয় থাকি বসে, রাখি করেতে চিবুক।
এ জাতে শেখাতে পারি জীবনের মৰ্ম্ম,
হাতে যদি পাই আমি তোমার চাবুক
অন্বেষণ
আজিও জানিনে আমি হেথায় কি চাই!
কখনো রূপেতে খুঁজি নয়ন উৎসব,
পিপাসা মিটাতে চাই ফুলের আসব,
কভু বসি যোগাসনে, অঙ্গে মেখে ছাই॥
কখনো বিজ্ঞানে করি প্রকৃতি যাচাই,
খুঁজি তারে যার গর্ভে জগৎ প্রসব,
পূজা করি নির্ব্বিচারে শিব কি কেশব,—
আজিও জানিনে আমি তাহে কিবা পাই॥
রূপের মাঝারে চাহি অরূপ দর্শন।
অঙ্গের মাঝারে মাগি অনঙ্গস্পর্শন॥
খোঁজা জানি নষ্ট করা সময় বৃথায়,—
দূর তবে কাছে আসে, কাছে যবে দূর।
বিশ্রাম পায় না মন পরের কথায়,
অবিশ্রান্ত খুঁজি তাই অনাহত-সুর॥
অপরাহ্ন
গোলাপ, গোলাপ, শুধু গোলাপের রাশি!
গোলাপের রং ছিল অনন্ত আকাশে,
গোলাপের গন্ধ ছিল ধরাতে বাতাসে,
নারীর অধরে ছিল গোলাপের হাসি॥
রং এবে গেছে জ্বলে’, গন্ধ হ’ল বাসি।
শুখানো পাতার রাশি ওড়ে চারিপাশে,
বসন্ত নিদাঘে পুড়ে ছাই হ’য়ে আসে,
পৃথিবীতে মনে হয় হয়েছি প্রবাসী॥
অলক্ষিতে খসে’ গেছে মায়া-রত্নঠুলি।
এ বিশ্ব মাটির গড়া, দেখি চক্ষু খুলি॥
আশার গোলাপী নেশা গিয়াছে ছুটিয়া,
যে নেত্রে আদর ছিল, হেরি অবহেলা।
যৌবনের স্বর্ণপুরী গিয়াছে টুটিয়া,—
মহাশূন্য মাঝে আজি করি ধূলাখেলা॥
আত্মকথা
কবিতা আমার জানি, যেমন শঙ্কুর,
দু’দিনে সবাই যাবে বেবাক্ ভুলিয়ে!
কল্পনা রাখিনে আমি আকাশে তুলিয়ে,—
নহি কবি ধূমপায়ী, নলে ত্ৰিবঙ্কুর॥
হৃদয়ে জন্মিলে মোর ভাবের অঙ্কুর,
ওঠে না তাহার ফুল শূন্যেতে দুলিয়ে।
প্রিয়া মোর নারী শুধু, থাকেনা ঝুলিয়ে,
স্বৰ্গ-মর্ত্ত্য-মাঝখানে, মত ত্রিশঙ্কুর!
নাহি জানি অশরীরী মনের স্পন্দন,—
আমার হৃদয় যাচে বাহুর বন্ধন॥
কবিতার যত সব লাল-নীল ফুল,
মনের আকাশে আমি সযত্নে ফোটাই,
তাদের সবারি বদ্ধ পৃথিবীতে মূল,—
মনোঘুড়ি বুঁদ হ’লে ছাড়িনে লাটাই!
আত্মপ্রকাশ
প্রকৃতিরই অংশে গড়া আমাদের মন।
বিশ্বছবি দেখি স্পষ্ট রহিয়াছে আঁকা,
বিশ্বের হৃদয় কিন্তু বিশ্বদেহে ঢাকা,
আভাসে প্রকাশ তার, আসল গোপন॥
সবারই অন্তরে আছে গুপ্ত নিকেতন,
মনোপাখী সুপ্ত যাহে, গুটাইয়া পাখা।
সে নিদ্রা যোগীরা জানে পূর্ণ জেগে থাকা,—
খুলে বলা বৃথা চেষ্টা তাহার স্বপন॥
অন্তরের রহস্যের সঠিক বারতা
কথায় প্রকাশ পায়, এটি মিছে কথা॥
ভাষায় যা’-কিছু ধরি, উপরেই ভাসে,
স্বেচ্ছায় ক’রেছে যাহা আলোক বরণ।
সত্য কিন্তু তারি নীচে মুখ ঢেকে হাসে,—
কভু নাহি দেখা দেয় বিনা আবরণ॥
উপদেশ
প্রিয় কবি হ’তে চাও, লেখো ভালবাসা,
যা’ পড়ে’ গলিয়া যাবে পাঠকের মন।
তার লাগি চাই কিন্তু দু’টি আয়োজন,—
জোর-করা ভাব, আর ধার-করা ভাষা!
