Site icon BnBoi.Com

তুমি এলে সূর্যোদয় হয় – পূর্ণেন্দু পত্রী

by Purnendu Pattrea

আত্মচরিত ০১

যখন ছ’সাত বছর বয়স
ঈশ্বর আকাশে কাঁপতেন কখন কী করে বসি
তাঁর নিপুণ সংসারে।
এক একটা আস্ত পুকুর এবং গগুুষে গিলে
আবার অন্য পুকুরে রুই কাতলার ভিতরে ডুবসাঁতার।
জল থেকে উপড়ে আনা শালুক ছিল
অবিকল রাজকন্যের মুখ।
এখন চল্লিশ।
এখন রক্তক্ষরণের শব্দে বুকের নিশ্বাস নিভে যায়।
যখন সাত-আট বছর বয়স
ঝকঝকে চোখ বলিদানের কাতান
বুকে ঢাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা দিনরাতের পুজো পার্বণ
পা দুটো রাণা প্রতাপের চৈতক
চৈত-বোশেখের ঝড়ে কেবল ছুটছে ব্রক্ষান্ডের গায়ে লাথি মেরে।
ঈশ্বর সারাটা দুপুর আকাশে থাকতেন পাহারায়,
পাছে ঐ দুর্দান্ত বয়সটা আকাশের পথ চিনে ফেলে।

এখন চল্লিশ।
এখন নিশ্বাসের ভিতর কেবল স্বপ্নের দরজা ভাঙে।

যখন আঠারো বছর বয়স
দীর্ঘকার এক মন্দির তুলেচিলাম নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে
তার ভিতরে ধুপ, ধুপের ভিতরে পুস্পগন্ধ, পুস্পের ভিতরে নারী
নারীর ভিতরে আকাশময় ওষ্ঠ, ওষ্ঠের ভিতরে কেবল প্রবহমান চুম্বন।

এখন চল্লিশ।
এখন স্বপ্নের ভিতরে ঈশ্বরের তুমুল অট্রহাসি।

আত্মচরিত ০২

বৃষ্টি এলে ষোলো বছর বয়সটা ভিজতে ভিজতে
ফিরে আসে আবার।
পায়ের তলায় বন্যার জল, রুপোর মল পরা ঢেউ
মখমল মাটি, শামুক, কাটা, পায়ের রক্তের দাগ,
সব ফিরে আসে আবার।
কার যেন ভিজে চুলের ডাকাডাকি, আকাশময়
যেন একটাই কাজর-পরা চোখ।
চাঁপা ফুলের গন্ধ পুড়তে থাকে দুপুরবেলার রোদে
আমি তার হাহাকারের হাত ধরে ঘুরে বেড়াই।
সেই হাহাকার কতবার তোমার ভেজানো ঘরের দরজার
শিকল ধরে দিয়েছে টান
আঁচলটুকু ধরতে দিয়ে বাকি সব লুকিয়ে রাখতে
লজ্জার কৌটোয়,
চোখের আয়নায় একটু মুখ দেখতে দিয়ে বাকি সব।
সেন্টমাখানো রুমাল কোমরে গুঁজে
স্বপ্নে বেড়াতে আসতে রোজ ।
স্বপ্নে আঁচলহীন ছিলে তুমি।
স্বপ্নে লজ্জাহীন ছিল গোপন চিঠির খসড়াগুলো।
দিনের আলোয় তাদের অশ্নীলতা
ছেঁড়া পাতা হয়ে উড়ে যেতো বাজবরণের ঝোপে।

বৃষ্টি এলে ষোলো বছর বয়সটা ফিরে আসে আবার
আবার আকাশময় এক কাজলপরা চোখ।

আত্মচরিত ০৩

স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে।
মাথায় আঁটা বটের পাতার মুকুট,
খোলামকুচি ধুলোর তেপান্তরে
ছুটছে তার পক্ষীরাজ ছুটুক।
রাজার ছেলে ময়লা পেন্টুলুন
তল্‌তাবাঁশের কঞ্চি ধনুর্গুণ
ধুলোয় তার বিপুল রাজ্যপাট
বুকের মধ্যে রাজকুমারীর খাট।
কাজল চোখে বিস্ময়ের ঘোর
আকাশে আঁকা মনের ঘর-দোর।

পালক পড়ে পিছন পানে পলক পিছন পানে যেই
কত সকাল সাঁঝের দেখি বর্ণ গেছে হিমে ভিজে বর্ণমালা নেই।

