বড়ে গোলাম
ফুলের গন্ধে ফোটার জন্যে
নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে
ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে
আমরা যেদিন যুবক হোলাম
বাইরে তখন বক্ষে বৃক্ষে
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
আমাদের সেই কান্না নিয়ে
গান গাইছে বড়ে গোলাম।
ফুলের কাছে নারীর কাছে
বুকের বিপুল ব্যথার কাছে
বেদনাবহ যে সব কথা
বলতে গিয়ে ব্যর্থ হোলাম।
তারাই যখন ফিরে আসে
কেউ ললিতে কেউ বিভাসে
স্পন্দনে তার বুঝতে পারি
বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম।
মাধবীর জন্যে
আয়নার পাশে একটু অন্ধকার ছায়া এঁকে দাও।
ব্যথিত দৃশ্যের পট জুড়ে থাক চিত্রিক আঁধার।
দেয়ালের ছবিটাকে একটু সরাতে হবে ভাই।
ওটা নয়, এই ছবিটাকে।
জুলিয়েট জ্যেৎস্নার ভিতরে
রক্তে উচ্চকিত তৃষ্ণা রোমিওর উষ্ণ ওষ্ঠাধরে।
ব্যাস, ব্যাস।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, আসুন।
একটা ক্লোজআপ নেব।
এখানে দাঁড়ান, একটু বা দিক ঘেষে প্লীজ।
মনিটার…
মাধবী বলুন-
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
না। অত স্পষ্ট নয়।
আরেকটু নির্জন স্বরে
নিজের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন।
যেন মনে হয়
ওষ্ঠ হতে উচ্চারিত কয়েকটি শীতল বাক্য নয়।
মনে হবে সন্ধ্যাবেলা সারা ধরাতলে
অবসন্ন কুসুমের ঝরিতেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে।
মনে হবে নীরব বোদনে
যেন আপনি বলতে চান
মনে রেখো, মনে রেখা সখা,
যেন কেহ কোনোদিন মনে রাখে নাই
মনে আর রাখিবে না।
জ্যেৎস্নার ভিতরে কোথাও আহ্বান নেই আর,
উষ্ণ ওষ্ঠাধর দুটি গোলাপের মহিমায় ফুটে
এখন অপেক্ষমান
কবে পাখি বলে যাবে, রাত্রি হলো অবসান বনবীথিতলে।
দৃষ্টি আরও নত হবে
সম্মূখে কোথাও কোনো দেখিবার মতো দৃশ্য নাই।
নিবন্ত ধূপের সাদা ছাই
রজনী পোয়ানো কিছু মৃত গোলাপের দীর্ঘশ্বাস
হাঁ-করা নেকড়ের মুখে দগ্ধ সিগারেট
এইটুকু দৃশ্যে শুধু পড়ে আছে কাঠের টেবিলে।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, মেক-আপ্, আলো,
এবার টেকিং
মাধবী, নিশ্চয় মনে আছে সংক্ষিপ্ত সংলাপটুকু
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
যূথী ও তার প্রেমিকেরা
আকাশে বাতাসে তুমুল দ্বন্দ্ব
কে আগে কাড়বে যূথীর গন্ধ
কার হাতে বড় নখ।
স্বর্গে মর্তে যে যার গর্তে
যূথীকে গলার মালায় পরতে
ভীষণ উত্তেজক।।
মেঘের ভঙ্গী গোঁয়ার মহিষ
রোদ রাগী ঘোড়া, সুর্ঘ সহিস,
বজ্র বানায় বোমা।
বিদ্যুৎ চায় বিদীর্ণ মাটি
গাছে গাছে খাড়া সড়কি ও লাঠি
নদী গিরি বন ভয়ে অচেতন
থ্রম্বসিসের কোম।।
আকাশে বাতাসে তুমুল যুদ্ধ
যে যার গর্তে ভীষণ ক্ষুদ্ধ
নখে ধার, মুখে গ্রাস।
কেবল যূথীই জানে না সঠিক
কে তার পরমাশ্চর্য প্রেমিক
চোখে জল, বুকে ত্রাস।
শিকড় এবং ডালপালা
জন্মমুহূর্তে বীজের চোখে যেই নামল বৃক্ষের স্বপ্ন
অমনি দ্বিখন্ডিত।
আবখানা নেমে গেল মাটির তিমিরে
শিকড়
আধখানা রয়ে গেল মাটির উপর পৃথিবীর সকাল-বিকেলে
ডালপালা।
স্বপ্ন মানেই এক অনির্বচনীয় হত্যাকারী
এক আলোকিত খড়গ।
একটা কিছু হয়ে ওঠার স্বপ্নে
