- বইয়ের নামঃ হে সময় অশ্বারোহী হও
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আছি
সুখে আছি, দুখে আছি, নিজস্ব বুদবুদে ডুবে আছি
পোয়াতি নারীর মতো গর্তে বহু স্বপনের ভ্রুণ নিয়ে আছি
সধবার নিরস্তর ভয় পাছে মুছে যায় সিঁথি-শুকজতারা
সে রকমই ভয়ে-ভয়ে ঘাসের ভিতরে পোকা-মাকড়ের সঙ্গী হয়ে আছি।
পাখিরা রয়েছে সঙ্গে, রুমালের পাড়ে
লাল সুতো, নীল সুতো, সদীর বাঁশীর গান তারা বুনে দেয়।
জঙ্গলও রয়েছে সঙ্গে, এক-শৃঙ্গ গণ্ডারও রয়েছে
বাঘের নখের দাগ, আঠারো ঘায়ের রক্তপুঁজ, সে-সবও রয়েছে।
হাঙরের করাতের দাঁতে হাসি লেগে আছে, এই দৃশ্য দেখে
অপমানিতের মতো নুয়ে আছে বৃদ্ধ বৃক্ষগুলি ।
আকাশের রুখু চুলে উকুনের মতো ঘোরে দুর্দিনের মেঘ
চামচিকের রক্ত নখে হাওয়ারা হয়েছে কালো ভুত।
তবু
কাঁঠালপাতার থেকে নেমে এসে জ্যোৎস্না মুখে তুলে ধরে বাটি-ভরা দুধ।
দিনের পঞ্চান্ন ভাগ তুচ্ছতার ধুলো মেখে আছি
পুতুলনাচের সুতো নর্বাঙ্গের পেরেকে জড়ানো।
কিন্তু যেই ফিরে আসি নিজ ঘরে, নিজস্ব বুদবুদে
মাথায় মুকুট পরে জেগে ওঠে গোলাপের বনে জাহাঙ্গীর
আতর গন্ধের ঘ্রাণ নিয়ে আসে নরজাহান চোখের রেকাবে।
ফৈয়াজ খাঁ-এর মতো গলা খুলে সারা দিনমান
কে যেন শুনিয়ে যায় মালকোষে পৃথিবীর, এশিয়ার, এই কলকাতার
যাবতীয় বন্দীশালা ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্ ভেঙে ভেঙে হবে খান্ খান্ ।
শীত-রাতে দুঃসময়ে পেয়ে গেছি এখনও কল্কাপপেড়ে শাল
আত্মার ভিতরে এক সূর্য থাকে, তারই রঙে লাল।
সেই শাল গায়ে দিয়ে আছি।
আজ্ঞে হ্যাঁ
সূর্য নামের ছোকরাটা বড় জ্বলতে শিখেছে, তাই না হে?
আজ্ঞ হ্যাঁ।
গনগণে চোখ, জ্বলজ্বলে ভূরু, উরু ভেঙে দিলে কেমন হয়?
আজ্ঞ হ্যাঁ।
আজকাল আর চাঁদে সে রকম রাবড়ির মতো জেল্লা নেই
আজ্ঞে হ্যাঁ।
টুনি বালবদের ফোলাপে ফাঁপালে প্রতিভা ছড়াবে হাজার গুণ।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
নিজের লালার সরু সুতোর দিয়ে বেনারসী বোনে মাকড়সা।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমারও তেমনি, থুতু ছিটোলেই হীরে-জহরত আকাশময়।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কানেই শুনেছো, দেখনি কখনো ঈশ্বর নামে লোকটাকে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কাল এসেছিলো, বেচতে চাইছে ধড়া-চূড়োসহ সিংহাসন।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ঈশ্বর হয়ে প্রথমেই আমি বুনবো কঠিন শৃঙ্খলা।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
পাহাড়গুলোকে পিঁপড়ে বানাবো, সব গাছ হবে ভেরেন্ডা।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আশ্বর্য
কোমরে লাল ঘুনসি বাঁধা
পোড়া বিড়ির টুকরোর মতো
আমরা চতুর্দিকে ছড়ানো।
কেউ মুথোঘাসের তলপেটে
কেউ বুড়ো বটের গোড়ালির আড়ালে
কেউ নর্দমার এটোঁ শালপাতার ডিঙিতে।
নেশাখোরের মতো হাওয়া
একবার দৌড়চ্ছে ডাইনে, একবার বাঁয়ে।
এক জায়গায় জুটবো