তখন ছিল পিদিম জ্বালা ঘর
বয়স ছিল সোহাগে তৎপর।
বয়সে ছিল মৌমাছিদের ক্ষুধা
মুড়ির সঙ্গে গুড় মিশলেই সুধা।
চোখের সঙ্গে চোখ মিললেই ঝড়।
প্রতিদিনই পালকী-চাপা বর।
তখন ছিল নিত্য খোঁজাখু্বঁজি
আকাশ-পাতাল সিন্দুকের চাবি
কড়ির বয়েম। কেবল ভাবাভাবি
ভীষণ কিছু হারিয়ে যাচ্ছে বুঝি।
গাছ খুঁজতে ফুলের থোকা থোকা
ফুল খুঁজতে গিয়ে বিষম বোকা
ফুলের মতো ফুটল কবে ঐ
কাল যে ছিল এক সাঁতারের সই।

হরিণ কবে চাউনি দিল ওকে?
ঘুমিয়ে পড়ি হরিণ-হারা শোকে?

জলে সাঁতার জলে শালুক জলের মধ্যে গুলি-সুতোয় গোপন টেলিফোন।
এখন শুধু ডাঙায় হাঁটা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে জ্বলের নিকেতন।

স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে।
হারিয়েছিলাম ঈশানকোণী ঝড়ে
বিদ্যুতের বিপুল টর্চ জেলে
পৌঁছে দিয়ে গেছে আকাশ ঘরে।
তখন ছিল হারিয়ে যাওয়ার সুখ
হারিয়ে গিয়ে বনের মধ্যে বন
পাতায় পাতা। দিগন্তে উৎসুক
দিন দুবেলার সবুজ নিমন্ত্রণ।
নরম মাটি, শক্ত গাছের ঘাড়ে
কাঠের বেঞ্চে, বাজবরণের ঝাড়ে
খোদাই করে লিখেছিলাম নাম ।
সরলতার ছুরিতে ক্ষুরধার।
চোখের ভাঁজে ভালো মানুষ ভান
রক্তে নাচে রঙীন অত্যাচার।

খাতার পাতা আকাশে ঘুড়ি খাতার পাতা হালকা জলে নৌকা হয়ে নাচে
দুপুর রোদে গা ডুবিয়ে খাতার পাতা পৌঁছে দেওয়া ঝড়-বাদলের কাছে।

তখন ছিল নানান না-এর বেড়া
দেউড়ি-দালান নিষেধ দিয়ে ঘেরা।
না যেখানে সেইখানেতেই ঘাঁটি
পাঁচিল ভেঙে সরল হাঁটাহাঁটি।
আঁচল দিয়ে আড়াল যত কিছু
চোখের চলা কেবল তারই পিছু।

ছুঁতে গিয়ে সরলো যদি কেউ
সাপের ফণা অভিমানের ঢেউ।
অভিমানের সকল জাগা জুড়ে
ক্রমশ বাড়ে একলা হতে থাকা
সন্ন্যাসীর রাগের রোদে পুড়ে
সরল তৃণ খড়্গসম ক্রোধ
একলা হওয়ার দুঃখজনক বোধ।
একলা গাছে একলা পাখি ডাকে।
একলা গাছে একলা ফোটায় ফুল
ছায়ার মধ্যে ছড়িয়ে এলোচুল
একলা এক রুপসী শুয়ে থাকে
বাগানজুড়ে, বসতবাটি, ভুঁই।
তাকে পেলেই একলা আমি দুই।

হারিকেনের আলোয় কাঁপে সজনে পাতায় শিরশিরোনো একলা হিমের রাত
পদ্য লেখার পাতায় কেবল জ্যেৎস্না হয়ে ফুটতে থাকে সকল অসাক্ষাৎ।

স্মরণাতীত জীবন মনে পড়ে।
কাঁসর-ঘন্টা বিপুল ঐকতান
হ্যাজাক-জালা চাতালে চত্বরে
রাসমঞ্চ, গাজন, পালাগান।
গানের মধ্যে গর্জে ওঠে মন
ভাঙতে হবে শিকল ঝনাৎঝন
খুলতে হবে গুপ্তধনের তালা।
বুকের মধ্যে ব্যখার ডালপালা
হাঁকিয়ে তোলে ঝাঁকড়া চুলের ঝড়।
ভিক্ষা নয়, ঘোষণা অতঃপর।
কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি মুঠো
ভালোবাসার সামান্য খড়কুটো।
কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি ক্ষুধা
স্পর্শ, গন্ধ, পরিতৃপ্তির সুধা।
কে দেবে দাও মেলেছি জাগরণ
সার্থকতা, সোনার সিংহাসন।
দিল কি কেউ?দেয়নি বুঝি সব।
ঘোচেনি আজো মনের আর্তরব।

