Site icon BnBoi.Com

হে সময় অশ্বারোহী হও – পূর্ণেন্দু পত্রী

হে সময় অশ্বারোহী হও - পূর্ণেন্দু পত্রী

আছি

সুখে আছি, দুখে আছি, নিজস্ব বুদবুদে ডুবে আছি
পোয়াতি নারীর মতো গর্তে বহু স্বপনের ভ্রুণ নিয়ে আছি
সধবার নিরস্তর ভয় পাছে মুছে যায় সিঁথি-শুকজতারা
সে রকমই ভয়ে-ভয়ে ঘাসের ভিতরে পোকা-মাকড়ের সঙ্গী হয়ে আছি।
পাখিরা রয়েছে সঙ্গে, রুমালের পাড়ে
লাল সুতো, নীল সুতো, সদীর বাঁশীর গান তারা বুনে দেয়।
জঙ্গলও রয়েছে সঙ্গে, এক-শৃঙ্গ গণ্ডারও রয়েছে
বাঘের নখের দাগ, আঠারো ঘায়ের রক্তপুঁজ, সে-সবও রয়েছে।
হাঙরের করাতের দাঁতে হাসি লেগে আছে, এই দৃশ্য দেখে
অপমানিতের মতো নুয়ে আছে বৃদ্ধ বৃক্ষগুলি ।
আকাশের রুখু চুলে উকুনের মতো ঘোরে দুর্দিনের মেঘ
চামচিকের রক্ত নখে হাওয়ারা হয়েছে কালো ভুত।

তবু

কাঁঠালপাতার থেকে নেমে এসে জ্যোৎস্না মুখে তুলে ধরে বাটি-ভরা দুধ।

দিনের পঞ্চান্ন ভাগ তুচ্ছতার ধুলো মেখে আছি
পুতুলনাচের সুতো নর্বাঙ্গের পেরেকে জড়ানো।
কিন্তু যেই ফিরে আসি নিজ ঘরে, নিজস্ব বুদবুদে
মাথায় মুকুট পরে জেগে ওঠে গোলাপের বনে জাহাঙ্গীর
আতর গন্ধের ঘ্রাণ নিয়ে আসে নরজাহান চোখের রেকাবে।
ফৈয়াজ খাঁ-এর মতো গলা খুলে সারা দিনমান
কে যেন শুনিয়ে যায় মালকোষে পৃথিবীর, এশিয়ার, এই কলকাতার
যাবতীয় বন্দীশালা ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্ ভেঙে ভেঙে হবে খান্ খান্ ।

শীত-রাতে দুঃসময়ে পেয়ে গেছি এখনও কল্কাপপেড়ে শাল
আত্মার ভিতরে এক সূর্য থাকে, তারই রঙে লাল।
সেই শাল গায়ে দিয়ে আছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ

সূর্য নামের ছোকরাটা বড় জ্বলতে শিখেছে, তাই না হে?
আজ্ঞ হ্যাঁ।
গনগণে চোখ, জ্বলজ্বলে ভূরু, উরু ভেঙে দিলে কেমন হয়?
আজ্ঞ হ্যাঁ।
আজকাল আর চাঁদে সে রকম রাবড়ির মতো জেল্লা নেই
আজ্ঞে হ্যাঁ।
টুনি বালবদের ফোলাপে ফাঁপালে প্রতিভা ছড়াবে হাজার গুণ।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
নিজের লালার সরু সুতোর দিয়ে বেনারসী বোনে মাকড়সা।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমারও তেমনি, থুতু ছিটোলেই হীরে-জহরত আকাশময়।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কানেই শুনেছো, দেখনি কখনো ঈশ্বর নামে লোকটাকে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কাল এসেছিলো, বেচতে চাইছে ধড়া-চূড়োসহ সিংহাসন।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ঈশ্বর হয়ে প্রথমেই আমি বুনবো কঠিন শৃঙ্খলা।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
পাহাড়গুলোকে পিঁপড়ে বানাবো, সব গাছ হবে ভেরেন্ডা।
আজ্ঞে হ্যাঁ।

