Site icon BnBoi.Com

শব্দের বিছানা – পূর্ণেন্দু পত্রী

শব্দের বিছানা - পূর্ণেন্দু পত্রী

অনেককেই তো অনেক দিলে

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
এর আকাশে ওর আকাশে
ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে
পায়রাকে ধান খুটিতে দিলে খোয়াই জুড়ে
বুকের দুটো পর্দাঢাকা জানলা খুলে
কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে।
কত মুখের রোদের রেখা মুছিয়ে দিলে নীল রুমালে।

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
চায়ের কাপে মিষ্টি দিলে হাসির থেকে
নকশাকাটা কাঁচের গ্লাসে সরবতে সুখ মিশিয়ে দিলে।
নখের আঁচড় কাটতে দিলে ডালিমবনে
দাঁতের ফাঁকে লাল সুপুরি ভাঙ্গতে দিলে।

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে তুমি
আলমারিটার ঝুলন চাবি।

শূন্যতাকে রঙীন করার সাম্পু সাবান
সায়া শাড়ীর ভাঁজের নিচে
একটা ছোটো কৌটো আছে।
তার ভিতরে ভোমরা থাকে।

সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন্ হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল হাসির মতো
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে বুকের ক্ষত
দেয়ালজুড়ে বিকট ছায়া ভাবছো বুঝি অন্য কারো?
কার ছায়াটি কিরূপ গাঢ় সে ভোমরাটি সকল জানে।

আমায় কিছু লিখতে হবে
লিখতে গেলে ভোমরাটি চাই।
তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন-চাবি
আমায় দেবে?

 আবহমান ভগ্নী-ভ্রাতা

ডাইনে বাঁয়ে দুইদিকে দুই বাংলা আমার
আপন স্বজন দুজন মাতা।
ভালোবাসার সাঁকোর ওপর পা টলমল পা টলমল
পা বাড়ালেই পদ্মা নদী
হাত বাড়ালেই পদ্ম পাতা
এবার পাবো।
আজান-বাজান ভাটিয়ালীর কন্ঠনালীর ছন্দগাথা
প্রবহমান নদীনালায় গুনতে যাবো।
পাঁজর পোড়া গর্ত খোঁড়া হাটের মাঠের ঘরের ঘাটের
সব দরজা জানলা খুলে খুঁজতে যাবো
অগ্নিবরণ ভোরবেলাতে আমরা কজন আবহমান
ভগ্নি-ভ্রাতা।
ডাইনে বাঁয়ে দুই দিকে দুই বাংলা আমার
আপন স্বজন দুজন মাতা।

আশ্চর্য

একটি নারীর মাঝে অকস্মাৎ খুঁজে পায় কেউ
আশ্চর্যের নীলিমাকে। দৃশ্যহীন ঘন অন্ধকারে
নক্ষত্ররাজিরা গেছে আকাশে সোনালী শিল্প রুয়ে
তার স্নিগ্ধ সুষমার মোহাচ্ছন্ন ঘ্রাণ নিতে নিতে
ঘুমের মতন জাগে। ঘুমোতে দেয় না স্তব্ধতারে।
একে একে আবরণ পূজার ফুলের মতো ঝরে।
তারপর সেই দুটি অপরুপ লজ্জার ভঙ্গিমা
একে অপরের বন্য বাসনাকে বাহু দিয়ে বেঁধে
একে অপরের মুখে নিজের দেহের অন্ন দিয়ে
যে শয্যা স্রোতের মতো তাতেই নিদ্রিত থাকে শুয়ে।

একটি নারীর মাঝে অকস্মাৎ খুঁজে পায় কেউ
ক্ষণিকের নীলিমাকে। কঠিন প্রভাত খর রোদে
রজনীর খেলাধুলা দ্রুতহাতে যত দেয় ধুয়ে,
আবার পুষ্পিত হয়ে ওঠে তবু পৃথিবীর রাত।