প্রতিধ্বনি, প্রতিধ্বনি, তুমি তো ছিলে আবাল্যকাল সঙ্গী রাত্রিদিন।
কার কাছে কি পাওনা আছে জানিয়ে দিও, কার কাছে কি ঝণ।

আত্মচরিত ০৪

নতজানু হয়ে কারো পদতলে বসি, ইচ্ছে করে
অকপটে সব কথা তার সাথে বলাবলি হোক।
খুলে দিই কপাটের খিল
পর্দার আড়াল, ঘন বনবীথি ছায়া, ভিজে ছায়া
নোনাধরা পুরনো পাঁচিন
দেয়ালে কামড়ে থাকা সুপ্রাচীন ঘন অন্ধকার
স্যাঁতলার নানাবিধ মুখভঙ্গী, ফাটলের দাগ
তেল ও জলের দাগ, পান পিক, পিপাসার দাগ
সব চিহ্ন, সব ছারখার
সমস্ত গোপন দুঃখ শোক
অকপটে বলাবলি হোক।

আমাদের কতটুকু প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর?
নিজস্ব জননী ছাড়া আমরা কি আর কারও সাধের সন্তান?
আর কারও প্রিয় প্রয়োজন?
সদ্ভাবে ও স্নেহে কারো ভ্রাতা?

আমরা অসুস্থ হলে কোনখানে খুঁজে পাব ত্রাতা?
অবশ্য এ পৃথিবীর বহু জল, মাটি, ধুলো, রোদ, বৃষ্টি, ঘাস
টেনে ছিঁড়ে লুটেপুটে আমরা করেছি ক্ষয়, অপচয় গ্রাস।
তখন ধারণা ছিল আমাদেরই করতলে ভুবনের সব চাষ-বাস।
পৃথিবীর বুকের ভিতরে
উজ্জয়িনী আরেক পৃথিবী
আমাদেরই গড়ে দিতে হবে চমৎকার।
আরেক রকম দেশ, রাজধানী, সমৃদ্ধ নগর
আটচালা, পাঠশালা, স্কুল
খালে জল, মাঠে ধান, ব্রীজ, সাঁকো, বিদ্যুৎ, বাজার
স্টেশনের ডান দিকে শিরীষ গাছের ডালে লুটোপুটি ফুল
উৎসবের মতো দিন
মন্ত্রোচ্চারণের মতো মানুষের মুগ্ধ কন্ঠস্বর
সারা ভু-মণ্ডল জুড়ে একখানি ঘর।
মাটির আঁতুড় ঘরে জন্মলগ্নে ছিল ম্লান প্রদীপের শিখা
আকাশে জ্যোৎস্নার অহমিকা।
শৈশবে ছিল না রথ
ছিল রুক্ষ, রুঢ় তেপান্তর
শৈশবেই জেনে গেছি ঝড়ে ওড়ে কতখানি খড়
ক’খানা সংসার ভাসে কোটালের বানে।
কারা ভাত খাবে বলে কারা ধান ভানে।

অনেক ভিখারী ছিল পথে পথে, কালো কালো হাত
চর্তুর্দিকে হাতড়ায়, যদি পায় কোনখানে সুখের সাক্ষাৎ।
অনেক ভিখারী ছিল, তারা ভিন্ন লোক
ভিন্ন ক্ষুধা, ভিন্নতর সন্ধান ও শোক
ভিন্ন প্রতিজ্ঞায় তারা বেঁধেছিল হাতে রক্তরাখী
যতক্ষণ স্বাধীনতা বাকি
ততক্ষণ রণ।

মৃত্যুতে মহিমাময় হয়ে গেছে তাদের জীবন।
সেই সব মৃত্যুঞ্জয়ী ভিখারীর বংশধরগণ
আজ সোফা, সিগারেট, এয়ারকুলার, সিমেন্টের
সুগন্ধী সেন্টের,
পেট্‌রোলের, ইনকাম ট্র্যাক্সের দুমুখো খাতায়
অম্লান, অপরিসীম কত সুখ পায়।

