একমুঠো জোনাকী
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
একমুঠো জোনাকীর আলো পেয়ে
এক একটা যুবক হয়ে যাচ্ছে জলটুঙি পাহাড়
যুবতীরা সুবর্ণরেখা।
সাপুড়ের ঝাঁপি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী
পুজো সংখ্যা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একমুঠো জোনাকী।
একমুঠো জোনাকীর আলো নিয়ে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজিক দেখাচ্ছে অন্ধকার।
ময়দানের মঞ্চে একমুঠো জোনাকী উড়িয়ে
জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল যেন কারা।
রবীন্দ্রসদনে তিরিশজন কবি তিরিশদিন ধরে আউড়ে গেল
একমুঠো জোনাকীর সঙ্গে তাদের ভাব-ভালোবাসা।
ইউনেসকোর গোল টেবিল ঘিরে বসে গেছে মহামান্যদের সভা
একমুঠো জোনাকীর আলোয়
আফ্রিকা থেকে আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত হোগলা বন আর ফাটা দেয়ালে
সাজিয়ে দেবে কোনারক কিংবা এথেন্সের ভাস্কর্য।
সাত শতাব্দীর অন্ধকার এইভাবে
ফাঁকা মাঠে ম্যাজি দেখিয়ে চলেছে একমুঠো জোনাকীর আলোয়।
এখনো
কাগজ পেলেই আঁকচারা কাটা অভ্যেস।
একবার আঁকছিলুম রাজবাড়ি।
আঁকতে আঁকতে হয়ে উঠলো আলকাতরা মাখা দৈত্য,
কাগজ থেকে লাফ দিয়ে উঠলো দশ আঙুলের থাবা
খাঁবো, খাঁবো, খাঁবো।
সেই থেকে আর রাজবাড়ি আঁকি না।
আঁকি রাজহাঁস, ময়ুর, জলের ঘূর্নি, আর সেই সব শিকড়
যা ডুবে আছে আকুলি-বিকুলি তৃষ্ণার ভিতরে।
পদ্মপাতায় ডুমুরের গুছির মতো ফলে থাকে যে শিশির
আঁকতে যাই, পারি না।
অন্ধকারের খোঁপায় বাগান সাজিয়ে রাখে যেসব আলোর কুঁচি
আঁকতে যাই, পারি না।
প্রচণ্ড রাগে একদিন আকঁতে বসলুম ধ্বংসের ছবি
আঁকতে আঁকতে ফুটে উঠল আশ্চর্য এক নারী।
তখরও চোখ আঁকিনি, তবুও চন্দন গন্ধে হেসে।
তখনও হাত আঁকিনি, তবুও কপালের জচুল সরিয়ে বললে
শোনো
বলেই হারিয়ে গেল ধ্বংসের আড়ালে।
তাকে ধরবো, ছোঁবো, জড়াবো, নিংড়াবো বলে
কলকাতার ট্রামলাইন, মেটেবুরুজের বসি-
মুর্শিদাবাদের কবর, অন্ধ্রের ঝড়, রাজস্থানের বালি ডিঙিয়ে
ছুটে চলেছি। ছুটে চলেছি। ছুটে চলেছি।
এখনো।
কবি
ওহে দেখতো দেখতো
লোকটা চলে যাওয়ার সময় কি রেখে গেল?
ভারী লুকনো স্বভাবের ছিল মানুষটা।
ঘাড় গুজে, হাঁটু ভেঙে, চোখ জ্বালিয়ে
বন-বাদাড়, নুড়ি পাথর, আগুন অন্ধকার, ঘেঁটে ঘেঁটে
কী সব কুড়িয়ে বেড়াত দিনরাত।
দেখতো কী রেখে গেল যাওয়ার সময়?
সিন্ধুকটা খোল।
ভিতরে কি?
আজ্ঞে পান্ডুলিপি।
ভল্টটা ভাঙো।
ভিতরে কি?
আজ্ঞে পান্ডুলিপি।
কে তোমাকে চেনে?
ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট ডিনার খাচ্ছ রোজ।
সে তোমাকে চেনে?
যে খাট-পালঙ্গে শুয়ে স্বপ্নে তুমি চাঁদ সদাগর
সে তোমাকে চেনে?
যে আয়নাকে শরীরের সব তিল, সর্বস্ব দেখালে
সে তোমাকে চেনে?
যেন মেয়ে-দেখা, এত বেছে ঐ পর্দা কিনেছিলে
ও তোমাকে চেনে?
