তোমারই সঙ্গে
তোমারি সঙ্গে যুদ্ধ প্রহরে প্রহরে
তোমারই সঙ্গে সন্ধি,
তোমারই মূর্তি নির্মাণে আমি নিজেকে
করেছি পাথর চূর্ণ।
সর্বনাশের পাশা নিয়ে খেলা দুজনের,
অথচ লক্ষ্য শান্তি।
আক্রমণের তীর ও ধনুকে জ্বলছে
ক্ষমার সৌরদীপ্তি।
তোমার মৃত্যু যখন আমার কান্নায়
তুমি উল্লাসে পদ্ম,
আমার মৃত্যু যখন তোমাকে ছিঁড়ছে
আমি মুখরিত শঙ্খ।
প্রহরে প্রহরে নিহত হয়েও আমরা
অগ্নিপালকে রক্তিম,
পরস্পরের নিঃস্বতা পরিপূরণে
অর্জন করি প্রজ্ঞা।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
প্রখর তুলির পাশে কতদিন অবনত হয়েছি বিস্ময়ে।
এ কী টান! বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুত এ কী বলবান
রেখার সংহত রূপ, রেখা যেন গর্বিত গান্ডীব,
যেন জানে শত্রুপক্ষ, যেন জানে কোথায় সংগ্রাম
এবং বিষাদও জানে, হাহাকারে সঙ্গী হতে জানে।
তখন দিগন্ত ছিল রক্তে ও রক্তিম আকাঙ্খায়
একই সঙ্গে একাকার, দুঃসময় ঘরে ও বাহিরে।
বিশ্বাসের দুর্গ ভাঙে, অবিন্যস্ত বাতাসে ছড়ায়
প্রশ্ন শুধু, প্রশ্ন বীজ প্রশ্ন বৃক্ষ হয়।
সেই দীর্ণ সময়ের দিনগুলি, দগ্ধ রাতগুলি
একটি তুলির কাছে যখনই চেয়েছে বরাভয়,
পেয়েছে বুকের বর্ম, মানচিত্র, দৃপ্ত যাত্রাপথ।
তাঁর কোনো নামাবলী নেই, তিনি নিঃসঙ্গ পথিক
ভ্রমণ বিলাসী তিনি, দুর্গমে দুরূহে নিত্য পাড়ি।
কানাকড়িহীন কিন্তু হাসিতে ঠিকরোয় রত্নকণা,
রাজাধিরাজের মতো এই নিঃস্ব এখনো প্রেরণা।
নতুন শব্দ : সফদার হাসমি
এই মৃত্যুশোক
কাঁধ থেকে নামানো যাবে না কোনোদিন।
আর বর্বরতা কি নির্বোধ।
যেন মৃত্যু হলেই মুছে যায়
প্রতিজ্ঞার প্রাণ।
আক্রমণ কোনো নতুন শব্দ নয়।
হিংসা কোনো নতুন শব্দ নয়।
নতুন শব্দ-সফদার হাসমি।
সফদার হাসমি মানে জাগা,
জেগে থাকা,
জাগানো।
পাহাড় গন্তব্য ছিল
বইয়ের উপর থেকে ধুলো মুছে নিলে
আরো ধুলো রয়ে যায় অক্ষরের স্থাপত্যকে ঘিরে।
ফলে ব্যাঙই সাপ খায় গিলে।
মানুষ যেযার মতো চোখে-ধুলো ব্যাখ্যা দিতে জানে,
সূর্য, শিল্প, শ্রম, শান্তি, শস্য বা সংহতি
আগুন-বীজের মতো এইসব মহাপ্রাণ শব্দেরও সহজতর মানে।
মঞ্চ থেকে যে-মুহূর্তে প্রেরণার যোগ্য সম্ভাষণ
বসন্তের বিস্ফোরণ বাতাসের শিরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
কুঠার চিহ্নকে মুছে যুবক-যুবতী সাজে বন।
সে শুধু ঋতুর মতো আসা-যাওয়া, থেকে যাওয়া নয়।
সময়ের ঝাঁট দেওয়া ধুলোর পরত জমে জমে
মানচিত্র পোকা-খাওয়া, বিশ্বাসের অবিশ্বাস্য ক্ষয়।
পাহাড় গন্তব্য ছিল, অবশেষে নুড়ি ঘেঁটে ফেরা।
বিকেলের চশমায় নিশুতি রাতের কালো ছোপ,
অভিযানযোগ্য পথ ইজারা নিয়েছে গহ্বরেরা।
আলো আসে, আলো চলে যায়।
জল থাকে, খুঁটি ধরে টেনে রাখে উচ্ছৃঙ্খল জল,
নিরীক্ষণ স্থির হতে পারে না ডাঙায়।
ফুল্লরার বারমাস্যা, চতুর্দিকে সংকটই সম্রাট।
এত যে রচনাপর্ব, দোয়াতে রক্তের কালি, রক্তিম বিষয়ে আলোচনা
এসবই কি ধুলোর মলাট?