বহু সুখী দৃশ্যপট দেখা হল, বহু গৌরবের
মানুষও গাছের মতো কত গন্ধ ছড়ানো আকাশে
গ্রহে, উপগ্রহে, শুন্যে, মহাশুন্যে মরুভুমিতলে
কল্পনার, কৃতিত্বের সার্থকতা আর সৌরভের।

কত রক্তপাতময় দৃশপটও দেখা হল বিমুঢ় লজ্জায়।
হাড়ের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল চুরি
স্বাভাবিক মানবতা তামার তারের মতো রোজই হল চুরি।
কত ট্রেন থেমে গেল অনাদৃত, অজ্ঞাত স্টেশনে।
অচরিতার্থতাবোধ প্রসব ব্যথার মতো রয়ে গেল স্থির
মানুষের চেতনার গর্ভের আঁধারে।

আমার সকলই আছে জামা জুতো, ছাতা, টেরিলিন
মেডেল ও মেডেলকে ঝোলাবার সরু সেফটিপিন
মাসান্তে মাসান্তে পে-প্যাকেট
তাতে কেনা হয়ে যায় গ্রীষ্মের বাতাবিলেবু, শীতের জ্যাকেট।
ভিখারীর হাত পেতে আরও কিছু পেয়ে যাই একানি দুয়ানি
বিভিন্ন দয়ালু ব্যক্তি ছুঁয়ে দেয় ছেঁড়া কাঁথাকানি।
নিজের ঘামের নুনও চেটে খাই, পরিতৃপ্ত গাল,
বাহিরে যে থাকে সে তো অসি’সার আজন্ম কাঙাল।
বাহিরে ভিখারী কিন্তু সম্রাট রয়েছে অভ্যন্তরে
লুব্ধ চুরি রক্তে খেলা করে।
উচ্চাকাঙ্খী আঙ্গুলের গাঁটে গাঁটে ছিনতায়ের লোভ
পান থেকে চুন গেলে প্রচণ্ড বিক্ষোভ।

যে দিকে সুন্দর আছে, সুষমামন্ডিত শিল্পলোক
যে দিকে নদীর মুখ, পর্বত চুড়ার অভ্যুদয়
ঊর্ধ্বলোক চিনে নিয়ে যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে বীজ বনস্পতি হয়
যে সিন্দুকে ভরা আছে পূর্বপুরুষের রাত্নাগার
যে ওষ্ঠের মন্ত্রপাঠে ধ্রুবপদ বাজে বারবার
বাতাসকে গন্ধ দেয় যে সকল আত্ম ও শরীর
সব চাই, সব তার চাই
আগুনের সব শিখ, সব দগ্ধ ছাই।

কাকে পাপ বলে আমি জানি
কাকে পুণ্যজল বলে জানি
মুকুটের কাঁটা কয়খানি।
অভিজ্ঞতায় বৃদ্ধ, আবেগে বালক,
জাত গোত্রহীন হয়ে ভেসে আছি সময়ের নাড়ীর ভিতরে
উলঙ্গ পালক।

আরশিতে সর্বদা এক উজ্জল রমনী

আরশিতে সর্বদা এক উজ্জল রমণী বসে থাকে।
তার কোনো পরিচয়, পাসপোর্ট, বাড়ির ঠিকানা
মানুষ পায়নি হাত পেতে।

অনুসন্ধানের লোভে মুলত সর্বতোভাবে তাকে পাবে বলে
অনেক মোটর গাড়ি ছুটে গেছে পাহাড়ের ঢালু পথ চিরে
অনেক মোটর গাড়ি চুরমার ভেঙে গেছে নীল সিন্ধুতীরে
তারও আগে ধ্বসে গেছে শতাধিক প্রাসাদের সমৃদ্ধ খিলান
হাজার জাহাজ ডুবি হয়ে গেছে হোমারের হলুদ পাতায়।

আরশির ভিতরে বসে সে রমণী ভ্রু-ভঙ্গিতে আলপনা আঁকে
কর্পুর জলের মতো স্নিগ্ধ চোখে হেসে বা না হেসে
নানান রঙ্গীন উলে বুনে যায় বন উপবন

বেড়াবার উপত্যকা, জড়িয়ে ধরার যোগ্য কুসুমিত গাছ
লোভী মাছরাঙা চায় যতটুকু জল আর মাছ
যতটুকু জ্যোৎস্না পেলে মানুষ সন্তুষ্ট হয় স্নানে।

