মানুষগুলো এবং
মানুষগুলো ফাঁকা টেবিল পেয়ে গিয়ে
ভর্তি চৌবাচ্চার মতো টলমল।
গেলাসগুলো মানুষগুলো পেয়ে গিয়ে
সাবানের ফেনায় টইটম্বুর।
আসে- আসে- মানুষগুলো হয়ে যায় ফিনফিনে গেলাস
গেলাসগুরো শ্যাগালের ছবির উড়ন্ত ছাগল।
আর টেবিলগুলো মেঘপুঞ্জময় অরন্যের গাছ।
ওয়েটারগুলো ছুটে আসে।
উড়ন্ত গেলাসগুলোকে তারা পেড়ে আনে
চাঁদনীরাতের মগডাল থেকে।
জঙ্গলের গাছ কড়া ধমকানি খেয়ে
আবার হয়ে যায় করাত-কাটা কাঠের টেবিল।
আর মানুষগুলো, যারা এতক্ষণ ছিল গেলাসের,
সোনালী মাছের মতো সাঁতার কাটে
পৃথিবীর হাড়হাভাতে হাওয়ায়।
আগুন নেভানো দমকলের ঘন্টাগুলো চেঁচিয়ে ওঠে
-কে যায়?
-আজ্ঞে আমরা,
জলজ্যান্ত দিনের বেলাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল
খুঁজতে বেরিয়েছি গোটাকতক রাতপেঁচা।
মানুষের কথা ভেবে
মানুষের কথা ভেবে গাছ দীর্ঘ হয়।
মানুষের সমাজের ধুরন্ধর নাচা-কোঁদা দেখে
মানুষের স্বভাবের মড়ক দুর্ভিক্ষ দেখে দেখে
মানুষের চেতনায় খঙ্গের আঘাত দেখে দেখে
অবোধ শিশুর মতো বহু প্রশ্ন গাছগুলি
নিজেদের দীর্ণ করেছিল
ভীষণ লজ্জিত হয়ে গাছগুলি নুয়ে পড়েছিল
গাছের সমস্ত পাতা জলের ফোঁটার মতো ঝরে
গাছের সমস্ত ছাল বেদনায় ফেটে গিয়েছিল।
আকাশের এত কাছে
তবুও মানুষ কেন আকাশের মতো সুস্থ নয়?
নক্ষত্রের এত কাছে
তবু তার রক্তশিরা
আঁধার জঙ্গল থেকে কেন শুধু খুঁটে নেয় ক্ষয়?
সমুদ্রের এত কাছে
তবু কেন এদোঁজল ঘাঁটবার প্রবণতাময়?
এইসব তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বহুদিন দীর্ণ হতে হতে
অবশেষে মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবে
মানুষের চোখে এক মূল্যবান দৃষ্টান্তের অমরতা এঁকে
পুনরায় গাছগুলি আলোকরেখায় দীর্ঘ হয়।
সাম্প্রতিক দিনকালগুলি
অনেক বিষয় নিয়ে লেখা হল। তাহলে কি বাকী?
রমনী বিষয়ে ঢের পাঁচালি হয়েছে, আর নয়।
আজকাল ফুলেরাও লজ্জা পায় স্তবস্তুতি শুনে।
মাকড়শা বা বাদুড়ের আতঙ্কজনক সব নৈপুন্যও জানা হয়ে গেছে মানুষের।
আগেকের চেয়ে ঢের মশা মাছি মোসাহেব বেড়েছে এখন।
নদী কি বেড়েছে একটিও? অথবা পাহাড়?
বরং আগের চেয়ে স্নেহভালোবাসাহীন হয়ে গেছে জল।
সূর্য আজ ভীষণ একাকী।
নিজের সাতটি ঘোড়া চলে গেছে সাতদিকে
আদা ছোলা ঘাস খুঁজে নিতে।
বেয়াড়া হয়েছে বটে সামপ্রতিক দিনকালগুলি।
হৃতসর্বস্বের মতো পার্লামেন্ট ফাঁকা করে রেখে
তার সব চেয়ারেরা মাঠে চরে। এবং চনচনে
ভোরের আলোর মধ্যে নেমে আসে চক্রান্ত গোধূলী।
আমরা মাছটি খাবো। আঁশ খাবে জনসাধারণ
মহামান্যদের মুখে এই সবই সবচেয়ে শুদ্ধতম সংলাম এখন।
সোনার মেডেল
বাবুমশাইরা
গাঁগেরাম থেকে ধুলোমাটি ঘসটে ঘসটে
আপনাদের কাছে এয়েচি।
কি চাকচিকন শহর বানিয়েছেন গো বাবুরা
রোদ পড়লে জোছনা লাগলে মনে হয়
কাল-কেউটের গা থেকে খসেপড়া
রুপোর তৈরি একখান্ লম্বা খোলস।
মনের উনোনে ভাতের হাঁড়ি হাঁ হয়ে আছে খিদেয়
চালডাল তরিতরকারি শাকপাতা কিছু নেই
কিন্তু জল ফুটছে টগবগিয়ে।
বাবুমশাইয়া,
লোকে বলেছিল, ভালুকের নাচ দেখালে
আপনারা নাকি পয়সা দেন!