বড় কবি কিম্বা হ’তে যদি তব আশা,
ভাবুক বলিবে তোমা জন-সাধারণ,
শেখো যদি সমাজের, করি প্রাণপণ,—
দরকারি ভাব, আর সরকারি ভাষা!
যত যাবে মাটি আর খাঁটিকে ছাড়িয়ে,
শূন্যে শূন্যে মূল্য তব যাইবে বাড়িয়ে॥
কবিতার জন্মস্থান কল্পনার দেশ,
সে দেশ জানেনা কিন্তু মোদের ভূগোল,—
সত্যের সেখানে নেই কোন গণ্ডগোল,
দেহ নেই সেই দেশে, শুধু আছে বেশ!
একদিন
একদিন একা বসি, শিরে রাখি কর,
একমনে করি যবে কবিতা বয়ন,
শব্দের কুসুম করি স্মৃতিতে চয়ন,—
সহসা ফুলের গন্ধে ভরে’ গেল ঘর।
তখন ছিল না কিছু ইন্দ্রিয়গোচর,
সুপ্ত ভাব, ত্যজি মোর হৃদয়-শয়ন,
উঠেছিল সেই ক্ষণে মেলিয়া নয়ন,—
ফুলের নিঃশ্বাস প’ল চুলের উপর॥
লিখিয়াছি সবে যবে দুই চার ছত্র,
নীলাব্জ আভায় হ’ল সুরঞ্জিত পত্র।
শেষে যেই মিলে গেল অন্তিম চরণ,
অধরে মিলিল এসে ফুলের অধর,
চোখেতে ফুলের হেরি রক্তিমবরণ,
কাণে শুনি প্রিয়া-কণ্ঠ-গলিত আদর!
করবী
সুপ্ত গন্ধ, গুপ্ত বর্ণ তোমার, করবি!
শক্তি-বীজ-মন্ত্র আমি দিয়া তব কানে,
সৌরভ জাগাতে চাহি প্রণয়ের টানে,
গৌরবে তোমায় করি ফুলের ভারবি!
তরুণ অরুণ রাগে রঞ্জিত ভৈরবী,
জীবনের পূর্ব্বরাগ আছে তার গানে।
সেই রাগ পূর্ণ হয় সারঙ্গের তানে,
আলিঙ্গন করে যবে মধ্যাহ্নের রবি॥
পূর্ণস্নেহে জ্বলে যবে জীবনের শিখা,
গাঢ় হ’য়ে ওঠে তবে, ছিল যাহা ফিকা॥
কত বর্ণ, কত গন্ধ অন্তঃপুরবাসী,
সুষুপ্ত রয়েছে আজি কুসুম-শয়নে।
জাগাতে তাদের নিত্য আমি ভালবাসি,
তন্দ্রাসুখে আছে যারা মুদিয়া নয়নে॥
কাঁঠালী চাঁপা
গড়নে গহনা বটে, রঙেতে সবুজ,—
ফুলের সবর্ণ নহ, বর্ণচোরা চাঁপা!
বৃথা তব গন্ধভারে গর্ব্বভরে কাঁপা,
ফিরেও চাহে না তোমা নয়ন অবুঝ॥
নেত্রধৰ্ম্ম খুঁজে ফেরা গোলাপ, অম্বুজ।
উপেক্ষিতা আছ তুমি, হয়ে পাতা-চাপা।
তোমার কাঁঠালী গন্ধ নাহি রহে ছাপা,—
ছুটে আসে, ভেদ করি পাতার গম্বুজ॥
ঠিক ক’রে হও নাই পাতা কিম্বা ফুল,—
দু’মনা করাই তব দুৰ্গতির মূল!
পত্রের নিয়েছ বর্ণ, ফল হতে গন্ধ,
আকৃতি ফুলের কাছে করিয়াছ ধার,
সৰ্ব্বধৰ্ম্মসমন্বয়-লোভে হ’য়ে অন্ধ,—
স্বধৰ্ম্ম হারিয়ে হ’লে সৰ্ব্বজাতি বার!