বিরুদ্ধাচরণ
শিল্পের শৃঙ্খলা ভেঙে, নৈতিকতা ভেঙে
তুমি যদি বায়ুমুখ নৈরাজ্যের কুহকে বাঁকিয়ে
নিজের সিদ্ধিকে ভাবো সভ্যতারই আরও উত্তরণ
বিরুদ্ধাচরণ ব্রত হবে।
যে গেলাসই জল দেয়
ছুঁড়ে ভাযো, অথচ তোমার
জল চাই মুহুর্মুহু,
জল চাই, জলস্তম্ভ চাই।
সমস্ত গেলাস ভেঙে, জলাধার ভেঙে
যদি চাও নিরাপদ সমুদ্র-শোষণ,
বিরুদ্ধাচরণ ব্রত হবে।
তোমার মোহর থেকে ঝলসানো সাফল্য ও সুখ
যে কেনে কিনুক।
আমি শ্রমে অকাতর, আমার নির্মাণ
পেশী পক্ষপাতী।
আমি জানি সৃজনের ভিতরের নিঃশব্দ দহন।
তুমি যদি আগুনের শিখা ও শিকড়
পুষতে চাও পকেটে, লাইটারে
বিরুদ্ধাচরণ ব্রত হবে।
যুদ্ধ
যে আমাকে অমরতা দেবে
সে তোমার ছাপাখানা নয়,
সে আমার সত্তার সংগ্রাম
নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়।
শামসুর রাহমান, ৬০
তোমার মুকুট ঘিরে থাক কাঁটাতারে
বিদ্ধ করুক পেরেকের অপমান।
জানবে তোমার খোঁজ নেয় রোজ গারো পর্বতমালা
কেমন আছেন শামসুর রাহমান?
তোমার তূনীর ভরা থাক বিশ্বাসে
শব্দ বুনুক বজ্রের বীজধান।
হয়তো একদা মেঘে শোনা যাবে মেঘনার তোলপাড়
আমি হতে চাই শামসুর রহমান।
ছেনী ও হাতুড়ী ধরা যাক দৃঢ় হাতে
রূঢ় প্রস্তর খুঁজে পাক গূঢ় প্রাণ।
আজ সকালেই সোনার কলমে সূর্য লিখল রোদে
ইতিহাস হোক শামসুর রাহমান।
সেই পদ্মপাতাখানি
সেই পদ্মপাতাখানি ছুঁয়ে আছি তবু।
যতই ফুঁ দাও ঝড়ে নেভাতে পারবে না
মোমের আগুন।
এত ভূল কর কেন যোগে ও বিয়োগে?
ত্রিশূলের কতটুকু ক্ষমতা ক্ষতির?
নির্বাসনদণ্ড দিয়ে মুকুট কেড়েছ,
তবু দেখ পৃথিবীর পাসপোর্ট আত্মীয় করেছে।
আমার পতাকা উড়ছে
পাখিদের স্বাধীনতা ছুঁয়ে।