তোমার বিষাদগুলি

তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

ভীষণ বৃষ্টির শব্দ সারাদিন স্মৃতির ভিতরে।
একাকিনী বসে আছ বৃষ্টির ভিতরে
বালুকাবেলায়
কবেকার উইয়ে-খাওয়া ছবি।
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

মানুষের ভীষণ বিষাদ
একদিন বেজেছে মন্দিরে শঙ্খ-ঘন্টা রবে।
মানুষের মহান বিষাদ
ভাষ্কর্যখচিত স্তম্ভে একদিন ছুঁয়েছে আকাশ।
আজ ভীষণ নীরব।

জলের ভিতরে ছুরি ঢুকে গেলে
আর্তনাদহীন।

রক্তের ভিতরে কান্না ঢুকে গেলে
প্রতিবাদহীন।

যে যার উদ্যানে ছায়াতলে
পুষ্পের ভিতরে অগ্নি জ্বলে
সুগন্ধ শোকের সম্মূখীন।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।

আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
আরম্ভে সকল গাছই সুসাস্থ্য সবুজ।
আরম্ভে সকল মুখে কলমীলতার ছাঁদে সাদা আলপনা
সব কথা রাখালের বাঁশি
আরম্ভে সকল চোখ চশমা ও কাজল ছাড়া সরল হরিণ।
আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
অতিশয় বিচক্ষণ হতে গিয়ে যত কিছু অদল-বদল
চোখে ছানি, গালে ব্রণ, বুকে লোম
নখে রক্তপাত
লালসা ও লোভ
ডুমুর ফলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ এটেঁ যার দাঁতের মাড়িতে।

অতিরিক্ত লালসায় গাছ দীর্ঘ হয়।
আরও উচু হলে আরও অনেক আকাশ
এই ভেবে জিরাফের গ্রীবা ছুঁড়ে গাছ দীর্ঘ হয়।
বাতাসে হলুদ পাতা বাসী ফুল পতনে মূর্ছায়
স্তুপাকার, জলে-স্থলে শোকধ্বনিময়।

অন্যখানে আরও বেশি ভালোবাসা সোনার সিন্দুকে
এই লোভে শৈশবের রূপকথা রাজপুরী ভাঙে
ডুরে শাড়ী বদলে যায়, বিনুনীতে সাপের গড়ন
ঈর্ষার কাজল চোখে, দাঁতের হাসি ধবল করাত।

যে যতই দূরে যাক
অবশেষে সকলেরই ফিরে আসা স্মৃতির ভিতরে বৃষ্টিপাতে
অনুশোচনায় বালি ঘাঁটাঘাঁটি বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি করতরে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

সমস্ত আরম্ভ জুড়ে মানুষের আলুথালু কত ছোটাছুটি
কুসুম-কুড়ানো কত ভোরবেলা, কুসুমের মতন কাঁকরও
পকেটে কত কি ছবি, আয়নাভাঙা, আতশবাজীর ফুলঝুরি
দোলের আবীর, বাঁকা রেকর্ডের গান, আঁচলে কত কি
মনোহর মন্ত্রধ্বনি, পালকি যায় পাখী যেতে পারে যত দূর।

আরম্ভের সব কিছু এইরূপ প্রতিশ্রুতিময়।
ক্রমে,
ভীষণ নীরবে
প্রতিশ্রুতি, গাছ ও মানুষ
একযোগে হরিতাভ হয়।

ক্রমে, ভীষণ নীরবে
চোখের কাজল, বেণী, বিত্রিত আঁচল
সোনার সিন্দুক, সব সতকর্তা, সাফল্যের স্ফীতকায় ঘাড়
স্তম্ভ, দম্ভ, জঙ্ঘা, ঊরু, গর্ব অহংকার
সবকিছু থেকে, চেয়ানো ঘামের মত অদ্ভুত বিষাদ।
অবশেষে বৃষ্টিপাত স্মৃতির ভিতরে
বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।