আশ্বর্য

কোমরে লাল ঘুনসি বাঁধা
পোড়া বিড়ির টুকরোর মতো
আমরা চতুর্দিকে ছড়ানো।
কেউ মুথোঘাসের তলপেটে
কেউ বুড়ো বটের গোড়ালির আড়ালে
কেউ নর্দমার এটোঁ শালপাতার ডিঙিতে।
নেশাখোরের মতো হাওয়া
একবার দৌড়চ্ছে ডাইনে, একবার বাঁয়ে।
এক জায়গায় জুটবো
মন-খোলা জোৎস্নায় আড্ডা জমবে সারারাত
হৈ হৈ গল্পের মাদল বাজিয়ে,
তালা খুলব, যে যার খুপরির
পাটে পাটে ভাঁজ করা স্মৃতি, জামা-পাজামা
কোনোটায় বেনারসীর জরির নকশা
কোনোটায় রক্তপুজের ছেটে,
ভালোবাসা ন্যপথলিনের গন্ধের মতো
জড়িয়ে থাকবে আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবী রুমালে
তার উপায় নেই।
সময়টা খারাপ।
আকাশের ময়লা মেঘে বাঘছালের ডোরা।
মেঘে একবার বাজে দুন্দুভি
আরেকবার তাসা-পার্টির ন্যাকরা।
গাছপালাও ছন্নছাড়া।
যেখানে শিরদাঁড়া সোজা করার, সেখানে দুলছে,
যেখানে যজ্ঞের মন্ত্র সেখানে ঢুলছে
ঘুমে।
বোধিদ্রুমে
ধরেছে হতবুদ্ধির ঘুণ।
মুখ চুন করে আকাশের বারান্দায় নক্ষত্রেরা দাঁড়িয়ে।
নাম ভাঁড়িয়ে
ছিচকে জোনাকীরাই মস্তানী করে গেল সারারাত।
সূর্য
নিজের আগুনে নিজে পুড়ছে।
এখনো তারই দিকে চোখ রেখে জলবার ইচ্ছে
খিল্ আঁটা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে,
এইটেই আশ্চর্য।

উৎকৃষ্ট মানুষ

উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি চেয়েছিলে
এই যে এঁকেছি।
এই তার রক্ত-নাড়ি, এই খুলি
এই তার হাড়
এই দেখ ফুসফুসের চতুদিকে পেরেক, আলপিন
সরু কাঁটাতার।
এইখানে আত্মা ছিল
গোল সূর্য, ভারমিলিয়ন
ভাঙা ফুলদানি ছিল এরই মধ্যে
ছিল পিকদানি
পিকদানির মধ্যে ছিল
পৃথিবীর কফ, থুতু, শ্লেষ্মা, শ্লেষ
অপমান, হত্যা ও মরণ।

উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি খুঁজেছিলে
এই যে এঁকেছি!
ক্ষতচিহ্নগুলি গুণে নাও।।

একটি উজ্জ্বল ষাঁড়

একটি উজ্জ্বল ষাঁড় লিফটে চেপে উর্ধ্বে উঠে যান,
তখনই বন্দনা গান গেয়ে ওঠে, একপাল কৃতার্থ ছাগল।
জুলিয়াস সীজারের মতো তিনি, মিশরের ফারাও এর মতো
যেন এই শতাব্দীর তরুণ-বয়সী এক নবতম আলোকজান্ডার
পাতলা ক্রীমের মতো বুদ্ধের মহন হাসি মুখে
চেঙ্গিস খানের মতো চোখে বহুদূর
স্বপ্নের রক্তাক্ত সিড়ি, যেন জেনে দিয়েছেন তিনি
ভূ-মধ্যসাগর এসে পায়ে পড়ে হবে পুষ্করিনী।

প্রভু! কোনো দৈববাণী দেবেন কি আজ?
কোনো ধন্য সার্কুলার? অথবা সুসমাচার টাইপরাইটারে?
বিশ্বস্ত বাদুড়বৃন্দ এইভাবে নিজেদের ল্যাজের চামরে
নিভৃতে আরতি করে যায়।

একটি উজ্জ্বল ষাঁড় মেহগনি কাছের মস্ত সিংহাসনে, একগুচ্ছ চাবি
খুলে যান সারি সারি প্রয়ার, ফাইল, খোপ-ঝোপ
যুদ্ধের ম্যাপের মতো দেগে যান রণক্ষেত্র আর আক্রমণ
তুরী-ভেরী জগঝম্প বাজে টেলিফোনে।

আমি চাই না লাল কালিদিয়ে কেউ কবিতা লিখুক।
আমি চাই না কারো ঘাড়ে আলোকশিখার মতো দর্পিত কেশর।
ধ্রুবতারা ভালোবেসে, ভালোবেসে বেহুলার ভেলা
গাছের শিকড় থেকে খোলা হাওয়া পেড়ে আনে যারা,
যাদের হৃৎপিণ্ড জুড়ে জেগে আছে সমুদ্রের শাঁখ
আমি চাই তারা সব ইদুরের গর্তে বসে খঞ্জনী বাজাক।
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় এইভাবে পেয়ে গেছে তুরুরে সবকটি তাস।
শুনেছি এবার তিনি নক্ষত্রমণ্ডলে
সত্তর বিঘের মতো জমি কিনে করবেন আলু-কুমড়ো পটলের চাষ।

একমুঠো জোনাকী

একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
একমুঠো জোনাকীর আলো পেয়ে
এক একটা যুবক হয়ে যাচ্ছে জলটুঙি পাহাড়
যুবতীরা সুবর্ণরেখা।
সাপুড়ের ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী
পুজো সংখ্যা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী।
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
ময়দানের মঞ্চে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে
জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল যেন কারা।
রবীন্দ্রসদনে তিরিশজন কবি তিরিশদিন ধরে আউড়ে গেল
একমুঠো জোনাকীর সঙ্গে তাদের ভাব-ভালোবাসা।
ইউনেসকোর গোল টেবিল ঘিরে বসে গেছে মহামান্যদের সভা
একমুঠো জোনাকীর আলোয়
আফ্রিকা থেকে আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত হোগলা বন আর ফাটা দেয়ালে
সাজিয়ে দেবে কোনারক কিংবা এথেন্সের ভাস্কর্য।
সাত শতাব্দীর অন্ধকার এইভাবে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজি দেখিয়ে চলেছে একমুঠো জোনাকীর আলোয়।

