নিষিদ্ধ ভালোবাসার তিন সাক্ষী
তুমি যখন শাড়ির আড়াল থেকে
শরীরের জ্যোৎস্নাকে একটু একটু করে খুলছিলে,
পর্দা সরে গিয়ে অকস্মাৎ এক আলোকিত মঞ্চ,
সবুজ বিছানায় সাদা বাগান,
তুমি হাত রেখেছিলে আমার উৎক্ষিপ্ত শাখায়
আমি তোমার উদ্বেলিত পল্লবে,
ঠিক তখনই একটা ধুমসো সাদা বেড়াল
মুখ বাড়িয়েছিল খোলা জানালায়।
অন্ধকারে ও আমাদের ভেবেছিল
রুই মৃগেলের হাড় কাঁটা।
পৃথিবীর নরনারীরা যখন নাইতে নামে আকাঙ্খার নদীতে
তখন রুই মৃগেলের চেয়ে আরো কত উজ্জ্বল
দীর্ঘশ্বাস সহ সেই দৃশ্য দেখে বেড়ালটা ফিরে চলে গেলো
হাড়কাঁটার খোঁজে অন্য কোথা অন্য কোনখানে।
দ্বিতীয় সাক্ষী ছিল তোমার হত্যাকারী চোখ
আর তৃতীয় সাক্ষী আমার রক্তের সঙ্গে ওতপ্রোত শুয়ে আছে।
পরিণয় উপলক্ষে
এইখানে সব আছে। স্তব্ধতার মুখে
শুনতে পাবে অবিরল সলজ্জ সংলাপ
দৃষ্টি যদি ডুবে যায় তরল আঁধারে
তবু কারো নিংশ্বাসের উজ্জল উত্তাপ।
তোমাকে রঙিন করে দেবে স্পর্শ সুখে।
নিয়ে এসো দিনাস্তের অসংখ্য বিলাপ
কে তাকে উড়িয়ে দেবে গানের পাখির
পাখনায় বেঁধে ব্যাপ্ত অসীমের বুকে।
যেখানেই হাত ছোঁবে সে নদী-গিরির
অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা দৃশ্যের বিস্ময়
মেঘলোকে উঠে গেছে সিঁড়ি ধাপে ধাপ।
এইখানে নব আছে। যাকে বলো ক্ষয়
সেও তো ফোটাবে মুক্তি রক্তের কিংশুকে।
আমাকে অমৃত দেবে অন্তর্গত পাপ।
প্রাচীন ভিক্ষুক
রাজার দুলাল ভেবে ফিরায়ো না।
মাথার মুকুট গলে জয়মালা দেখে ফিরায়ো না।
আমি সেই প্রাচীন ভিক্ষুক।
শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা
শিরায় বিলাপ
নাভিতটে দংশনের লোভী ফণা, বিষধর সাপ
যথাযথ সকলই প্রাচীন।
মাথায় মুকুট গলে জয়মালা দেখে ফিরায়ো না।
গম্বুজ খিলান কিংবা মখমলে প্লাবিত মদিরা
বৃক্ষশাখে হারেমের উচ্চকিত হাসির মতন পুষ্পশোভা দেখে ফিরায়ো না।
সকলই চিকন চতুরালি।
ফুলের আড়ালে শাখা
শাখার আড়ালে ফুল
পরস্পর ঢেকে আছে নিঃস্বতার শিরাগ্রস্থ রুপ।
মুলত সে প্রাচীন ভিক্ষুক।
পুরাতন নামে ডাকো ছায়াময় আশ্রয়ে তোমার
স্মতিসুরভিত শয্যা, লজ্জায় আঁচলে ঢাকা থালা বাটি পানীয়ের জল
খুলে দাও ঈশ্বরের বিখ্যাত বাগান।
রৌদ্রতাপে জর্জরিত দেহ চায় সুশীতল স্নান।
পুনরায় ক্লান্ত করো মায়াবী হাসির কোলাহলে
লুকোচুরি খেলা নীল রজনীর গোপন আলোয়।
কতকাল নির্জনতা, বিষন্নতা, অবাধ্যতা ছেড়ে বেঁচে আছি।
যে অন্যায়ে কাঁচ ভাঙে, কতকাল সেরকম ক্ষামাহীন কোনো খেলা নেই।
রাজ্যে বড় সমারোহ, শঙ্খ ঘন্টা, শোভাযাত্রা, পতাকা রঙীন
রাজ্যে শুধু প্রথাগত, নীতিগত, শৃঙ্কলিত সুখ।
ভিখারিনী, ফিরায়ো না
আমি সেই প্রাচীন ভিক্ষুক।
বাকী থেকে যায়