সভ্যতা সময় কিংবা মানুষের মহাইতিহাস
এত শোকে তবুও মরেনি।
কারণ মানুষ
এখনো নিজের করতলে
তুলে নেয় অন্যের বিষাদ।
আকাশ পাতাল থেকে এত বিষ, বারুদ ও জীবানু সত্ত্বেও
এখনো মানুষ
অন্য কিছু মহত্তম সুধার আশায়
ওপরের ওষ্ঠ থেকে তার সব মলিন বিষাদ
শুষে নিতে চায়

এখনো বিষাদ পাবে বলে
পুরুষ নারীর কাছে যায়
নারীরা নদীর কাছে যায়
নদীরা মাটির কাছে যায়
মাটি আকাশের দিকে চায়।

তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে চাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।

নিষিদ্ধ ভালোবাসার তিন সাক্ষী

তুমি যখন শাড়ির আড়াল থেকে
শরীরের জ্যোৎস্নাকে একটু একটু করে খুলছিলে,
পর্দা সরে গিয়ে অকস্মাৎ এক আলোকিত মঞ্চ,
সবুজ বিছানায় সাদা বাগান,
তুমি হাত রেখেছিলে আমার উৎক্ষিপ্ত শাখায়
আমি তোমার উদ্বেলিত পল্লবে,
ঠিক তখনই একটা ধুমসো সাদা বেড়াল
মুখ বাড়িয়েছিল খোলা জানালায়।

অন্ধকারে ও আমাদের ভেবেছিল
রুই মৃগেলের হাড় কাঁটা।
পৃথিবীর নরনারীরা যখন নাইতে নামে আকাঙ্খার নদীতে
তখন রুই মৃগেলের চেয়ে আরো কত উজ্জ্বল
দীর্ঘশ্বাস সহ সেই দৃশ্য দেখে বেড়ালটা ফিরে চলে গেলো
হাড়কাঁটার খোঁজে অন্য কোথা অন্য কোনখানে।
দ্বিতীয় সাক্ষী ছিল তোমার হত্যাকারী চোখ
আর তৃতীয় সাক্ষী আমার রক্তের সঙ্গে ওতপ্রোত শুয়ে আছে।

পরিণয় উপলক্ষে

এইখানে সব আছে। স্তব্ধতার মুখে
শুনতে পাবে অবিরল সলজ্জ সংলাপ
দৃষ্টি যদি ডুবে যায় তরল আঁধারে
তবু কারো নিংশ্বাসের উজ্জল উত্তাপ।

তোমাকে রঙিন করে দেবে স্পর্শ সুখে।
নিয়ে এসো দিনাস্তের অসংখ্য বিলাপ
কে তাকে উড়িয়ে দেবে গানের পাখির
পাখনায় বেঁধে ব্যাপ্ত অসীমের বুকে।

যেখানেই হাত ছোঁবে সে নদী-গিরির
অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা দৃশ্যের বিস্ময়
মেঘলোকে উঠে গেছে সিঁড়ি ধাপে ধাপ।
এইখানে নব আছে। যাকে বলো ক্ষয়
সেও তো ফোটাবে মুক্তি রক্তের কিংশুকে।
আমাকে অমৃত দেবে অন্তর্গত পাপ।

প্রাচীন ভিক্ষুক

রাজার দুলাল ভেবে ফিরায়ো না।
মাথার মুকুট গলে জয়মালা দেখে ফিরায়ো না।
আমি সেই প্রাচীন ভিক্ষুক।
শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা
শিরায় বিলাপ
নাভিতটে দংশনের লোভী ফণা, বিষধর সাপ
যথাযথ সকলই প্রাচীন।
মাথায় মুকুট গলে জয়মালা দেখে ফিরায়ো না।
গম্বুজ খিলান কিংবা মখমলে প্লাবিত মদিরা
বৃক্ষশাখে হারেমের উচ্চকিত হাসির মতন পুষ্পশোভা দেখে ফিরায়ো না।
সকলই চিকন চতুরালি।
ফুলের আড়ালে শাখা
শাখার আড়ালে ফুল
পরস্পর ঢেকে আছে নিঃস্বতার শিরাগ্রস্থ রুপ।
মুলত সে প্রাচীন ভিক্ষুক।

