প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে
সেই কবে বাল্যকালে বৃষ্টি হয়েছিল
সেই কবে বৃষ্টিজলে ভিজেছিল লাজুক কদম
সেই কবে কদমের ডালে এক পাখি বসেছিল
সেই পাখি বলেছিলপৃথিবীর ভিতরে আরেক
গর্ভকেশরের মতো গোপনীর পৃথিবী রয়েছে
সেই পৃথিবীর খোঁজে চাঁদ সদাগর
ঝড়ে-জলে ডুবে যাবে জেনেও নিজের নৌবহর
সমুদ্রে ভাসিয়েছিল, ঘর পোড়া আগুনের মতো সাদা ফেনা
সেই ফেনা পুষেছিল বড় বড় রাঘব বোয়াল
সেই সব বোয়ালের পেট চিরে পাওয়া গেল
মানুষের আংটি ভর্তি স্বপ্ন, সুখ, সোনার বিষাদ
সেই সব আংটি, স্বপ্ন, দুঃখ তছনছ করে
প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে।
পৃথিবীর অতীতের, আগামীকালের
অনেক অজ্ঞাতপ্রায় পান্ডুলিপি, স্থাপত্যের ভাঙা মন্দিরের
ভাস্কর্যের টুকরো-টাকরা
অনেক বিচিত্র কাঁথা, আজন্মের স্মৃতি দিয়ে বোনা
অনেক রঙীন পট, চালচিত্র, প্রতিমা, পুতুল, পোড়ামাটি
নিভৃতে, সাজানো আছে, এ সংবাদ শুনে
ছেচল্লিশ বছরের কোনো এক যুবকের পাঁজরের হাড় ফুটো করে
প্রজাপতি ঢুকেছে ভিতরে।
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে
ডালিম ফুলের লাল জার্সি পেয়ে গেছি
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে।
অনন্ত হালদার এসে বলে গেল তুমি নাকি এক তরফা আশী বছরের
ইজারা নিয়েছেঅ এই পৃথিবীর সব হাততালি।
ধনুস্টঙ্কারের মতো তুমি নাকি বেঁকে গেছ মালা পেয়ে, মালা পেয়ে পেয়ে?
অথচ জানো কাল তোমার ছায়াকে কারা পুড়িয়েছে তংসাবতী খালে।
আগামী বৈশাখে
সাত লক্ষ গোলাপের জনসভা ডেকেছে আমাকে
এবং সভার শেষে মশালের শোভাযাত্রা, বনে বনে ক্ষেপেছে পলাশ।
নক্ষত্রের কনফারেন্সে মেঘেরো মিছিল করে হেঁটেছিলো কাল সারারাত
প্রত্যেকের হাতে চিল জ্যোৎস্না কালিতে লেখা জ্বলজ্বলে পোস্টার-
সেই যুবকের হাতে তুলে দেবো এইবার পৃথিবীর ভার
ভালোবাসা পাবে বলে কলকাতার সব কাঁটাতার
ছিড়ে খুড়ে হেঁটেছে যে হিউয়েন সাঙের মতো একনিষ্ঠতায়
ডালিম ফুলের দিকে, যে ডালিম ফুল
ঘোরতর অন্ধকার প্রথম ভোরের মতো আবীরের আলো দিতে জানে।
ডালিম ফুলের লাল জার্সি পেয়ে গেছি।
প্রতিদ্বন্দ্বী! এসো যুদ্ধ হবে।
বুকের মধ্যে বাহান্নটা আলমারি
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ
সেই সব স্পর্ম, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধাকার খুপরীর থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
বুকের মধ্যে।
ভাঙাভাঙি
সে এসে সমস্ত ভেঙে দিয়ে গেল
বিকেল বেলায়।
ইটের পাঁজার মতো থরে থরে সাজানো সুখের
সাঁচীসত’প ভেঙে দিয়ে গেল।
বুকের নিভৃত কোণে স্থাপত্যের এবং সি’তির
কোনারক ভেঙে দিয়ে গেল।
চুরমার শব্দে পাখি উড়ে গেল বৃক্ষলতা ছেড়ে
নদী মুখ লুকোলো বালিতে।
এত ভাঙাভাঙি
এত টুকরো টুকরো কাঁচ, রক্তকণা
কুঁচি কুঁচি ছেঁড়া পাপড়ি, পেরেক, আলপিন
আমি একা কুড়োবো কি করে?
মাঝে মাঝে লোডশেডিং
মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।
আকাশে জ্বলুক শুধু ঈশ্বরের সাতকোটি চোখ
বাকী সব আলকাতরা মাখুক।
আমরা নিমগ্ন হয়ে নিজস্ব চশমায় আর দেখি না কিছুই
সকলে যা দেখে তাই দেখি।
আকাশের রঙ তাই হয়ে গেছে চিরকালে নীল।
বাতাস কি শাড়ি পরে কারো জানা নেই।
মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।
সাদা মোমবাতি জ্বেলে
তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেখি।
নারীকে বাহান্ন তীর্থ বলেছে শুনেছি এক কবি।
আমি তার গর্ভগৃহ, সরু সিড়ি, সোনার আসন
চন্দনবটিতে থাকে কতটা চন্দন
দেখে গুনে গুনে মেপে দেখে
তবেই পাতাবো মৌরীফুল।
ময়ূর দিয়েছে
একটি ময়ুর তার পেখমের সবটুকু অভ্র ও আবীর দিয়েছে আমাকে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের বিছানা বালিশে
মশারির টাঙানো খাটে, দরজায়, জানালায়, নীল আয়নায়
অতিথিশালার মতো যখন-তখন এসে ঘুমোবার, হেঁটে বেড়াবার
সুখটুকু, স্বাধীনতাটুকু
সোনার চাবির মতো হাতে তুলে দিয়েছে স্বেচ্ছায়।
এটোঁ কলাপাতা ঘেঁটে অকস্মাৎ জাফরাণের ঘ্রাণ পেয়ে গেলে
ভিখারীরা যে রকম পরিতৃপ্ত হয়,
সে রকমই সুখ পেয়ে হাঁসের মতন ডুবে আছি
হিমে-রোদে, জলে স্থলে, জয়ে পরাজয়ে।
মনে হয় নিমন্ত্রণ পেয়ে গেছি নক্ষত্রলোকের।
কখন অজ্ঞাতসারে পকেটে কে পুরে দিয়ে গেছে ভিসা পাসপোর্ট
সব উড়োজাহাজের এয়ারপোর্টের
সমুদ্রের কিনারের সব কটি উচু মিনারের।
রেশমের, পশমের, মখমলের মতো শান্তি সঙ্গী হয়ে আছে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের অপর্যাপ্ত অভ্র ও আবীরে
আমার গায়ের আঁশ, ক্ষয়, ক্ষতি, ক্ষত, অক্ষমতা
সব কিছু রাঙিয়ে দিয়েছে।
যোগো
জলেও কি ট্রাম-বাস চলে?
জলেও কি আছে ছাপাখানা?
২৫শে বৈশাখ এলে জলের ভিতরে মাছ, নক্ষত্রের ঝাঁক
তারাও কি কবিতার খাতা খুলে বসে?
যোগো,
জলের ভিতরে গিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?
নিজের খাটের চেয়ে শ্যাওলার বিছানা কি অধিক নরম?
তুই কি কলম ফেলে কেবল জলের ঢেউ দিয়ে
কবিতার ভূল-ভাল, পৃথিবীর ভূল-ভাল প্রুফ কেটে-কুটে
সারারাত জেগেছিলি জলে?
যোগো,
জলের ভিতরে দিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?