এই কালো টেলিফোন, ওয়ার্ডরোব, লং প্লেয়িং, টিভি
এই সব থাক্-থাক্ বই, সোফা, নেপালী মুখোশ
কে তোমাকে চেনে?
একমাত্র কার্পেটের ধুলোটুকু, রোদটুকু ছাড়া
দরোজার জানালার ছেঁড়া-খোঁড়া আলোটুকু ছায়াটুকু ছাড়া
কে তোমাকে চেনে?
কোনো কোনো যুবক যুবতী
একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীর মুখে
সেকালের মোমমাখা ঝাড়লন্ঠন
স্তম্ভ ও গম্বুজ দেখা যায়।
দেখে হিংসা জাগে।
মানুষ এখন যেন কোনো এক বড় উনোনের
ভাত-ডাল-তরকারির তলপেটে ডাইনীর চুলের
আগুনকে অহরহ জ্বালিয়ে রাখার
চেলা কাঠ, কাঠ-কয়লা-ঘুটে।
মানুষ এখন তার আগেকার মানুষ-জন্মের
কবচ, কুণ্ডল, হার, শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও মুকুট
বৃষের মতন কাঁধ, সিংহ-কটি, অশ্বের কদম
পিঠে তৃণ, চোখে অহংকার
সব ছুঁেড় ফেলে দিয়ে একটা গগলস্ পেয়ে খুশি।
প্লাসটিকের মানিব্যাগ, নাইলনের জামা পেয়ে খুশি।
বোবা টেলিফোন পুষে তরতাজা বিল পেয়ে খুশি।
চারকোণা সংসারের চতুর্দিকে গ্রীল এটেঁ খুশি।
বনহংসী উড়ে যায়, সে বাতাসে কাশের কথুক
এয়ারকুলারে সেই বাতাসের বাসী গন্ধ পেয়ে বড় খুশি।
একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীকে দেখে
অতীতের রাজশ্রীর, হর্ষবর্ষনের মতো লাগে।
দেখে হিংসা জাগে।
কয়েকটি জরুরী ঘোষণা
আগামী চোদ্দ বছর মহিষ কিংবা নেউল রঙের মেঘের মুখদর্শন করব না কেউ।
আগামী চোদ্দ বছর আমাদের কবিতা থেকে হিজড়ে-নাচন বৃষ্টির নির্বাসন।
স্বেচ্ছাচারী এবং হামলাবাজ হাওয়াকে চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছি আমি
আর পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় টেলিফোনে ট্রাঙ্কলে
রেডিওগ্রামে জানিয়ে দিয়েছি
সমস্ত বিক্ষুব্ধ জলস্রোত যেন মাটিতে নাক-খত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়
দুর্গত মানুষের কাদা-পায়ে।
প্রত্যেক নদীর বাঁধকে বলে দিয়েছি হতে হবে হিমালয়ের কাঁধ সমান
প্রত্যেকটা নদীতে হতে হবে পাড়াগার লাজুক বৌ
প্রত্যেকটা ব্যারেজকে জননীর গর্ভ।
ভবিষ্যতে আর কোনদিন যদি মানুষকে ভাসতে দেখি শিকড়হীন উলঙ্গ
আর কোনদিন যদি মানুষের সাজানো-নিকোনো স্বপ্নসাধের ভিতরে ঢুকে পড়ে
দুঃস্বপ্নের খল-খল হাসি, আঁকাবাঁকা সাপ, মরা কুকুরের কান্না আর ভাঙা শাঁখা
আর কোনদিন যদি মানুষের শ্রেষ্ঠতম সংলাপ হয়ে ওঠে হাহাকার
আর কোনদিন যদি মানুষের আলতা সিদুর পরা সতী-লক্ষ্মী গৃহস্থলিকে
হেলিকপ্টার থেকে মনে হয় ছেঁড়া-কাঁথা কানির টুকরো
আমি বাধ্য হবো সভ্যতার বিরুদ্ধে ফাঁসীর হুকুম দিতে।
যতদিন মানুষের গায়ে দুর্দিনের দুর্গন্ধ এবং নষ্ট জলরেখা
রোদের কামাই করা চলবে না একনিও।
মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি দেখে যেতে চাই।
সমস্ত পুরুষ সূর্যমুখী, নারীরা ঝুমকো জবা আর শিশুরা
কমলা রঙের বোঁটায় শাদা শিউলি।