- বইয়ের নামঃ প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ
- লেখকের নামঃ পূর্ণেন্দু পত্রী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষরমালার কাছে
অক্ষরমালার কাছে নতজানু হয়ে আছি আমি।
পুরনো এবং ছেঁড়াখোড়া শাড়ি-জামা-পাজামার বদলে
আমার স্ত্রী কিনে থাকেন ঝকঝকে বাসন।
মহৎ কিংবা রক্তিম আলোর ভাবনা
বেচতে আসে না কোনো ফেরিওয়ালা
সুতরাং নিজের হাতেই আমাকে খসাতে হয় নিজের ফাটল,
নিজের রক্তপাতের মাজাঘসায়
বাসী বাসনকে ঝকঝকে করতে হয় এটো-কাটা সরিয়ে।
এইভাবে
অক্ষরমালার কাছে নতজানু হয়ে আছি আমি।
অতিক্রম করে যাওয়া
অতিক্রম করে যাওয়া শিল্পের নিয়ম
ঘুটের ছাপের মতো
ক্ষতচিহ্নে ছেয়ে গেছে জীবন, সময়
রক্তের জানালা ভেঙে
তবু সূর্যকরোজ্জাল বাঁশি ডেকে যায়
ঝড়ের রাতের অভিসারে।
অতিক্রম করে যাওয়া
জীবনেরও নিশ্চিত নিয়ম।
পাহাড়ের চুড়োগুলো অতিক্রম করে গেছে
মেঘ।
কোনার্ক-রথের চাকা
বিংশ শতাব্দীর সীমা অতিক্রম করে চলে যায়
আরো দূর শতাব্দীর কাছে।
তুমি খুব ভালোবেসেছিলে
তুমি খুব কাছে এসেছিলে।
এখন তোমারও সৌধ ভেদ করে
চলে যেতে হবে
আরো বড় বেদনার
আরো বড় আগুনের আরতির দিকে।
আগুনের কাছে আগে
হৃদয়ের কাছে আমি আগে কত গোলাপ চেয়েছি
এখন পাউরুটি চাই, সিমেন্টের পারমিট চাই।
সেই রমনীর কাছে আগে কত ভূ-স্বর্গ চেয়েছি
এখন দেশলাই চাই, হাতপাখা, জেলুসিল চাই।
আগুনের কাছে আগে মানুষেরা নতজানু ছিল।
মানুষের সর্বোত্তম প্রার্থনায় বিস্তীর্ণতা ছিল:
আমাকে এমন জামা দাও তুমি, এমন পতাকা
হীরের আংটির মতো মূল্যবান এবং মহান।
আগুনের কাছে এসে এখন মানুষ করযোড়ে
ভোট চায়, কমিটির ডানলোপিলো-আঁটা গদি চায়
মহিষাসুরের নীল খড়্গ চায়, অথবা পিস্তল।
মানুষ মেঘের কাছে আগে কত কবিতা চেয়েছে
এখন পেট্রোল চায়, প্রমোশন, পাসপোর্ট চায়।
আত্মচরিত
আমার বয়স ৪৮।
আমার মাথার প্রথম পাকা চুলের বয়স ২০।
এবং আমার স্নায়ুতন্ত্রীর ভিতরে স্তবকে স্তবকে সাজানো যে-সব স্মৃতি
তারা খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০০ বছরের চেয়ে পুরনো।
সর্বক্ষণ পাঁজবার আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকে যে-বিষাদ
একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, কত বয়স হলো হে?