পুরাতন নামে ডাকো ছায়াময় আশ্রয়ে তোমার
স্মতিসুরভিত শয্যা, লজ্জায় আঁচলে ঢাকা থালা বাটি পানীয়ের জল
খুলে দাও ঈশ্বরের বিখ্যাত বাগান।
রৌদ্রতাপে জর্জরিত দেহ চায় সুশীতল স্নান।

পুনরায় ক্লান্ত করো মায়াবী হাসির কোলাহলে
লুকোচুরি খেলা নীল রজনীর গোপন আলোয়।
কতকাল নির্জনতা, বিষন্নতা, অবাধ্যতা ছেড়ে বেঁচে আছি।
যে অন্যায়ে কাঁচ ভাঙে, কতকাল সেরকম ক্ষামাহীন কোনো খেলা নেই।
রাজ্যে বড় সমারোহ, শঙ্খ ঘন্টা, শোভাযাত্রা, পতাকা রঙীন
রাজ্যে শুধু প্রথাগত, নীতিগত, শৃঙ্কলিত সুখ।

ভিখারিনী, ফিরায়ো না
আমি সেই প্রাচীন ভিক্ষুক।

বাকী থেকে যায়

ফুলের আলোয় রাঙা দিগন্তে দুয়ারহীন ছুটে
অভ্রের কুচির মতো সফলতা মাটি থেকে খুঁটে
অমল-বরণ রাতে সকল অমরাবতী লুটে
মানুষ কত কী পায় রৌদ্রে ও জ্যোৎস্নায়
সমস্ত পাওয়ার পরও তবু তার বাকী থেকে যায়
একটি চুম্বন।

কন্ঠে, কর্ণে, নির্বাচিত মুক্তামালা গাঁথা
শিরোপরে স্বর্ণময় ছাতা
কে বসেছ রাজার আসনে?
পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে অবিরত ক্ষত খুঁড়ে খুঁড়ে
কার ঘোড়া ছুটে চলে পৃথিবী শাসনে?
ও কার গোপন শয্যা
সোমত্ত গোপিনী দিয়ে সাজানো বাগান?
হাউইয়ের মতো এক পরিতৃপ্ত হাই তুলে
কে যেন আকাশে গায় গান?

এইরূপে মানুষের যাবতীয় অভিলাষগুলি
রৌদ্র ও জ্যোৎস্নার মধ্যে ডালিম ফলের মতো পাকে।
সমস্ত পাওয়ার পরও মানুষের তবু বাকী থাকে
কোনোখানে একটি চুম্বন।

যখন সকল জামা পরা শেষ, মাথায় মুকুট,
যখন সকল সুখে পুষ্ট ওষ্ঠপুট
তৃষ্ণার কলসুগুলি ভরে গেছে চরিতার্থতায়
অকষ্মাৎ মানুষের মনে পড়ে যায়
বিসর্জনে ডুবে গেছে কবে কত প্রতিমা ও পরম লগন
মনে পড়ে বাকী আছে, মনে পড়ে বাকী রয়ে গেছে
কোনোখানো একটি চুম্বন।

 বিলাপ

হারানো অতীত হানা দেয় ফিরে ফিরে।
পরিমাপ করি আজ কী সর্বস্বান্ত।
নিশ্বাসে বায়ু, তবু নিঃশেষ আয়ু,
প্রাণের প্রবল কলকোলাহল শান্ত।
জাগ্রত আছে যে দুটি-একটি স্নায়ু।
তারাও বিলাপ বিলায় অশ্রুনীরে।
দেখি দিগন্তে মুছে গেছে দিকপ্রান্ত
আকাশ বইছে আঁধারকে নতশিরে।