 এখনো

কাগজ পেলেই আঁকচারা কাটা অভ্যেস।
একবার আঁকছিলুম রাজবাড়ি।
আঁকতে আঁকতে হয়ে উঠলো আলকাতরা মাখা দৈত্য,
কাগজ থেকে লাফ দিয়ে উঠলো দশ আঙুলের থাবা
খাঁবো, খাঁবো, খাঁবো।
সেই থেকে আর রাজবাড়ি আঁকি না।
আঁকি রাজহাঁস, ময়ুর, জলের ঘূর্নি, আর সেই সব শিকড়
যা ডুবে আছে আকুলি-বিকুলি তৃষ্ণার ভিতরে।
পদ্মপাতায় ডুমুরের গুছির মতো ফলে থাকে যে শিশির
আঁকতে যাই, পারি না।
অন্ধকারের খোঁপায় বাগান সাজিয়ে রাখে যেসব আলোর কুঁচি
আঁকতে যাই, পারি না।

প্রচণ্ড রাগে একদিন আকঁতে বসলুম ধ্বংসের ছবি
আঁকতে আঁকতে ফুটে উঠল আশ্চর্য এক নারী।
তখরও চোখ আঁকিনি, তবুও চন্দন গন্ধে হেসে।
তখনও হাত আঁকিনি, তবুও কপালের জচুল সরিয়ে বললে
শোনো
বলেই হারিয়ে গেল ধ্বংসের আড়ালে।
তাকে ধরবো, ছোঁবো, জড়াবো, নিংড়াবো বলে
কলকাতার ট্রামলাইন, মেটেবুরুজের বসি-
মুর্শিদাবাদের কবর, অন্ধ্রের ঝড়, রাজস্থানের বালি ডিঙিয়ে
ছুটে চলেছি। ছুটে চলেছি। ছুটে চলেছি।
এখনো।

 কবি

ওহে দেখতো দেখতো
লোকটা চলে যাওয়ার সময় কি রেখে গেল?
ভারী লুকনো স্বভাবের ছিল মানুষটা।
ঘাড় গুজে, হাঁটু ভেঙে, চোখ জ্বালিয়ে
বন-বাদাড়, নুড়ি পাথর, আগুন অন্ধকার, ঘেঁটে ঘেঁটে
কী সব কুড়িয়ে বেড়াত দিনরাত।
দেখতো কী রেখে গেল যাওয়ার সময়?
সিন্ধুকটা খোল।
ভিতরে কি?
আজ্ঞে পান্ডুলিপি।
ভল্টটা ভাঙো।
ভিতরে কি?
আজ্ঞে পান্ডুলিপি।

কে তোমাকে চেনে?

ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট ডিনার খাচ্ছ রোজ।
সে তোমাকে চেনে?
যে খাট-পালঙ্গে শুয়ে স্বপ্নে তুমি চাঁদ সদাগর
সে তোমাকে চেনে?
যে আয়নাকে শরীরের সব তিল, সর্বস্ব দেখালে
সে তোমাকে চেনে?
যেন মেয়ে-দেখা, এত বেছে ঐ পর্দা কিনেছিলে
ও তোমাকে চেনে?
এই কালো টেলিফোন, ওয়ার্ডরোব, লং প্লেয়িং, টিভি
এই সব থাক্-থাক্ বই, সোফা, নেপালী মুখোশ
কে তোমাকে চেনে?
একমাত্র কার্পেটের ধুলোটুকু, রোদটুকু ছাড়া
দরোজার জানালার ছেঁড়া-খোঁড়া আলোটুকু ছায়াটুকু ছাড়া
কে তোমাকে চেনে?

 কোনো কোনো যুবক যুবতী

একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীর মুখে
সেকালের মোমমাখা ঝাড়লন্ঠন
স্তম্ভ ও গম্বুজ দেখা যায়।
দেখে হিংসা জাগে।

মানুষ এখন যেন কোনো এক বড় উনোনের
ভাত-ডাল-তরকারির তলপেটে ডাইনীর চুলের
আগুনকে অহরহ জ্বালিয়ে রাখার
চেলা কাঠ, কাঠ-কয়লা-ঘুটে।

মানুষ এখন তার আগেকার মানুষ-জন্মের
কবচ, কুণ্ডল, হার, শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও মুকুট
বৃষের মতন কাঁধ, সিংহ-কটি, অশ্বের কদম
পিঠে তৃণ, চোখে অহংকার
সব ছুঁেড় ফেলে দিয়ে একটা গগলস্ পেয়ে খুশি।
প্লাসটিকের মানিব্যাগ, নাইলনের জামা পেয়ে খুশি।
বোবা টেলিফোন পুষে তরতাজা বিল পেয়ে খুশি।
চারকোণা সংসারের চতুর্দিকে গ্রীল এটেঁ খুশি।
বনহংসী উড়ে যায়, সে বাতাসে কাশের কথুক
এয়ারকুলারে সেই বাতাসের বাসী গন্ধ পেয়ে বড় খুশি।

একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীকে দেখে
অতীতের রাজশ্রীর, হর্ষবর্ষনের মতো লাগে।
দেখে হিংসা জাগে।

কয়েকটি জরুরী ঘোষণা

আগামী চোদ্দ বছর মহিষ কিংবা নেউল রঙের মেঘের মুখদর্শন করব না কেউ।
আগামী চোদ্দ বছর আমাদের কবিতা থেকে হিজড়ে-নাচন বৃষ্টির নির্বাসন।
স্বেচ্ছাচারী এবং হামলাবাজ হাওয়াকে চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছি আমি
আর পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় টেলিফোনে ট্রাঙ্কলে
রেডিওগ্রামে জানিয়ে দিয়েছি
সমস্ত বিক্ষুব্ধ জলস্রোত যেন মাটিতে নাক-খত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়
দুর্গত মানুষের কাদা-পায়ে।
প্রত্যেক নদীর বাঁধকে বলে দিয়েছি হতে হবে হিমালয়ের কাঁধ সমান
প্রত্যেকটা নদীতে হতে হবে পাড়াগার লাজুক বৌ
প্রত্যেকটা ব্যারেজকে জননীর গর্ভ।
ভবিষ্যতে আর কোনদিন যদি মানুষকে ভাসতে দেখি শিকড়হীন উলঙ্গ
আর কোনদিন যদি মানুষের সাজানো-নিকোনো স্বপ্নসাধের ভিতরে ঢুকে পড়ে
দুঃস্বপ্নের খল-খল হাসি, আঁকাবাঁকা সাপ, মরা কুকুরের কান্না আর ভাঙা শাঁখা
আর কোনদিন যদি মানুষের শ্রেষ্ঠতম সংলাপ হয়ে ওঠে হাহাকার
আর কোনদিন যদি মানুষের আলতা সিদুর পরা সতী-লক্ষ্মী গৃহস্থলিকে
হেলিকপ্টার থেকে মনে হয় ছেঁড়া-কাঁথা কানির টুকরো
আমি বাধ্য হবো সভ্যতার বিরুদ্ধে ফাঁসীর হুকুম দিতে।
যতদিন মানুষের গায়ে দুর্দিনের দুর্গন্ধ এবং নষ্ট জলরেখা
রোদের কামাই করা চলবে না একনিও।

মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি দেখে যেতে চাই।
সমস্ত পুরুষ সূর্যমুখী, নারীরা ঝুমকো জবা আর শিশুরা
কমলা রঙের বোঁটায় শাদা শিউলি।

গাছ অথবা সাপের গল্প

তোমাকে যেন কিসের গল্প বলবো বলেছিলাম?
গাছের, না মানুষের?
মানুষের, না সাপের?
ওঃ, হ্যাঁ মনে পড়েছে।
গাছের মতো একটা মানুষ।
আর সাপের মতো একটা নারী
কুয়াশা যেমন খামচা মেরে জড়িয়ে ধরে কখনো কখনো
দুধকুমারী আকাশকে
সাপটা তেমনি সাতপাকে জড়িয়ে ধরেছিল গাছটাকে।
আর গাছটাও বেহায়া।
লাজ-লজ্জা, লোক-লৌকিকতা ভুলে গিয়ে
নৌকা ডুবে যাচ্ছে, এখুনি ঝাঁপ দিতে হবে
নদীর নাইকুন্ডুতে,
এমনি ভাবেই সর্বস্ব ভাসিয়ে দিল সাপের হাতে।
আর তারপরেই ঘটল আজব কাণ্ডটা।
সাপের ছোবলে ছিল বিষ। নীল।
গাছের শিকড়ে ছিল তৃষ্ণা। লাল।
ছোবল খেতে খেতে ছোবল খেতে খেতে
নীলপদ্মে ভরে উঠল গাছ।
আর গাছের আলিঙ্গনে
গুড়ো হতে হতে গুড়ো হতে হতে
সেই শঙ্খচুড় সাপটা
আলতা-সিদুরে রাঙা বিয়ের কনে।
আর এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে
আকাশের আইবুড়ো নক্ষত্রগুলো
হেসে গলে গা ঢলাঢলি করে বলে উঠল
আজ সারা রাত জাগব ওদের বাসর।

জেনে রাখা ভালো

জলের মাছের মতো অনায়াস হবে ভেবেছিলে
সব হাঁটাহাঁটি?
ভেবেছিলে ধোঁয়া, ধুলো, থুতু, কফ পেঁজা তুলো হয়ে
উড়ে যাবে অন্য দিকে, তোমাকে ছাড়িয়ে?
ভেবেছিলে পাট-ভাঙা জামায় লাগবে না
পেট্রোলের, পাঁঠা-কাটা রক্তের বা নর্দমার দাগ?
ভেবেছিলে টিকটিকির মতো রয়ে যাবে
আজীবন মসৃণ দেয়ালে?

