গাছ অথবা সাপের গল্প
তোমাকে যেন কিসের গল্প বলবো বলেছিলাম?
গাছের, না মানুষের?
মানুষের, না সাপের?
ওঃ, হ্যাঁ মনে পড়েছে।
গাছের মতো একটা মানুষ।
আর সাপের মতো একটা নারী
কুয়াশা যেমন খামচা মেরে জড়িয়ে ধরে কখনো কখনো
দুধকুমারী আকাশকে
সাপটা তেমনি সাতপাকে জড়িয়ে ধরেছিল গাছটাকে।
আর গাছটাও বেহায়া।
লাজ-লজ্জা, লোক-লৌকিকতা ভুলে গিয়ে
নৌকা ডুবে যাচ্ছে, এখুনি ঝাঁপ দিতে হবে
নদীর নাইকুন্ডুতে,
এমনি ভাবেই সর্বস্ব ভাসিয়ে দিল সাপের হাতে।
আর তারপরেই ঘটল আজব কাণ্ডটা।
সাপের ছোবলে ছিল বিষ। নীল।
গাছের শিকড়ে ছিল তৃষ্ণা। লাল।
ছোবল খেতে খেতে ছোবল খেতে খেতে
নীলপদ্মে ভরে উঠল গাছ।
আর গাছের আলিঙ্গনে
গুড়ো হতে হতে গুড়ো হতে হতে
সেই শঙ্খচুড় সাপটা
আলতা-সিদুরে রাঙা বিয়ের কনে।
আর এই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে
আকাশের আইবুড়ো নক্ষত্রগুলো
হেসে গলে গা ঢলাঢলি করে বলে উঠল
আজ সারা রাত জাগব ওদের বাসর।
জেনে রাখা ভালো
জলের মাছের মতো অনায়াস হবে ভেবেছিলে
সব হাঁটাহাঁটি?
ভেবেছিলে ধোঁয়া, ধুলো, থুতু, কফ পেঁজা তুলো হয়ে
উড়ে যাবে অন্য দিকে, তোমাকে ছাড়িয়ে?
ভেবেছিলে পাট-ভাঙা জামায় লাগবে না
পেট্রোলের, পাঁঠা-কাটা রক্তের বা নর্দমার দাগ?
ভেবেছিলে টিকটিকির মতো রয়ে যাবে
আজীবন মসৃণ দেয়ালে?
সময়ের কারখানায় কেবল তোমারই জন্যে
তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সরু আলপিন
ব্লেড, ছুরি, ভোজালি, কাতান,
এইটুকু জেনে রাখা ভালো।
জ্বর
স্মৃতিতে সর্বাঙ্গ জ্বলে
একশ পাঁচ ডিগ্রী ঘোর জ্বর।
টালমাটাল ঝড়
ঘুষি মারে হাড়ে মাসে ব্রক্ষ্মতালু রক্তকণিকায়
যেন তাকে ছিড়েখুড়ে অন্য কিছু বানাবে এখুনি।
হঠাৎ হরিণ হয়ে হয়তো সে ছুটে যাবে বহুদূর বাঘ-ডোরা বনে
তুমুল আগুন জ্বেলে পলাশ যেখানে যজ্ঞ করে।
নিজের বিবিধ টুকরো জুড়ে জাড়ে হয়তো বা হলুদ শালিক
অর্জুন গাছের সাদা থামে
যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে সূর্যাস্ত যেখানে রোজ নামে
সেইখানে ঘরবাড়ি ভাড়া নিয়ে কিছুদিন থাকবে স্বাধীন
অথবা সে নিজেরই লালার
চমৎকার রাংতা দিয়ে গড়ে নেবে সাত-কুঠরি ঘর।
জ্বর
এইভাবে নখে চিরে করেছে উর্বর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে।
কলসী কলসী জল ঢালি সান্ত্বনার, সুবিবেচনার
কপালের জলপটি শীতের ভোরের মতো সারাক্ষণ ভিজে হয়ে থাকে
তবু জ্বর ছাড়েনাকো তাকে।
এক অগ্নিকুন্ডে থেকে আরেক আগুনে ঝাঁপ দিয়ে
ছাই মাখে, ভস্ম মাখে, চোখে আঁকে না-ঘুম-কাজল।
জ্বরে সে পাগল।
শিশুরা পায়েস ঘেঁটে গোলগাল কিসমিস পেয়ে গেলে যে রকম হাসে
সেরকমই দিগ্বীজয়ী হাসি তার দুটি পাখি-ঠোঁটে।
সে নাকি মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেছে বসন্তের সমস্ত কোকিল
গোপালপুরের সব রূপোলি ঝিনুক
পুরীর সমস্ত ঝাউবন।
সাঁওতাল পরগনা থেকে পেয়ে গেছে সব কটি নাচের মাদল।
আসলে এসব কিছু নয়
দুধের গাভীর মতো একটি নারীকে খুঁজে পেয়েছে সে কলকাতা থেকে
ছানা ওমাখন তাকে খেতে দেয় সেই রমনীটি
খেতে দেয় দু-বাটিকে ক্ষীর।
তারই গলকম্বলের স্বাদে গন্ধে এমন মাতাল
ভেবেছে পৃথিবী তার পকেটের তে-ভাঁজ রুমাল।
এই ভাবে জ্বর
নৌকো ভর্তি স্মৃতি সহ ভাসিয়ে দিয়েছে তাকে এই পৃথিবীর
ইট কাঠ বালি সুরকি পেরেকের ঢেউ-এর ওপর।
দেরাদুন এক্সপ্রেস
দেরাদুন এক্সপ্রেস পড়ি-মরি দৌড়ে ছুটে গেল।
কাকে ছুঁতে?