দু’হাতে কালের মন্দিরা বাজে নিত্য।
বাসনা-বহুল জীবনেই শুধু বিঘ্ন।
চীৎকার করে সন্তোগাতুর চিত্ত
আত্মার কাছে আত্মকেন্দ্র ঘিরে।

প্রাণাম্বেষণে যারা বেশী উদ্বিগ্ন
তারা নির্জনে হেঁটে যায় মন্দিরে।

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুস্পদল।
নিজের কস্তরী গন্ধে নিজেই বিহ্বল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার
আত্মজ কুসুমন্ডলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলল্কৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না
আমি একা ফোটাতে পারি না।
রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।

বহু জন্য বসন্তের অম্লান মঞ্জরী ফুটে আছো
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবীথিতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুষ্প বিচ্ছুরণ।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।

তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর-সম্ভারে।
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।

আমার উদ্গত অশ্রু অভ্যর্থনা করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যনে?

মোহিনীর স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভারোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।

বড়ে গোলাম

ফুলের গন্ধে ফোটার জন্যে
নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে
ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে
আমরা যেদিন যুবক হোলাম
বাইরে তখন বক্ষে বৃক্ষে
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
আমাদের সেই কান্না নিয়ে
গান গাইছে বড়ে গোলাম।
ফুলের কাছে নারীর কাছে
বুকের বিপুল ব্যথার কাছে
বেদনাবহ যে সব কথা
বলতে গিয়ে ব্যর্থ হোলাম।

তারাই যখন ফিরে আসে
কেউ ললিতে কেউ বিভাসে
স্পন্দনে তার বুঝতে পারি
বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম।

মাধবীর জন্যে

আয়নার পাশে একটু অন্ধকার ছায়া এঁকে দাও।
ব্যথিত দৃশ্যের পট জুড়ে থাক চিত্রিক আঁধার।
দেয়ালের ছবিটাকে একটু সরাতে হবে ভাই।
ওটা নয়, এই ছবিটাকে।
জুলিয়েট জ্যেৎস্নার ভিতরে
রক্তে উচ্চকিত তৃষ্ণা রোমিওর উষ্ণ ওষ্ঠাধরে।
ব্যাস, ব্যাস।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, আসুন।
একটা ক্লোজআপ নেব।
এখানে দাঁড়ান, একটু বা দিক ঘেষে প্লীজ।
মনিটার…
মাধবী বলুন-
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
না। অত স্পষ্ট নয়।
আরেকটু নির্জন স্বরে
নিজের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন।
যেন মনে হয়
ওষ্ঠ হতে উচ্চারিত কয়েকটি শীতল বাক্য নয়।
মনে হবে সন্ধ্যাবেলা সারা ধরাতলে
অবসন্ন কুসুমের ঝরিতেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে।
মনে হবে নীরব বোদনে
যেন আপনি বলতে চান
মনে রেখো, মনে রেখা সখা,
যেন কেহ কোনোদিন মনে রাখে নাই
মনে আর রাখিবে না।
জ্যেৎস্নার ভিতরে কোথাও আহ্বান নেই আর,
উষ্ণ ওষ্ঠাধর দুটি গোলাপের মহিমায় ফুটে
এখন অপেক্ষমান
কবে পাখি বলে যাবে, রাত্রি হলো অবসান বনবীথিতলে।
দৃষ্টি আরও নত হবে
সম্মূখে কোথাও কোনো দেখিবার মতো দৃশ্য নাই।
নিবন্ত ধূপের সাদা ছাই
রজনী পোয়ানো কিছু মৃত গোলাপের দীর্ঘশ্বাস
হাঁ-করা নেকড়ের মুখে দগ্ধ সিগারেট
এইটুকু দৃশ্যে শুধু পড়ে আছে কাঠের টেবিলে।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, মেক-আপ্, আলো,
এবার টেকিং
মাধবী, নিশ্চয় মনে আছে সংক্ষিপ্ত সংলাপটুকু
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?