সময়ের কারখানায় কেবল তোমারই জন্যে
তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সরু আলপিন
ব্লেড, ছুরি, ভোজালি, কাতান,
এইটুকু জেনে রাখা ভালো।

জ্বর

স্মৃতিতে সর্বাঙ্গ জ্বলে
একশ পাঁচ ডিগ্রী ঘোর জ্বর।
টালমাটাল ঝড়
ঘুষি মারে হাড়ে মাসে ব্রক্ষ্মতালু রক্তকণিকায়
যেন তাকে ছিড়েখুড়ে অন্য কিছু বানাবে এখুনি।
হঠাৎ হরিণ হয়ে হয়তো সে ছুটে যাবে বহুদূর বাঘ-ডোরা বনে
তুমুল আগুন জ্বেলে পলাশ যেখানে যজ্ঞ করে।
নিজের বিবিধ টুকরো জুড়ে জাড়ে হয়তো বা হলুদ শালিক
অর্জুন গাছের সাদা থামে
যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে সূর্যাস্ত যেখানে রোজ নামে
সেইখানে ঘরবাড়ি ভাড়া নিয়ে কিছুদিন থাকবে স্বাধীন
অথবা সে নিজেরই লালার
চমৎকার রাংতা দিয়ে গড়ে নেবে সাত-কুঠরি ঘর।
জ্বর
এইভাবে নখে চিরে করেছে উর্বর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে।
কলসী কলসী জল ঢালি সান্ত্বনার, সুবিবেচনার
কপালের জলপটি শীতের ভোরের মতো সারাক্ষণ ভিজে হয়ে থাকে
তবু জ্বর ছাড়েনাকো তাকে।
এক অগ্নিকুন্ডে থেকে আরেক আগুনে ঝাঁপ দিয়ে
ছাই মাখে, ভস্ম মাখে, চোখে আঁকে না-ঘুম-কাজল।
জ্বরে সে পাগল।

শিশুরা পায়েস ঘেঁটে গোলগাল কিসমিস পেয়ে গেলে যে রকম হাসে
সেরকমই দিগ্বীজয়ী হাসি তার দুটি পাখি-ঠোঁটে।
সে নাকি মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেছে বসন্তের সমস্ত কোকিল
গোপালপুরের সব রূপোলি ঝিনুক
পুরীর সমস্ত ঝাউবন।
সাঁওতাল পরগনা থেকে পেয়ে গেছে সব কটি নাচের মাদল।
আসলে এসব কিছু নয়
দুধের গাভীর মতো একটি নারীকে খুঁজে পেয়েছে সে কলকাতা থেকে
ছানা ওমাখন তাকে খেতে দেয় সেই রমনীটি
খেতে দেয় দু-বাটিকে ক্ষীর।
তারই গলকম্বলের স্বাদে গন্ধে এমন মাতাল
ভেবেছে পৃথিবী তার পকেটের তে-ভাঁজ রুমাল।

এই ভাবে জ্বর
নৌকো ভর্তি স্মৃতি সহ ভাসিয়ে দিয়েছে তাকে এই পৃথিবীর
ইট কাঠ বালি সুরকি পেরেকের ঢেউ-এর ওপর।

দেরাদুন এক্সপ্রেস

দেরাদুন এক্সপ্রেস পড়ি-মরি দৌড়ে ছুটে গেল।
কাকে ছুঁতে?
জ্বলজ্বলে যুবক সেজে কার কাছে গেল?
ডাকাতের মতো কালো অন্ধকারে, এই মাঝরাতে
কাকে খুলে দেবে বলে পরেছে আলোয়-গাঁথা হার?
চোখে তার জঙ্গলের খিদে-পাওয়া লাল চিতাবাঘ
এই বন্য থাবা দিয়ে কাকে সে জড়াবে?
প্রাগৈতিহাসিক কোনো স্মৃতির চন্দনগন্ধ মেখে
মহেনএজাদারোর বৃষ জেগে উঠে দিয়েছে হুঙ্কার
দেরাদুন এক্সপ্রেস সেইভাবে দৌড়ে চলে গেল।
কার সাথে কোন্‌খানে দেখা হবে তার?
সেখানে কী সবুজের ডোরাকাটা পাহাড়ের সার
কাশ্মীরী শালের মতো সামিয়ানা টাঙিয়ে রেখেছে?
বাসরঘরের ভিড়ে পান-খাওয়া পরিতৃপ্ত ঠোঁটের মতন
সেখানে কি বাগানের গায়ে-গায়ে সুখী হাওয়া বয়?
বানভট্ট যেরকম সুহাসিনী রূপসীর ঘ্রাণ পেয়েছিল
সেরকম কেউ
বনস্থলী, লতাগুল্ম, নুড়ি ওপাথর
সোনালী বালির রেখা, রাঙা ধুলো, ঝাউ, ঝরাপাতা
নদীর আয়না-জল, জড়ো করে, সব জুড়ে-জাড়ে
সেখানে কী তার জন্য ঘুমোবার বিছানার সুজনি বুনেছে?