যখন যেমন বললেন, নেচে নেচে হদ্দ।
পয়সা দিবেন নি?
লোকে বলেছিল ভানুমতীর খেল দেখালে
আপনারা নাকি সোনার ম্যাডেল দেন।
নিজের করাতে নিজেকে দুখান করে
আবার জুড়ে দেখালুম,
আকাশ থেকে সোনালি পাখির ডিম পেড়ে
আপনাদের ভেজে খাওয়ালুম গরম ওমলেট,
বাঁজা গাছে বাজিয়ে দিলুম ফুলের ঘুঙুর।
সোনার ম্যাডেল দিবেন নি?
বাবুমশাইরা
সেই ল্যাংটোবেলা থেকে বড় শখ
ঘরে ফিরবো বুকে সোনার ম্যাডেল টাঙিয়ে
আর বৌ-বাচ্চাদের মুখে
ফাটা কাপাসতুলোর হাসি ফুটিয়ে বলবো
দেখিস্! আমি মারা গেলে
আমার গা থেকে গজাবে
চন্দন-গন্ধের বন।
সোনার ম্যাডেল দিবেন নি?
স্বপ্নগুলি হ্যাঙ্গারে রয়েছে
মুহূর্তের সার্থকতা মানুষের কাছে আজ
বড় বেশি প্রিয়।
জীবনের স্থাপত্যের উচ্চতা ও অভিপ্রায়মালা
ছেঁটে ছোট করে দিতে
চতুর্দিকে উগ্র হয়ে রয়েছে সেলুন।
মানুষের ভাঙা-চোরা ভুরুর উপরে
চাঁদের ফালির মতো
আজ কোনো স্থির আলো নেই।
ছাতার দোকানে ছাতা যে-রকম ঝোলে
সেইভাবে মানুষের রক্ত ও চন্দনমাখা স্বপ্নগুলি
হ্যাঙ্গারে রয়েছে।
৭নং শারদীয় উপন্যাস
একটি কিশোর তার চ্যাটালো হাতের টানে আগাছা উপােয়
তার বৌ মরাছেলে কাঁখে নিয়ে ধান ভানে তিনবেলা উপোসের পর
একটা মাটির হাঁড়ি একমুঠো চাল পেয়ে দশজনের ফ্যান-ভাত রাঁধে
এই দৃশ্য ৭নং শারদীয় উপন্যাস হবে না কখনো।
৭নং শারদীয় উপন্যাস হতে গেলে কি কি থাকা চাই
৭নং শারদীয় উপন্যাস লিখতে পারে কে কে কুসি-গীর
তার জন্য কমিটি ও কমিটির প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, ম্যানেজার আছে
কার্পেট-রাঙানো ঘরে ক্লোজ-ডোর কনফারেন্স আছে।
মানুষ ভীষণ দুঃখে আছে, আহা, বড় কষ্টে আছে
বদ্যিনাথবাবু, আপনি রামধনু গুলে এই দুঃখ কষ্ট ঘোচাতে পারেন?
আপনার খিচুড়িটা শশীবাবু, গতবারে ঈষৎ আনুনো হয়েছিল।
আপনি কি সেকসের মধ্যে ধম্মোটম্মো মেশাবেন সখারামবাবু?
মধুবাবু, আপনি তো কেল্লা ফতে করেছেন গতবারে ন্যাংটো নাচ নেচে।
পাঁচকড়িবাবু, আপনি এবারে পাড়-ন তো একটা ইয়া বড় মাকড়সার ডিম।
এমন ক্লাসিক কিছু রচনা করুন যাতে কোনোরূপ মোদ্দাকথা নেই।
একটি শ্রমিক তার ফাটা প্যান্ট খুলে রেখে ছেঁড়া লুঙি পরে
তার বৌ একমাথা উকুন চুলকিয়ে নিয়ে বেচতে যায় ঘুঁটে
উনোনের পাড়ে বসে একগুচ্ছ মরা হাড় আগুনের স্বাদ খুঁটে খায়
৭নং উপন্যাস জীবনের এইসব ভাঙচুর লিখে ফেলে যদি
৭নং উপন্যাসে হঠাৎ ঘামের সঙ্গে রক্ত মিশে অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায় যদি
৭নং উপন্যাস যদি সব জাহাবাজ ঈশ্বরের খড়ে ও দড়িতে মারে টান
সেই ভয়ে ছয়খানা উপন্যাসে তৃপ্ত হয়ে আছে পুরু শারদীয়াগুলো।