স্নানের ঘাটে সে নিজে কিন্তু তারও স্নান চাই বলে
অনেক সুইমিং পুল কাপেট বিছানো বেডরুমে
অনেক সুগন্ধী ফ্ল্যাট পার্ক স্ট্রীটে জুহুর তল্লাটে
ডানলোপিলোর ঢেউ ডাবলবেডের সুখী খাটে
জোনাকী যেভাবে মেশে অন্ধকারে সর্বস্ব হারিয়ে
প্রভাতে সন্ধ্যায় তারা সেইভাবে মিলেমিশে হাঁটে।

বহু জল ঘাঁটাঘাঁটি স্নান বা সাঁতার দিতে দিতে
মানুষেরা একদিন অনুভব করে আচম্বিতে
যে ছিল সে চলে গেছে নিজের উজ্জল আরশিতে।

প্রাকৃতিক বনগন্ধ, মেঘমালা, নক্ষত্রের থালা
কিংবা এই ছ’রকম ঋতুর প্রভাবে
এত নষ্ট হয়ে তবু মানুষ এখনও ভাবে সুনিশ্চিত তাকে কাছে পাবে
কাল কিংবা অন্য কোন শতাব্দীর গোধুলি লগনে
কলকাতায়, কানাডায় অথবা লন্ডনে।

কাকে দিয়ে যাব

কাকে দিয়ে যাব এই জলরাশি, দুকুল প্লাবন
কাকে দিয়ে যাব ভাঙা তীর
বিপদসংকুল বাঁশী যদি বাজে মধ্যরাত চিরে?
কে নেবে অঞ্জলি ভরে এই জল, পিছল সংসার
অসুখের মতো এই রক্তচিহ্নহীন ধুসরতা?
সুয়ে, শুয়ে, ভেঙে পড়ে বৃক্ষ, তরুলতা
যাদের শিকড় ছিল মাটির গভীরে বদ্ধমুল,
রক্তজাত ফুল
আকাশকে উপহার দিয়েছে প্রত্যেক শুভদিনে
পৃথিবীকে উপভোগ্য স্নেহ ও মমতা।
মহীরুহ শুয়ে আছে ঘাসে,
সোঁদা গন্ধ সরল বিশ্বাসে।
কাকে দিয়ে যাব এত ক্ষত, অক্ষমতা?

যে নেবে সে জয়ী হবে জানি
যে নেবে সে বিপন্নও হবে।

কেউ ভাল না বাসলে

কেউ ভাল না বাসলে আর লিখব না
কবিতা।
কত ভালবাসা ছিল বাল্যকালে।
পুকুর ভর্তি এলোচুলের ঢেউ
কলমীলতায় কত আলপনা
কত লাজুক মুখের শালুক
যেন সারবন্দী বাসরঘরের বৌ।
এক একটা দুপুর যেন
রূপসীর আদুল গা
রাত্রি কারো চিকন চোখের ইশারা।

সর্বনাশের ভিতরে কত ছোটাছুটি ছিল
বাল্যকালে
জ্যোৎস্নার আঁচল ধরে কত টানাটানি ছিল
বাল্যকালে
জরির পাড় বসানো কত দিগদিগন্ত ছিল
বাল্যকালে।

কেউ ভাল না বাসলে আর লিখব না
কবিতা।

কেবল আমি হাত বাড়ালেই

হাওয়া তোমার আঁচল নিয়ে ধিঙ্গীনাচন করলো খেলা
সকাল বিকেল সন্ধেবেলা
চোখের খিদের আশ মেটালো লস্পটে রোদ রাস্তা ঘাটে
যখন হাঁটো সঙ্গে হাঁটে
বনের পথে হাঁটলে যখন কাঁটাগাছে টানলে কাপড়
চ্যাংড়া ছোঁড়ার ফাজলামিকে ভেবেছিলাম মারবে থাপড়।
একটা নদীর লক্ষটা হাত, ভাসিয়ে দিলে সর্বশরীর
লুটপাটেতে ছিনিয়ে নিলে ওষ্ঠপুটের হাসির জরির
জেল্লাজলুস।
কেবল আমি হাত বাড়ালেই, মাত্র আমার পাঁচটা আঙুল,
তোমার মহাভারত কলুষ।

রক্তে মাংসে মনুষ্যজীব, সেই দোষেতেই এমন কাঙাল।
কিন্তু তোমার খবর নিতে আমার কাছেই আসবে ছুটে
অনন্তকাল।