বুকের মধ্যে যেই
বজ্র-বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাদলের হৈহৈ রৈরৈ হাঁকাহাঁকি
অমনি দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় আমাদের সত্তা।
আধখানা রয়ে যায় মাটির উপর পৃথিবীর সকাল-বিকেলে
ডালপালা
আধখানা নেমে যায় ভূ-গর্ভের জটিল অলিগলির অন্ধকারে
শিকড়।
অথচ শিকড়ের নিজস্ব কোনো ক্ষুধা নেই।
যেমন বেদনার নিজস্ব কোনো বেদনা নেই।
আমাদের বেদনাগুলিই আমাদের শিকড়
হরিণের কাজল-চোখ নিয়ে আমাদের বেদনাগুলি
ভালোবাসার কাছে আসে।
শ্বাপদের উদগ্রীব থাবা নিয়ে আমাদের ভালোবাসাগুলি
আকাঙ্খার কাছে যায়।
শিকড়গুলি
যার নিজস্ব কোনো ক্ষুধা নেই
ডালপালার ভীষণ ক্ষুধাকে শিরায় শিরদাঁড়ায় নিয়ে
নারীর কাছে নেমে আসে ক্ষুধিত পুরুষের মতো।
পুষ্প এক একদিন সোহাগিনী রমনী।
ডালপালাগুলি
পুষ্পের জন্যে বড় কাঙাল।
সবুজ পল্লবেরা এক একদিন হলুদ পাখির গান।
ডালপালাগুলি
সবুজ পাতার জন্যে বড় কাঙাল।
শিকড়গুলি
অর্থাৎ আমাদের বেদনা, ভালোবাসা আর আকাঙ্খাগুলি
ভীষণ ক্ষ্যাপার মতো পৃথিবী তোলপাড় করে কেবল খুঁজছে
রমনী এবং পাখি
পুষ্প এবং পল্লবের ঠিকানা
ভূ-গর্ভের জটিল অলিগলির এপাড়ায় ওপাড়ায়
এবেলায় ওবেলায়।
স্বপ্নের অসুখ
স্বপ্নেরও অসুখ আজকাল।
সে-রকম নির্বিরোধী অমল ধবল পালতোলা স্বপ্ন আর বেড়াতে আসে না
রাত্রিকালে।
আধুনিক স্বপ্নগুলি একালের আঠারো বা উনিশ বছর বয়সের বিরক্তির মতো
সুখী হয় চৌচির চুরমারে।
আগে স্বপ্নে সারারাত চুড়িপরা হাত নিয়ে খেলা
নানান নারীর দেহ সারারাত একটি নারীতে
সরবতের মতো ঢালাঢালি।
স্বপ্নের দেয়ালগুলি আগে সাদা ছিল,
একন সেখানে, ধুমশো সাপের মতো ভয়ংকর ধ্বংসের অক্ষর।
স্বপ্নের নিজস্ব কিছু বাগান বা ঝাউবন দেবদারুবীথি সবাই ছিল
এই সব দৃশ্যে আগে নিরাপদে হেঁটে যাওয়া যেত
এখন সেখানে, অন্ধকার একা বসে দূরের আগুনে হাত সেঁকে।
এখন স্বপ্নেরও মধ্যে দুই মত, সংঘর্ষ দুবেলা
এখ স্বপ্নেরও মধ্যে অস্ত্রাঘাত, আহত চীৎকার
একন স্বপ্নেরও মধ্যে কারো কারো মর্মান্তিক বিসর্জন অথবা বিদায়।
স্বপ্নের বিছানা
রাত্রিবেলা বুকের মধ্যে একগোছা বৈদ্যুতিক তার
আর নীল রঙের একটা বালব টাঙিয়ে রাখা ভালো।
অন্ধকারে গায়ে নীল রঙের জামা পরিয়ে দিলে
স্বপ্ন দেখার দরখা খুলে দেয় সে।
মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক খাটে
স্বপ্ন দেখার আলাদা কোনো বিছানা-বালিশ নেই।
অবিকল স্বপ্নের মতো নারীরও শুয়ে নেই কোনো খাটে।
স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া আর কোথায়
আকাশময় উলুউলু?
গায়ে-হলুদের গন্ধে আকাশ পাতাল জুড়ে ফুলশয্যা?
স্বপ্নের মধ্যেই বুক-পিঠের অসুখ-বিসুখে সরিয়ে
অবিরল জলপ্রপাতে অবিবেচকের মতো কেবল ঝরে যাওয়া
নানান নদীতে।
স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব।
সব ধুলোবালি খোলামকুচি, সব উড়ে-যাওয়া আঁচল
রঙীন পরকলা জুড়ে জুড়ে আঁকা সব মুখচ্ছবি
বৃষ্টি বাদলের ভিজে গন্ধের ভিতরে লুকিয়ে কাঁদার সুখ।
স্বপ্নেই শুধু আরেকবার অগাধ জলের ভিতর থেকে
মুখ তুলে তাকায় ছেলেবেলার লাল শালুক।
মোহিনী কলসগুলি যতদূর ভেসে যেতে চায়
ততদূর স্বপ্নের বিছানা।