পাখির নরম বুকে আকাঙ্কাকে জুড়োবার স্বাদ আছে জেনে
যেরকম ক্ষিপ্রতায় ব্যাধের চোখের কালো তীর ছুটে যায়
দেরাদুন এক্সপ্রেস সেইভাবে দৌড়ে চলে গেল।
কার কাছে গেল?

নেলকাটার

সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।

সাত বছর সাঁতার কাটিনি সমুদ্রের নীল শাড়ির আমিষ অন্ধকারে
দশ বছর আগে শেষ ছুয়েছি পাহাড়ের স্তনচূড়া
মাদল বাজিয়ে কতবার ডেকেছে হৈ-হল্লার জঙ্গল, যাইনি।
আলজিভে উপুড় করে দিয়েছে মাতাল-হওয়ার কলসী, খাইনি।
যাবার মধ্যে গত ডিসেম্বরে সাঁচী
হাজার বছর পরে আবার দেখা যক্ষিনীদের সঙ্গে, হাসি ঠাট্টা-গল্পো।
কিন্তু নেলকাটার তো তারা নেবেনা।

সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।

বেনারসী পরে মেধ নামবে ছাঁদনাতলায়
সর্বাঙ্গে আলোর গয়না,
অথচ আমার আলিঙ্গন করা বারণ।
ছুলেই তো রক্তের ফিনকি, করকরে ঘা।
যে শাঁখ বাজিয়ে কাল বলেছে-এসো
সে ঢাক বাজিয়ে আজ বলবে- যা।
আমাকে এবার খুঁজতে হবে একটা ন্যড়া মাথা নদী
তারই বালিতে বাঘছালের মতো বিছিয়ে দিতে হবে শুকনো স্মৃতি।
তারই উপরেই শোয়া-বসা, জপ-তপ, বাসন-কোসন, কাপড় কাচা
এবং নিজের নখে নিজেকে ছিড়তে বাঁচা।

সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।

প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে

সেই কবে বাল্যকালে বৃষ্টি হয়েছিল
সেই কবে বৃষ্টিজলে ভিজেছিল লাজুক কদম
সেই কবে কদমের ডালে এক পাখি বসেছিল
সেই পাখি বলেছিলপৃথিবীর ভিতরে আরেক
গর্ভকেশরের মতো গোপনীর পৃথিবী রয়েছে
সেই পৃথিবীর খোঁজে চাঁদ সদাগর
ঝড়ে-জলে ডুবে যাবে জেনেও নিজের নৌবহর
সমুদ্রে ভাসিয়েছিল, ঘর পোড়া আগুনের মতো সাদা ফেনা
সেই ফেনা পুষেছিল বড় বড় রাঘব বোয়াল
সেই সব বোয়ালের পেট চিরে পাওয়া গেল
মানুষের আংটি ভর্তি স্বপ্ন, সুখ, সোনার বিষাদ
সেই সব আংটি, স্বপ্ন, দুঃখ তছনছ করে
প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে।

পৃথিবীর অতীতের, আগামীকালের
অনেক অজ্ঞাতপ্রায় পান্ডুলিপি, স্থাপত্যের ভাঙা মন্দিরের
ভাস্কর্যের টুকরো-টাকরা
অনেক বিচিত্র কাঁথা, আজন্মের স্মৃতি দিয়ে বোনা
অনেক রঙীন পট, চালচিত্র, প্রতিমা, পুতুল, পোড়ামাটি
নিভৃতে, সাজানো আছে, এ সংবাদ শুনে
ছেচল্লিশ বছরের কোনো এক যুবকের পাঁজরের হাড় ফুটো করে
প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে।

প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে

ডালিম ফুলের লাল জার্সি পেয়ে গেছি
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে।
অনন্ত হালদার এসে বলে গেল তুমি নাকি এক তরফা আশী বছরের
ইজারা নিয়েছেঅ এই পৃথিবীর সব হাততালি।
ধনুস্টঙ্কারের মতো তুমি নাকি বেঁকে গেছ মালা পেয়ে, মালা পেয়ে পেয়ে?
অথচ জানো কাল তোমার ছায়াকে কারা পুড়িয়েছে তংসাবতী খালে।

আগামী বৈশাখে
সাত লক্ষ গোলাপের জনসভা ডেকেছে আমাকে
এবং সভার শেষে মশালের শোভাযাত্রা, বনে বনে ক্ষেপেছে পলাশ।
নক্ষত্রের কনফারেন্সে মেঘেরো মিছিল করে হেঁটেছিলো কাল সারারাত
প্রত্যেকের হাতে চিল জ্যোৎস্না কালিতে লেখা জ্বলজ্বলে পোস্টার-
সেই যুবকের হাতে তুলে দেবো এইবার পৃথিবীর ভার
ভালোবাসা পাবে বলে কলকাতার সব কাঁটাতার
ছিড়ে খুড়ে হেঁটেছে যে হিউয়েন সাঙের মতো একনিষ্ঠতায়
ডালিম ফুলের দিকে, যে ডালিম ফুল
ঘোরতর অন্ধকার প্রথম ভোরের মতো আবীরের আলো দিতে জানে।