ক্রেমলিনে হঠাৎ বৃষ্টি

অপর দেশের রোদে ভেসে আছি বিহ্বল বাতাসে
অকস্মাৎ ক্রেমলিনের চুড়ো থেকে বৃষ্টি ছুটে আসে।
সুতীব্র শীতের ঢাল, শত শত তীর, পথে হঠাৎ ঘেরাও।
কে তুমি হে? কোন দেশী?
জারের প্রাসাদ ভেঙে কোথা যেতে চায়?
আমি গুপ্তচর নই, বৃষ্টিকে বোঝাই কানে কানে;
ওরে তোর অস্ত্রশস্ত্র থামা,
উৎসুক অতিথি, যদি তুলে নিস হুকুমৎনামা
একটু ভিতরে যাই
পাথরের পাহারার ঘোমটা তুলে তাকাই খানিক
অনির্বচনীয়তার প্রতিমাকে ছুঁয়ে দেখি
কত মাটি, কতটা মানিক।
নদীতেই নদী থাকবে, গাছ থাকবে গাছে
রাজার মুকুটে মুক্তো, রাজ্যপাট শৃঙ্খলা সংসার
সব থাকবে যে যেখানে আছে।
শুধু তোরা সুদুরে পালালে
কিছু স্মতি, কিছু গন্ধ মেখে নিয়ে যেতে পারি
আমার রুমালে।
দোভাযিয়া ইভানোভা কাছে এসে যেই ছাতা খোলে,
তুলে নেয় বৃষ্টি অবরোধ,
ক্রেমলিনের নীলাকাশে রোদ।

জনৈক ক্ষিপ্তের উক্তি

এই তো আমার ক্ষিপ্ত হবার সময় এলো।

মুঠোখানেক বৃষ্টি নিয়ে রোদকে ছুঁড়ে মারতে পারি
গঙ্গাজলকে বলতে পারি, সরে দাড়াঁও, ওপার যাবো।
ও কলকাতা হে কলকাতা
নেয়াপাতি ডাবের মাথা
সবকটাকে ঝুনো করে উকুন দিয়ে চষতে পারি।

এই তো আমার ক্ষিপ্ত হবার সময় হলো।

হাড়ের মধ্যে শুকাচ্ছে ঘি
পাঁজরা খুলে কার হাতে দি
চোখ জ্বেলেছে যজ্ঞশালা এবার তবে জপেই বসি
উপবীতটা হারিয়ে গেছে জলে কিংবা জনস্রোতে
নইলে দেখতে ব্রক্ষ্মশাপে ভস্ম হতো বিশ্বভূবন।

এই তো এলো ক্ষিপ্ত হবার বিকেলবেলা।

হাতের মুঠোর রঙের শিশি পাঁচটা আঙুল পাঁচটা তুলি।
বুলিয়ে দিলেই আকাশটা লাল
বাতাসটা নীল কালচে সকাল
সবাই যেমন রগড় খুঁজছে তেমনি রগড় জুড়তে পারি।
গেরস্থ হে, ঘুমোতে যাও, বিছানা আছে হ্যাংলা হয়ে।
এখন আমি ভাঙবো তালা
সিধকাঠিতে বুকের জ্বালা
আকাশ জোড়া সোনার থালা না যদি পাই মরতে পারি।

তাজমহল ১৯৭৫

বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
বহুদিন মণিমুক্তো, মহফিল, তাজা ঘোড়া, তরুণ গোলাপ
এবং স্থাপত্য নিয়ে ভাঙাগড়া সব ভুলে আছো।
সর্বান্তঃকরণ প্রেম, যা তোমার সর্বোচ্ছ মুকুট, তাও ভুলে গেছো নাকি?
পাথরের ঢাকনা খুলে কখনো কি পাশে এসে মমতাজ বসে কোনোদিন?
সুগন্ধী স্নানের সব পুরাতন স্মৃতিকথা বলাবলি হয় কি দুজনে?
জানি প্রতি জোৎস্নারাতে তোমার উঠোনে বড় ঘোর কলরব
ক্যামেরার কালো ভীড়, আলুথালু ফুতিফার্তা, পিকনিক, ট্রানজিসটারে গান
তবু তো যমুনা সেই দুঃখের বন্ধুর মতো কাছাকাছি ঠিকই রয়ে গেছে।
হারানো উদ্যানে গাঢ় মেলামেশা মনে পড়ে গেলে
দুজনে কি কোনোদিন বেরিয়েছ নিমগ্ন ভ্রমণে
আকাশ ও ধরণীর চুম্বনের মতো কোনো স্থানে?

বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
দেওয়ান-ই-খাসের ধুলো ভারতের যতটুকু সাম্প্রতিক ইতিহাস জানে
তুমি তার সামান্য জান না, আছো ভ্রান্তিতে ও ভয়ে।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে
এবং সে নিজে, কেউ বলেনি তোমাকে?
সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীরত্বেরও ঘাড়ে একদিন মৃত্যুর থাপ্পড় পড়ে
সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ার ও ভাঙে মরচে লেগে
এই সত্যকথাটুকু কোনো মেঘ.কোনো বৃষ্টি, কোনো নীল নক্ষত্রের আলো
তোমাকে বলেনি বুঝি? তাই আছো ভ্রান্তিতে ও ভয়ে,
শব্দহীন গাঢ় ঘুমে, প্রিয়তমা পাশে শুয়ে, ভুলে গেছে সেও সঙ্গীহীন
তারও চোখে নিদ্রা নেই, সে এখনো মর্মান্তিক জানে
তুমি বন্দী, পুত্রের শিকলে।
বহুদিন একভাবে শুয়ে আছো, ভারতসম্রাট।
আওরঙ্গজেবের ঘোড়া মারা গেছে, মারা যেতে হয়।
এখন নিশ্বাস নিতে পারো তুমি, নির্বিঘ্ন প্রহর
পরষ্পর কথা বলো, স্পর্শ করো, ডাকো প্রিয়তমা!
সর্বান্তঃকরণ প্রেম সমস্ত ধ্বংসের পরও পৃথিবীতে ঠিক রয়ে যায়।
ঠিক মতো গাঁথা হলে ভালোবাসা স্থির শিল্পকলা।

তুমি এলে

তুমি এলে সূর্যোদয় হয়।
পাখি জাগে সমুদ্রের ঘাটে
গন্ধের বাসরঘর জেগে ওঠে উদাসীন ঘাসের প্রান্তরে
হাড়ের শুষ্কতা, ভাঙা হাটে।

তুমি এলে চাঁদ ওঠে চোখে
সুস্বাদু ফলের মতো পেকে পরিপূর্ণ হয়
ইচ্ছা, প্রলোভন,
ঘরের দেয়াল ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে দুর
ভ্রমনের বন।

তুমি এলে মেঘ বৃষ্টি সবই মুল্যবান।
আমাদের কাঠের চেয়ার
যেদিকে শহর নেই, শ্রাবণের মেঘমল্লার
মাতাল নৌকার মতো ভেসে যায় ভবিষ্যৎহীন।
পৃথিবী পুরনো হয়
পৃথিবীর ছাইগাদা, ছন্নছাড়া দৃশ্যের বিভুঁয়ে
শতাব্দীর শোক-তাপ জ্বর-জালা ছুঁয়ে
রয়ে যাই আমরা নবীন।

নিজের মধ্যে

গাছতলা ভরে গেছে ডেয়ো পিঁপড়েয়।
মাঝখানে মুনিঋষির মতো
নিজের মধ্যে নিজে।
ধূপ, ধুনুচি, ত্রিশূল
ত্রিশূলে টাঙানো ডমরু
গলায় রুদ্রাক্ষ, মাথায় বটঝুরি জট,
কিচ্ছু নেই।
শুধু খানিকটা আগুন পাঁজরার আড়ালে
পুড়বার মতো
কিছু কাঠ-কোঠরা
ইচ্ছে-অনিচ্ছের, লোভ-লালসার।
মুনিঋষির মতো বসে আছি গাছতলায়
ডেয়ো পিপড়েদের খুনখারাপি কামড়,
ক্ষতবিক্ষত অন্ধকারে
নিজের মধ্যে নিজে।

পাওয়া না-পাওয়ার কানামাছি

রঙীন রুমালে চোখ দুটো বাঁধা
নিজের সঙ্গে নিজের অষ্টপ্রহর- কানামাছি খেলা
ভারী চমৎকার ধাঁধা।
যাকে ছোঁবার তাকে না ছুঁয়ে
আকাশ ধরতে হাত বাড়িয়ে আমি ধুলো মাটির ভূয়ে।
হাত বাড়ালে হাতে জলের বদলে শামুক
অথচ ভেতরটা পরাগসুদ্ধ ফুলের জন্যে আপাদমস্তক কামুক।
সিদুর রঙের কিছু দেখলেই মন উসখুস, ইচ্ছেয় আগুন
বিশ্বাসের বাকলে সত্যিই এল ফাল্গুন?
কাছে যাই, কাছে গেলেই সব অদলবদল, যথেচ্ছাচার কান্ড
রক্তপাতের শব্দে শিউরে ওঠে গাছপালা নদীনালাময় দেশ
চেনা ব্রক্ষ্মণ্ড।

