- বইয়ের নামঃ রক্তিম বিষয়ে আলোচনা
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ
তোমাকে দেখে অবাক হয়ে যাই বারবার।
এত আক্রমণ
পরস্পরবিরোধী এত শোকমিছিলের মধ্যেও
কী অনায়াসে বুনে যাচ্ছ লাল পশমের শৃঙ্খলা।
উদ্ভিদের চেয়ে নীরব,
ছাপানো মহাভারতের চেয়ে উদাসীন।
অথচ
পিছনের দেয়ালেই রক্তছাপ
অথচ
বুকের শাড়ি সরালেই
অনাবৃষ্টির চৌচির।
আগুনে আঙুল রেখে
আগুনে আঙুল রেখে ঠায় বসে আছি
কেউ ডাকলে যাতে সাড়া পায়।
ঘরের বাইরে গোল সার্কাসের মাঠ।
নিরাপত্তা-বিধায়ক যথারীতি ভেজানো কপাট।
কবে বৃষ্টি হয়েছিল
তারই বাসি গন্ধ শোঁকে মাটি।
বুদ্ধিজীবী বাতাসের চতুষ্পাঠী চেপেছে নিলামে।
মুখ-আঁটা গোপনীয় খামে
চিঠি চালাচালি চলে সন্ধি ও সংগ্রামে।
ছুঁচের সেলাই ছেঁড়া শার্ট
দুমড়ে মুচড়ে যেভাবে বাতিল
তার চেয়ে হীনমন্যতায়
রৌদ্র আজ লোকালয় ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে চায়
জঙ্গলে ও ইলেকট্রিক খুঁটির ওপারে।
ঘরের বাইরে সব।
ঘর ফাঁকা, ঘরে শুধু পেরেক রয়েছে,
স্মরনীয়তাজ ছবি নেই।
আগুনে আঙুল রেখে বসে আছি ঠায়
সঠিক ঠিকানা খুজেঁ কেউ এলে যাতে সাড়া পায়।
আত্মসমালোচনা
এও এক ধরনের অসুখ
এ বোধ, অতৃপ্তির আর অসর্ম্পূতার।
এর জ্বরও ওঠে, নামে, কাঁপায়।
গভীর বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফেরার পর
এও হয়ে যায় হাড়-পাঁজরের কফ-কাশি।
ভীষণ টঙ্কারের মতো মুহূর্তগুলো
যা বাজে তার ভিতরকার গণনাহীন কাঁপনগুলোকে
চিনিয়ে দিতে, আর ধরার আগেই মিলিয়ে যায়
ক্রমশ দূর প্রতিধ্বনিহীনতায়
হৃতসর্বস্ব হতে হতে।
আমি কি ধরিত্রীযোগ্য
আমি কি ধরিত্রীযোগ্য?
এই প্রশ্নে কেঁপে ওঠে তার
অসুখের ঘূণ-লাগা শরীরের অসি’-মজ্জা হাড়।
তাকে ঘিরে আছে মেঘ
তাকে ঘিরে ব্যাধের উল্লাস।
অক্ষর অন্বিষ্ঠ তার,
হাতের মুঠোয় মরা ঘাস।
প্রকৃতির হাত থেকে মানুষ নিয়েছে কেড়ে নিজের থাবায়
সংক্রামক কুয়াশা ও হিম
মানুষের হাত থেকে কখন নিয়েছে কেড়ে বিরক্ত সময়
অন্ধকার চিনবার মঙ্গল পিদিম।
কাঁটায় ছিঁড়েছে হাত
লুকনো রক্তের ফোঁটা লেগে
পান্ডুলিপি ভিজে একাকার।
আমি কি ধরিত্রীযোগ্য?
এই প্রশ্নে সে এখন সেতারের ছিঁড়ে যাওয়া তার।
একটি দুটি তিনটি যুবক
কলকাতা শহরে মাত্র একটি দুটি তিনটি মানুষ
এখনো যুবক হয়ে আছে স্বেচ্ছাচারে।
ফুটবলের মতো তারা
কারো পায়ে থাকে না কখনো।
ক্রিকেট ব্যাটের মতো
ঘূর্ণি বলে যৌবনের জৌলুস হাঁকায়।
একেকটি শীত আসে
একেকটি যুবক খসে পড়ে।
উল্কাবৃন্তচ্যুত তারা আকাশের কিনারা হারিয়ে
সরপুটি, চাঁদা পুটি,
অল্প জলে অতিকায় খেলা।
হে গভীর! এখানে এসো না।
কলকাতার ক্ষণপ্রভ ভিড়ে এলে তুমিও হারাবে
আতরদানের শিশি, চশমা ও উষ্ণীষ।
তৃণীর মরচেয় গুড়ো হবে।
কিংবা এসো, এসে দেখে যাও
করাতকলের পাশে একটি দুটি তিনটি যুবকের
অগ্নিসাক্ষী রাখা অহঙ্কার।
করাত কেটে চলেছে
করাত কেটে চলেছে ভিতরে
বাইরে তুলকালাম পিকনিক।
অস্ত্রাঘাতের শব্দে শিউরে উঠল কে?