ডালিম ফুলের লাল জার্সি পেয়ে গেছি।
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে।

বুকের মধ্যে বাহান্নটা আলমারি

বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ
সেই সব স্পর্ম, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।

যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধাকার খুপরীর থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
বুকের মধ্যে।

ভাঙাভাঙি

সে এসে সমস্ত ভেঙে দিয়ে গেল
বিকেল বেলায়।
ইটের পাঁজার মতো থরে থরে সাজানো সুখের
সাঁচীসত’প ভেঙে দিয়ে গেল।
বুকের নিভৃত কোণে স্থাপত্যের এবং সি’তির
কোনারক ভেঙে দিয়ে গেল।
চুরমার শব্দে পাখি উড়ে গেল বৃক্ষলতা ছেড়ে
নদী মুখ লুকোলো বালিতে।

এত ভাঙাভাঙি
এত টুকরো টুকরো কাঁচ, রক্তকণা
কুঁচি কুঁচি ছেঁড়া পাপড়ি, পেরেক, আলপিন
আমি একা কুড়োবো কি করে?

মাঝে মাঝে লোডশেডিং

মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।
আকাশে জ্বলুক শুধু ঈশ্বরের সাতকোটি চোখ
বাকী সব আলকাতরা মাখুক।
আমরা নিমগ্ন হয়ে নিজস্ব চশমায় আর দেখি না কিছুই
সকলে যা দেখে তাই দেখি।
আকাশের রঙ তাই হয়ে গেছে চিরকালে নীল।
বাতাস কি শাড়ি পরে কারো জানা নেই।

মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।
সাদা মোমবাতি জ্বেলে
তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেখি।
নারীকে বাহান্ন তীর্থ বলেছে শুনেছি এক কবি।
আমি তার গর্ভগৃহ, সরু সিড়ি, সোনার আসন
চন্দনবটিতে থাকে কতটা চন্দন
দেখে গুনে গুনে মেপে দেখে
তবেই পাতাবো মৌরীফুল।

ময়ূর দিয়েছে

একটি ময়ুর তার পেখমের সবটুকু অভ্র ও আবীর দিয়েছে আমাকে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের বিছানা বালিশে
মশারির টাঙানো খাটে, দরজায়, জানালায়, নীল আয়নায়
অতিথিশালার মতো যখন-তখন এসে ঘুমোবার, হেঁটে বেড়াবার
সুখটুকু, স্বাধীনতাটুকু
সোনার চাবির মতো হাতে তুলে দিয়েছে স্বেচ্ছায়।
এটোঁ কলাপাতা ঘেঁটে অকস্মাৎ জাফরাণের ঘ্রাণ পেয়ে গেলে
ভিখারীরা যে রকম পরিতৃপ্ত হয়,
সে রকমই সুখ পেয়ে হাঁসের মতন ডুবে আছি
হিমে-রোদে, জলে স্থলে, জয়ে পরাজয়ে।
মনে হয় নিমন্ত্রণ পেয়ে গেছি নক্ষত্রলোকের।
কখন অজ্ঞাতসারে পকেটে কে পুরে দিয়ে গেছে ভিসা পাসপোর্ট
সব উড়োজাহাজের এয়ারপোর্টের
সমুদ্রের কিনারের সব কটি উচু মিনারের।
রেশমের, পশমের, মখমলের মতো শান্তি সঙ্গী হয়ে আছে।

একটি ময়ূর তার হৃদয়ের অপর্যাপ্ত অভ্র ও আবীরে
আমার গায়ের আঁশ, ক্ষয়, ক্ষতি, ক্ষত, অক্ষমতা
সব কিছু রাঙিয়ে দিয়েছে।

যোগো

জলেও কি ট্রাম-বাস চলে?
জলেও কি আছে ছাপাখানা?
২৫শে বৈশাখ এলে জলের ভিতরে মাছ, নক্ষত্রের ঝাঁক
তারাও কি কবিতার খাতা খুলে বসে?
যোগো,
জলের ভিতরে গিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?
নিজের খাটের চেয়ে শ্যাওলার বিছানা কি অধিক নরম?
তুই কি কলম ফেলে কেবল জলের ঢেউ দিয়ে
কবিতার ভূল-ভাল, পৃথিবীর ভূল-ভাল প্রুফ কেটে-কুটে
সারারাত জেগেছিলি জলে?
যোগো,
জলের ভিতরে দিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?

সরোদ বাজাতে জানলে

আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম তিলক কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মতো বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতর দেয়ালে
কিছু কিচু অভিমান
ইমনকল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভালো হতো।
পুরুষ কিভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।

কার্পেটে সাজানো প্রিয় অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকাডুবি, ভেসে যায় বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমিকের সপ্তডিঙা ডুবেছে যেখানে
সেখানে নারীর মতো পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জল তার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মতো নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার ছোবলে
সব কিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের ভরে দেয়
বাসি হয়ে যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ, প্রকাশ্য উদ্যন।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরে দোরে চাঁপা এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম?