বললে, ২০০৬ এর কাছাকাছি এলে কানায় কানায় ৭০০ বছর।
কেননা দীর্ঘ বিদীর্ণ দান্তে নিজের রক্তে কলম ডুবিয়েছিলেন
আনুমানিক ১৩০৬ এ, লা দিভিনা কোমমেদিআ-র জন্যে ।
স্তম্ভ এবং তরবারির বিরুদ্ধে
আমি নয়, কেননা আমি খুব বিনীত, প্রায় লতানে গাছের মতো নম্র
এমন কি যে-কেউ যখন খুশী মচকে দিতে পারে এমনই রোগা পটকা,
স্তম্ভ এবং তরবারি এবং যে কোনা সুপারসোনিক গর্জনের বিরুদ্ধে
আমি নয়, আমার ভিতর থেকে তেড়ে ফুঁড়ে জেগে ওঠে
কামান বন্দুকের মতো শক্ত সমর্থ এক যুবক।
ঐ যুবকটির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিলো চতুর্দশ লুয়ের আমলে
১৭৮৯ এর প্যারিসে, বাস্তিল দুর্গের দরজার সামনে।
আমার বয়স ৪৮ কিংবা ৪৯।
কিন্তু আমার ভালোবাসার বয়স ১৮।
যেহেতু আকাশের সমস্ত নীল নক্ষত্রের প্রগাঢ় উদ্দীপনার বয়স ১৮।
যেহেতু পৃথিবীর সমস্ত রুপসী নারীর
জ্যোৎস্না এবং অগ্ন্যুৎপাতের বয়স ১৮।
আমরা
মৃত্যুর মুহুর্ত আগে
‘সভাতার সংকট’ এর মতো তীব্র রক্তাক্ত আগুন
নিজের পাঁজনে যিনি জালিয়েছিলেন,
আমরা তাঁহারই যোগ্য বংশধরগুলি
দৈনিকের মাসিকের বার্ষিকের নিউজপ্রিন্টের
হলুদ মাঠের পরে গান্ডীবের ভাঙা বাঁট নিয়ে
খেলিতেছি অপূর্ব ডাংগুলি।
আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সাইকেল রিকশায় চেপে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সুর্যের নিকটে।
যেহেতু আমার সাদা গাড়ি নেই, রণ-পাও নেই
যেহেতু আমার লাল গাড়ি নেই, বকস-আপিস নেই
যেহেতু আমার নীল গাড়ি নেই, পদোন্নতি নেই
সাইকেল রিকশায় চেপে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সূর্যের নিকটে।
মানুষ ও আকাশের মাঝখানে কোনো ব্রীজ নেই
পাড়াগাঁয়ে যে-রকম বাঁশের নরম সাঁকো থাকে।
শিরীষ ছায়ায় ঢাকা একফালি স্টেশন অথবা
খুব সরু বাস স্টপও নেই কোনো নক্ষত্রের কাছে পৌছবার।
হঠাৎ জরুরী কোনো ইনজেকশন নিতে হয় যদি?
হঠাৎ বোধের নাড়ি ছিড়ে যদি রক্তপাত হয়?
হঠাৎ বিশ্বাস যদি নিভে যায় মারাত্মক ফুঁয়ে?
মানুষ তখন কার কাছে গিয়ে বলবে- বাঁচাও?
যেহেতু আমার সাদা সুটকেশে সব আছে, অগ্নিকণা নেই
যেহেতু আমার নীল পাসপোর্ট সব আছে, অস্ত্রাগার নেই
যেহেতু আমার খাঁকী হোল্ড-অলে সব আছে, অমরতা নেই
সাইকেল রিকশায় চেপে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে
সূর্যের নিকটে।
আমি আছি আমার শস্যে বীজে
আর কী দিয়ে পূর্ণ করবে তুমি
শূণ্য আমার খাঁচা?
যার সমস্ত লুট হয়েছে তারও
ফুরোয়নি সব বাঁচা।
কলসী থেকে খেয়েছো শুষে জল
আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছো মখমল
বিছানা থেকে কেড়েছো কম্বল
দুধের থেকে সর
আকাশে-মেঘে রটিয়ে বেড়াও তবু
-আমিই তো ঈশ্বর।
নিজের ঘাস চিবিয়ে খাও নিজে
আমি আছি আমার শস্যে, বীজে
তোমাকে আর দরকারই বা কী যে
দগ্ধ এ উদ্যানে।
সর্বস্বান্ত হয়েও তো কেউ কেউ
বাঁচার মন্ত্র জানে।
কথা ছিল না
কাল রাত্তিরে
সূর্যের মুখে ফুটে উঠেছিল
হো চি-মিনের হাসি।
অথচ কাল রাত্তিরে
সূর্য ওঠার কথা ছিল না।
পরশু বিকেলে
সাত বছরের কালো গোলাপটা
থেতলে গেল
ইস্পাতের লরীতে।
অথচ কালো গোলাপটার
ফুটপাথে ফোটার কথা ছিল না।
আজ সকালে
বন্দুকের শব্দে সাদা হয়ে গেল
সবুজ বন।
অথচ মানুষের মুঠোয়
বন্দুক থাকার কথা ছিল না।