যূথী ও তার প্রেমিকেরা

আকাশে বাতাসে তুমুল দ্বন্দ্ব
কে আগে কাড়বে যূথীর গন্ধ
কার হাতে বড় নখ।
স্বর্গে মর্তে যে যার গর্তে
যূথীকে গলার মালায় পরতে
ভীষণ উত্তেজক।।

মেঘের ভঙ্গী গোঁয়ার মহিষ
রোদ রাগী ঘোড়া, সুর্ঘ সহিস,
বজ্র বানায় বোমা।

বিদ্যুৎ চায় বিদীর্ণ মাটি
গাছে গাছে খাড়া সড়কি ও লাঠি
নদী গিরি বন ভয়ে অচেতন
থ্রম্বসিসের কোম।।

আকাশে বাতাসে তুমুল যুদ্ধ
যে যার গর্তে ভীষণ ক্ষুদ্ধ
নখে ধার, মুখে গ্রাস।
কেবল যূথীই জানে না সঠিক
কে তার পরমাশ্চর্য প্রেমিক
চোখে জল, বুকে ত্রাস।

শিকড় এবং ডালপালা

জন্মমুহূর্তে বীজের চোখে যেই নামল বৃক্ষের স্বপ্ন
অমনি দ্বিখন্ডিত।
আবখানা নেমে গেল মাটির তিমিরে
শিকড়
আধখানা রয়ে গেল মাটির উপর পৃথিবীর সকাল-বিকেলে
ডালপালা।
স্বপ্ন মানেই এক অনির্বচনীয় হত্যাকারী
এক আলোকিত খড়গ।
একটা কিছু হয়ে ওঠার স্বপ্নে
বুকের মধ্যে যেই
বজ্র-বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাদলের হৈহৈ রৈরৈ হাঁকাহাঁকি
অমনি দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় আমাদের সত্তা।
আধখানা রয়ে যায় মাটির উপর পৃথিবীর সকাল-বিকেলে
ডালপালা
আধখানা নেমে যায় ভূ-গর্ভের জটিল অলিগলির অন্ধকারে
শিকড়।

অথচ শিকড়ের নিজস্ব কোনো ক্ষুধা নেই।
যেমন বেদনার নিজস্ব কোনো বেদনা নেই।
আমাদের বেদনাগুলিই আমাদের শিকড়
হরিণের কাজল-চোখ নিয়ে আমাদের বেদনাগুলি
ভালোবাসার কাছে আসে।
শ্বাপদের উদগ্রীব থাবা নিয়ে আমাদের ভালোবাসাগুলি
আকাঙ্খার কাছে যায়।
শিকড়গুলি
যার নিজস্ব কোনো ক্ষুধা নেই
ডালপালার ভীষণ ক্ষুধাকে শিরায় শিরদাঁড়ায় নিয়ে
নারীর কাছে নেমে আসে ক্ষুধিত পুরুষের মতো।

পুষ্প এক একদিন সোহাগিনী রমনী।
ডালপালাগুলি
পুষ্পের জন্যে বড় কাঙাল।
সবুজ পল্লবেরা এক একদিন হলুদ পাখির গান।
ডালপালাগুলি
সবুজ পাতার জন্যে বড় কাঙাল।

শিকড়গুলি
অর্থাৎ আমাদের বেদনা, ভালোবাসা আর আকাঙ্খাগুলি
ভীষণ ক্ষ্যাপার মতো পৃথিবী তোলপাড় করে কেবল খুঁজছে
রমনী এবং পাখি
পুষ্প এবং পল্লবের ঠিকানা
ভূ-গর্ভের জটিল অলিগলির এপাড়ায় ওপাড়ায়
এবেলায় ওবেলায়।

স্বপ্নের অসুখ

স্বপ্নেরও অসুখ আজকাল।
সে-রকম নির্বিরোধী অমল ধবল পালতোলা স্বপ্ন আর বেড়াতে আসে না
রাত্রিকালে।
আধুনিক স্বপ্নগুলি একালের আঠারো বা উনিশ বছর বয়সের বিরক্তির মতো
সুখী হয় চৌচির চুরমারে।