মন-খোলা জোৎস্নায় আড্ডা জমবে সারারাত
হৈ হৈ গল্পের মাদল বাজিয়ে,
তালা খুলব, যে যার খুপরির
পাটে পাটে ভাঁজ করা স্মৃতি, জামা-পাজামা
কোনোটায় বেনারসীর জরির নকশা
কোনোটায় রক্তপুজের ছেটে,
ভালোবাসা ন্যপথলিনের গন্ধের মতো
জড়িয়ে থাকবে আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবী রুমালে
তার উপায় নেই।
সময়টা খারাপ।
আকাশের ময়লা মেঘে বাঘছালের ডোরা।
মেঘে একবার বাজে দুন্দুভি
আরেকবার তাসা-পার্টির ন্যাকরা।
গাছপালাও ছন্নছাড়া।
যেখানে শিরদাঁড়া সোজা করার, সেখানে দুলছে,
যেখানে যজ্ঞের মন্ত্র সেখানে ঢুলছে
ঘুমে।
বোধিদ্রুমে
ধরেছে হতবুদ্ধির ঘুণ।
মুখ চুন করে আকাশের বারান্দায় নক্ষত্রেরা দাঁড়িয়ে।
নাম ভাঁড়িয়ে
ছিচকে জোনাকীরাই মস্তানী করে গেল সারারাত।
সূর্য
নিজের আগুনে নিজে পুড়ছে।
এখনো তারই দিকে চোখ রেখে জলবার ইচ্ছে
খিল্ আঁটা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে,
এইটেই আশ্চর্য।
উৎকৃষ্ট মানুষ
উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি চেয়েছিলে
এই যে এঁকেছি।
এই তার রক্ত-নাড়ি, এই খুলি
এই তার হাড়
এই দেখ ফুসফুসের চতুদিকে পেরেক, আলপিন
সরু কাঁটাতার।
এইখানে আত্মা ছিল
গোল সূর্য, ভারমিলিয়ন
ভাঙা ফুলদানি ছিল এরই মধ্যে
ছিল পিকদানি
পিকদানির মধ্যে ছিল
পৃথিবীর কফ, থুতু, শ্লেষ্মা, শ্লেষ
অপমান, হত্যা ও মরণ।
উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি খুঁজেছিলে
এই যে এঁকেছি!
ক্ষতচিহ্নগুলি গুণে নাও।।
একটি উজ্জ্বল ষাঁড়
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় লিফটে চেপে উর্ধ্বে উঠে যান,
তখনই বন্দনা গান গেয়ে ওঠে, একপাল কৃতার্থ ছাগল।
জুলিয়াস সীজারের মতো তিনি, মিশরের ফারাও এর মতো
যেন এই শতাব্দীর তরুণ-বয়সী এক নবতম আলোকজান্ডার
পাতলা ক্রীমের মতো বুদ্ধের মহন হাসি মুখে
চেঙ্গিস খানের মতো চোখে বহুদূর
স্বপ্নের রক্তাক্ত সিড়ি, যেন জেনে দিয়েছেন তিনি
ভূ-মধ্যসাগর এসে পায়ে পড়ে হবে পুষ্করিনী।
প্রভু! কোনো দৈববাণী দেবেন কি আজ?
কোনো ধন্য সার্কুলার? অথবা সুসমাচার টাইপরাইটারে?
বিশ্বস্ত বাদুড়বৃন্দ এইভাবে নিজেদের ল্যাজের চামরে
নিভৃতে আরতি করে যায়।
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় মেহগনি কাছের মস্ত সিংহাসনে, একগুচ্ছ চাবি
খুলে যান সারি সারি প্রয়ার, ফাইল, খোপ-ঝোপ
যুদ্ধের ম্যাপের মতো দেগে যান রণক্ষেত্র আর আক্রমণ
তুরী-ভেরী জগঝম্প বাজে টেলিফোনে।
আমি চাই না লাল কালিদিয়ে কেউ কবিতা লিখুক।
আমি চাই না কারো ঘাড়ে আলোকশিখার মতো দর্পিত কেশর।
ধ্রুবতারা ভালোবেসে, ভালোবেসে বেহুলার ভেলা
গাছের শিকড় থেকে খোলা হাওয়া পেড়ে আনে যারা,
যাদের হৃৎপিণ্ড জুড়ে জেগে আছে সমুদ্রের শাঁখ
আমি চাই তারা সব ইদুরের গর্তে বসে খঞ্জনী বাজাক।
একটি উজ্জ্বল ষাঁড় এইভাবে পেয়ে গেছে তুরুরে সবকটি তাস।
শুনেছি এবার তিনি নক্ষত্রমণ্ডলে
সত্তর বিঘের মতো জমি কিনে করবেন আলু-কুমড়ো পটলের চাষ।