সরোদ কাজাতে জানলে বড় ভালো হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সেই শুধু জানে।

সেই সবও তুমি

তোমাকেই দৃশ্য মনে হয়।
তোমার ভিতরে সব দৃশ্য ঢুকে গেছে।
কাচের আলমারি যেন, থাকে থাকে, পরতে পরতে
শরতের, হেমন্তের, বসন্তের শাড়ি গয়না দুল,
নদীর নবীন বাঁকা, বৃষ্টির নুপুর, জল, জলদ উদ্ভিদ।

সাঁচীস্তুপে, কোনারকে যায় যারা, গিয়ে ফিরে আসে
দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে ক্ষীর করা স্বাদ জিভে নিয়ে
তোমার ভিতরে সেই ভাস্কর্যেরও লাবণ্য রয়েছে।
কোন্‌খানে আছে?
চুলে না গ্রীবায়, নাকি স্তনে?

হাজারিবাগের গাঢ় জঙ্গলের গন্ধ পাই তোমার জঙ্ঘায়।
ভয়াবহ খাদ থেকে নাচের মাদল, বাঁশী ডাকে।
বহুদূর ভেসে যেতে যতখানি ঝর্নাজল লাগে
তাও আছে, কোনখানে আছে?
চোখে, না চিবুকে?

দুমকায় তোমারই মতো একটি পাহাড়ী টিলা
মেঘের আয়নায় মুখ রেখে
খোঁপায় গুজছিল লাল গোধূলির ফুল।
তুমি কালএমন তাকালে
মনে হলো বীরভুমের দিগন্তের দাউ দাউ পলাশ।
জয়পুরের জালি কাটা ঝুল-বারান্দার মতো সমৃদ্ধ খিলান,
তাও আছে। কোন্‌খানে আছে?
ভূরুতে, না ঠোঁটে?

জলপাইগুড়ির কোনো ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙঘার
যতটুকু আলো, ওড়না, নীলরশ্মি
সেই সবও তুমি।

স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই

তুমি বললে, রৌদ্র যাও, রৌদ্রে তো গেলাম
তুমি বললে, অগ্নিকুণ্ড জ্বালো, জ্বালালাম।
সমস্ত জমানো সুখ-তুমি বললে, বেচে দেওয়া ভালো
ডেকেছি নীলাম।
তবু আমি একা।
আমাকে করেছ তুমি একা।
একাকিত্বটুকুতেও ভেঙে চুরে শত টুকরো করে
বীজ বপনের মতো ছড়িয়ে দিয়েছ জলে-স্থলে।
তুমি বলেছিলে বলে সাজসজ্জা ছেড়েছি, ছুঁড়েছি।
যে অরণ্য দেখিয়েছ, তারই ডাল কেটেছি, খুঁড়েছি।
যখনই পেতেছ হাত দিয়েছি উপুড় করে প্রাণ
তবু আমি একা।
তবুও আমার কেউ নও তুমি
আমিও তোমার কেউ নই।
আমাদের অভ্যন্তরে স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই।

 হালুম

মাথায় মুকুটটা পরিয়ে দিতেই রাজা হয়ে গেলেন তিনি।
আর সিংহাসনে পাছা রেখেই হাঁক পাড়লেন
হালুম।
অমনি মন্ত্রীরা ছুটলো ঘুরঘুট্টি বনে হরিণের মাংস সেকতে
সেনাপতিরা ছুটলো খলখলে সমুদ্রে ফিস-ফ্রাইয়ের খোঁজে
কোতোয়ালরা ছুটলো হাটে-বাজারে যেখান থেকে যা আনা যায় উপড়ে
বরকন্দাজেরা ক্ষেত খামার ল্ড ভণ্ড করে বানালো ফ্রুটল্যলাড।
রাজা সরলেন ব্রেক ফাস্ট।
তারপরেই সিং-দুয়ারে বেজে উঠলো সাত-মণ সোনার ঘন্টা।
এবার রাজদরবার।
আসমুদ্র-হিমাচরের ন্যাংটো, আধ-ন্যাংটো জন্তু-জানোয়ারের ঝাঁক
পিলপিলিয়ে জড়ো হল রাজ-চত্বরে।
মন্ত্রী জানালো, প্রভু!
জনতা হাজির। ওরা প্রসাদ পেতে চায় আপনার অমৃত ভাষণের।
অমনি উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে, ঈশানে, নৈঋতে,
গাছে, পাতায়, শিশিরে, শ্মশানে, ধুলোয়, ধোয়ায়, কুয়াশায়
আকাশে, বাতাসে, হাড়ে, মাসে, পেটে, পাঁজরে
গর্জন করে উঠলো, সাড়ে সাতমো অ্যামপ্লিফায়ার
-হালুম।

হে সময়, অশ্বারোহী হও

বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।

মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লেকা্যাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।

প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।

হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।

Exit mobile version