আগে স্বপ্নে সারারাত চুড়িপরা হাত নিয়ে খেলা
নানান নারীর দেহ সারারাত একটি নারীতে
সরবতের মতো ঢালাঢালি।

স্বপ্নের দেয়ালগুলি আগে সাদা ছিল,
একন সেখানে, ধুমশো সাপের মতো ভয়ংকর ধ্বংসের অক্ষর।
স্বপ্নের নিজস্ব কিছু বাগান বা ঝাউবন দেবদারুবীথি সবাই ছিল
এই সব দৃশ্যে আগে নিরাপদে হেঁটে যাওয়া যেত
এখন সেখানে, অন্ধকার একা বসে দূরের আগুনে হাত সেঁকে।

এখন স্বপ্নেরও মধ্যে দুই মত, সংঘর্ষ দুবেলা
এখ স্বপ্নেরও মধ্যে অস্ত্রাঘাত, আহত চীৎকার
একন স্বপ্নেরও মধ্যে কারো কারো মর্মান্তিক বিসর্জন অথবা বিদায়।

স্বপ্নের বিছানা

রাত্রিবেলা বুকের মধ্যে একগোছা বৈদ্যুতিক তার
আর নীল রঙের একটা বালব টাঙিয়ে রাখা ভালো।
অন্ধকারে গায়ে নীল রঙের জামা পরিয়ে দিলে
স্বপ্ন দেখার দরখা খুলে দেয় সে।

মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক খাটে
স্বপ্ন দেখার আলাদা কোনো বিছানা-বালিশ নেই।
অবিকল স্বপ্নের মতো নারীরও শুয়ে নেই কোনো খাটে।

স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া আর কোথায়
আকাশময় উলুউলু?
গায়ে-হলুদের গন্ধে আকাশ পাতাল জুড়ে ফুলশয্যা?
স্বপ্নের মধ্যেই বুক-পিঠের অসুখ-বিসুখে সরিয়ে
অবিরল জলপ্রপাতে অবিবেচকের মতো কেবল ঝরে যাওয়া
নানান নদীতে।

স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব।
সব ধুলোবালি খোলামকুচি, সব উড়ে-যাওয়া আঁচল
রঙীন পরকলা জুড়ে জুড়ে আঁকা সব মুখচ্ছবি
বৃষ্টি বাদলের ভিজে গন্ধের ভিতরে লুকিয়ে কাঁদার সুখ।
স্বপ্নেই শুধু আরেকবার অগাধ জলের ভিতর থেকে
মুখ তুলে তাকায় ছেলেবেলার লাল শালুক।

মোহিনী কলসগুলি যতদূর ভেসে যেতে চায়
ততদূর স্বপ্নের বিছানা।

স্বরচিত নির্জনতা

স্বরচিত নির্জনতা, সযত্ন-সৃজিত নির্জনতা
তুমি আছ পার্শ্ববর্তী,কী অপুর্ব সুখ।
বাইরে ভুলের হাওয়া বইছে বহুক।
পল্লবেরা মরে শুধু পল্লবেরা অবেলায় ঝরে
পল্লবেরা কাঁপে গায়ে হতাশার জর
বনস’লী ভুলে গেছে নিজস্ব মর্মর।

আদিম চীৎকার তুলে
কাপালিক মগ্ন মন্ত্র পাঠে
অশ্রুধ্বনি নাভীমূলে
অবনত শোকে যারা হাঁটে।

কেউ যদি চায়
বিশ্বটাকে কিনে নেবে এক ভাঁড় বিশৃঙ্খলতায়,
ভাবে তো ভাবুক।
স্বরচিত নির্জনতা,সযত্ন-সৃজিত নির্জনতা
তুমি থাকো পার্শ্ববর্তী স্বর্গে ভরি
শূন্যের সিন্দুক।

Exit mobile version