বাতাস।
এক শ্মশান থেকে আর শ্মশানে ছুটছে কে?
যৌবন।
করাত কেটে চলে ভিতরে
বাইরে তুলকালাম পিকনিক।
পায়ের তলায় গুমরে গুমরে উঠছে কি?
প্লাবন।
মাটির দেয়ালে ক্রমশ লতিয়ে উঠছে কি?
মড়ক।
করাত কেটে চলছে ভিতরে
বাইরে তুলকালাম পিকনিক।
কে?
দরজা খোলা
আর দরজা বন্ধের শব্দ।
কে হাঁটো?
লাল নকশো পাড়ে
বিবেচনাহীন ঝাঁপিয়ে পড়ার ঢেউ।
কে হাসো?
দেয়াল ভরে যায়
খাজুরাহোর অলৌকিকে।
কে টালমাটাল করো
স্মৃতির ওয়ার্ডরোব?
উত্তর নেই।
দরজা খোলা
আর দরজা বন্ধের শব্দ
কোন্ কথা মন্ত্র হবে
কোন কথা মন্ত্র হবে কেউ তা জানে না।
তবু তো ঘুমের কাছে বেচে দিতে পার না সিন্দুক।
কঠিন মৃগয়া ছেড়ে বিছানার বালিশে-তোশকে
লুকোতে পার না ধনুর্বাণ।
যেহেতু নিয়েছ বেছে ব্যাধের ভূমিকা
তোমাকে তো যেতে হবে দুর্গমের গৃঢ় অভ্যন্তরে
সময়ের শতজট, ভূল-হাতছানি ভেদ করে।
যে কোনো তপস্যা চায়
নতজানু শুচিতা ও শ্রম।
গাছ
রাজকোষের মতো বোঝেই
কুঁড়িতে, পাতায়, শতপুষ্পে, গন্ধের পেখমে।
তবু শিকড়ের চোখে আত্মগোপনকারী যোদ্ধার আত্মসমালোচনা।
নিজের ভিতরে গভীর কোনো জল-উৎস খুঁজতে খুঁজতে
খুঁড়তে খুঁড়তে ক্লান্ত এবং
বিপদাপন্ন।
কখনো কখনো সোনালি মেঘের শিরা-উপশিরাও
তার কাছে করাতের দাঁত।
কখনো কখনো মেঘ সে নিজেই।
মেঘের ভিতরে নিজেকে দীর্ণ করতেই বানিয়ে চলেছে
বজ্র-ডমরুর গুরুগুরু।
গায়ত্রী মন্ত্রের আলো
কবিতা লেখার রাত
ভিজে গেছে অঘ্রাণের উদাসীনতায়।
সব ক্ষীপ্র অত্যুৎসাহে
উদ্যোগে ও কর্মকান্ডে আজ লেগে আছে
শিশিরের সাদা ফোঁটা
জল বসন্তের গুচ্ছ বীজ।
সাদা বালি, লাল বালি
বারুদ গুড়োর গুঢ় বালি
চরাচর থেকে উড়ে আমাদের জানালার গায়।
বিস্ফোরণে পুড়ে পুড়ে বাতাসের নীল কন্ঠনালী
তবু ন্যায়-নীতি মেনে কি জানাতে চায়
শুনে রাখা ভাল।
পায়ে রক্তদাগ,
সূর্যে রাহুর দাঁতের কালো ছায়া।
সন্ত্রাসের মেঘ চিরে
প্রসবব্যাথার চোখে নক্ষত্রেরা তাকিয়ে রয়েছে
কবিতার দিকে,
গায়ত্রী মন্ত্রের আলো চেয়ে।
তোমার মুখের দিকে
প্রণাম করব। কিন্তু পা কই? আগুনে ও হিমজলে পা ডুবিয়ে
এখনো তো তাঁর অফুরাণ হাঁটা
বরণ করব। কিন্তু কই সে শব্দদল যা ছুঁতে পারে
তাঁর বোধের এলাকা?
তাহলে?
জ্বলন্ত সিড়ি ভেঙে ভেঙে শিখরের দিকে যাঁর এগিয়ে চলা,
অনুজের অভ্যর্থনা কীভাবে পৌঁছবে সে অগ্রজে?
তবে কি বিশেষণ-বিড়ম্বিত স্তব কোলাহলেই শেষ হবে সে আরতি?
না। ভীষণ নীরবে চাইব এই খবরটুকু পৌঁছে দিতে শুধু-
আরো দীর্ঘতর প্রতীক্ষায় আমরা প্রস্তুত।
আরো নতুনতর বিস্ফোরণের আলোয়
উত্তাপে আবীরে ঘোর লাল হয়ে উঠুক আমাদের আকাশ।
আমরা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
তুমি মুখ ঘুরিও না।
যজ্ঞাগ্নির সামনে কী দিব্য তোমার দহন!