জ্বলজ্বলে যুবক সেজে কার কাছে গেল?
ডাকাতের মতো কালো অন্ধকারে, এই মাঝরাতে
কাকে খুলে দেবে বলে পরেছে আলোয়-গাঁথা হার?
চোখে তার জঙ্গলের খিদে-পাওয়া লাল চিতাবাঘ
এই বন্য থাবা দিয়ে কাকে সে জড়াবে?
প্রাগৈতিহাসিক কোনো স্মৃতির চন্দনগন্ধ মেখে
মহেনএজাদারোর বৃষ জেগে উঠে দিয়েছে হুঙ্কার
দেরাদুন এক্সপ্রেস সেইভাবে দৌড়ে চলে গেল।
কার সাথে কোন্খানে দেখা হবে তার?
সেখানে কী সবুজের ডোরাকাটা পাহাড়ের সার
কাশ্মীরী শালের মতো সামিয়ানা টাঙিয়ে রেখেছে?
বাসরঘরের ভিড়ে পান-খাওয়া পরিতৃপ্ত ঠোঁটের মতন
সেখানে কি বাগানের গায়ে-গায়ে সুখী হাওয়া বয়?
বানভট্ট যেরকম সুহাসিনী রূপসীর ঘ্রাণ পেয়েছিল
সেরকম কেউ
বনস্থলী, লতাগুল্ম, নুড়ি ওপাথর
সোনালী বালির রেখা, রাঙা ধুলো, ঝাউ, ঝরাপাতা
নদীর আয়না-জল, জড়ো করে, সব জুড়ে-জাড়ে
সেখানে কী তার জন্য ঘুমোবার বিছানার সুজনি বুনেছে?
পাখির নরম বুকে আকাঙ্কাকে জুড়োবার স্বাদ আছে জেনে
যেরকম ক্ষিপ্রতায় ব্যাধের চোখের কালো তীর ছুটে যায়
দেরাদুন এক্সপ্রেস সেইভাবে দৌড়ে চলে গেল।
কার কাছে গেল?
নেলকাটার
সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
সাত বছর সাঁতার কাটিনি সমুদ্রের নীল শাড়ির আমিষ অন্ধকারে
দশ বছর আগে শেষ ছুয়েছি পাহাড়ের স্তনচূড়া
মাদল বাজিয়ে কতবার ডেকেছে হৈ-হল্লার জঙ্গল, যাইনি।
আলজিভে উপুড় করে দিয়েছে মাতাল-হওয়ার কলসী, খাইনি।
যাবার মধ্যে গত ডিসেম্বরে সাঁচী
হাজার বছর পরে আবার দেখা যক্ষিনীদের সঙ্গে, হাসি ঠাট্টা-গল্পো।
কিন্তু নেলকাটার তো তারা নেবেনা।
সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
বেনারসী পরে মেধ নামবে ছাঁদনাতলায়
সর্বাঙ্গে আলোর গয়না,
অথচ আমার আলিঙ্গন করা বারণ।
ছুলেই তো রক্তের ফিনকি, করকরে ঘা।
যে শাঁখ বাজিয়ে কাল বলেছে-এসো
সে ঢাক বাজিয়ে আজ বলবে- যা।
আমাকে এবার খুঁজতে হবে একটা ন্যড়া মাথা নদী
তারই বালিতে বাঘছালের মতো বিছিয়ে দিতে হবে শুকনো স্মৃতি।
তারই উপরেই শোয়া-বসা, জপ-তপ, বাসন-কোসন, কাপড় কাচা
এবং নিজের নখে নিজেকে ছিড়তে বাঁচা।
সুখ নেইকো মনে
নেলকাটারটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।