ফুলের আলোয় রাঙা দিগন্তে দুয়ারহীন ছুটে
অভ্রের কুচির মতো সফলতা মাটি থেকে খুঁটে
অমল-বরণ রাতে সকল অমরাবতী লুটে
মানুষ কত কী পায় রৌদ্রে ও জ্যোৎস্নায়
সমস্ত পাওয়ার পরও তবু তার বাকী থেকে যায়
একটি চুম্বন।
কন্ঠে, কর্ণে, নির্বাচিত মুক্তামালা গাঁথা
শিরোপরে স্বর্ণময় ছাতা
কে বসেছ রাজার আসনে?
পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে অবিরত ক্ষত খুঁড়ে খুঁড়ে
কার ঘোড়া ছুটে চলে পৃথিবী শাসনে?
ও কার গোপন শয্যা
সোমত্ত গোপিনী দিয়ে সাজানো বাগান?
হাউইয়ের মতো এক পরিতৃপ্ত হাই তুলে
কে যেন আকাশে গায় গান?
এইরূপে মানুষের যাবতীয় অভিলাষগুলি
রৌদ্র ও জ্যোৎস্নার মধ্যে ডালিম ফলের মতো পাকে।
সমস্ত পাওয়ার পরও মানুষের তবু বাকী থাকে
কোনোখানে একটি চুম্বন।
যখন সকল জামা পরা শেষ, মাথায় মুকুট,
যখন সকল সুখে পুষ্ট ওষ্ঠপুট
তৃষ্ণার কলসুগুলি ভরে গেছে চরিতার্থতায়
অকষ্মাৎ মানুষের মনে পড়ে যায়
বিসর্জনে ডুবে গেছে কবে কত প্রতিমা ও পরম লগন
মনে পড়ে বাকী আছে, মনে পড়ে বাকী রয়ে গেছে
কোনোখানো একটি চুম্বন।
বিলাপ
হারানো অতীত হানা দেয় ফিরে ফিরে।
পরিমাপ করি আজ কী সর্বস্বান্ত।
নিশ্বাসে বায়ু, তবু নিঃশেষ আয়ু,
প্রাণের প্রবল কলকোলাহল শান্ত।
জাগ্রত আছে যে দুটি-একটি স্নায়ু।
তারাও বিলাপ বিলায় অশ্রুনীরে।
দেখি দিগন্তে মুছে গেছে দিকপ্রান্ত
আকাশ বইছে আঁধারকে নতশিরে।
দু’হাতে কালের মন্দিরা বাজে নিত্য।
বাসনা-বহুল জীবনেই শুধু বিঘ্ন।
চীৎকার করে সন্তোগাতুর চিত্ত
আত্মার কাছে আত্মকেন্দ্র ঘিরে।
প্রাণাম্বেষণে যারা বেশী উদ্বিগ্ন
তারা নির্জনে হেঁটে যায় মন্দিরে।
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুস্পদল।
নিজের কস্তরী গন্ধে নিজেই বিহ্বল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার
আত্মজ কুসুমন্ডলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলল্কৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না
আমি একা ফোটাতে পারি না।
রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
বহু জন্য বসন্তের অম্লান মঞ্জরী ফুটে আছো
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবীথিতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুষ্প বিচ্ছুরণ।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর-সম্ভারে।
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদ্গত অশ্রু অভ্যর্থনা করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যনে?
মোহিনীর স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভারোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।