তবু তো ছুতে হবে কিছু, কাউকে-না কাউকে
পুকুরপাড়ের নিমগাছ কি সাগরপারের ঝাউকে।
পা নিয়েই সমস্যা, কোথায় রাখি, হয় পাঁক
নয় অনিশ্চিতের বালি
ভিক্ষের ঝুলিটা তবু যা হোক ভরছে নানারকম ভালো এবং মন্দে
সমৃদ্ধ কাঙালী।

মনে হচ্ছে কোথাও নেই
অথচ আমার চেয়ার টেবিলে আমি ঠিকই আছি
রঙীন রুমালে চোখ দুটো বাঁধা
নিজের সঙ্গে পাওয়া না-পাওয়ার কানামাছি।

প্রশ্ন

ছটাক খানেক বুকে,
একটা গোটা আকাশ এবং
জলের স্থলের গা ভর্তি রং
সব পড়েছে ঝুঁকে।
কাকে কোথায় রাখি?
বুকের মধ্যে হেসে উঠল
শিকল-পরা পাখি।

মানুষের কেউ কেউ

সবাই মানুষ থাকবে না।
মানুষের কেউ কেউ ঢেউ হবে, কেউ কেউ নদী
প্রকাশ্যে যে ভাঙে ও ভাসায়।
সমুদ্র সদৃশ কেউ, ভয়ঙ্কর তথাপি সুন্দর।
কেউ কেউ সমুদ্রের গর্ভজাত উচ্ছৃঙ্খল মাছ।

কেউ নবপল্লবের শুচ্ছ, কেউ দীর্ঘবাহু গাছ।
সকলেই গাছ নয়, কেউ কেউ লতার স্বভাবে
অবলম্বনের যোগ্য অন্য কোনো বৃক্ষ খুঁজে পাবে।

মানুষ পর্বতচুড়া হয়ে গেছে দেখেছি অনেক
আকাশের পেয়েছে প্রণাম।
মানুষ অগ্নির মতো

নিজে জলে জালিয়েছে বহু ভিজে হাড়
ঘুমের ভিতরে সংগ্রাম।
অনেক সাফল্যহীন মরুভুমি পৃথিবীতে আছে টের পেয়ে
ভীষণ বৃষ্টির মতো মানুষ ঝরেছে অবিরল
খরা থেকে জেগেছে শ্যমল।
মানুষেরই রোদে,
বহু দুর্দিনের শীত মানুষ হয়েছে পার
সার্থকতাবোধে।

সবাই মানুষ থাকবে না।
কেউ কেউ ধুলো হবে, কেউ কেউ কাঁকর ও বালি
খোলামকুচির জোড়াতালি।
কেউ ঘাস, অযত্নের অপ্রীতির অমনোযোগের
বংশানুক্রমিক দুর্বাদল।
আঁধারে প্রদীপ কেউ নিরিবিলি একাকী উজ্জল।
সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ,
কেউ বা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ।
অনেকেই বর্ণমালা
অল্প কেউ প্রবল সংবাদ।

যে টেলিফোন আসার কথা

যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূণ্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।

অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসন ঘন্টা শাঁখের উলু
একশ বনেরবাতাস এস একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।
তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি।
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীল।
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।

রামকিস্কর

খানিকটা পাথর দাও আর একটু বুক-খোলা মাঠ
হে কলকাতা, হে আমার রুগ্ন জীর্ণ মুহ্যমান শিল্পের সম্রাট
রক্তে নাচে ছেণী
বাতাসে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে যুবতীর বেপরোয়া বেশী
কিংবা কারো কালো চুলে অকষ্মাৎ কালবৈশাখী
একটু পাথর পেলে আঁকি
মেঘ কিংবা ঝড়
পাড়াগাঁর অন্ধকারে রোদে জলে হিম রাতে স্থির আলো জ্বালে
ধুলোর সংসারে বসে যে সকল নিঃসম্বল পার্বতী ও পরমেশ্বর
কিংবা গাছ, গাছই ভালো, গাছের অরণ্যমুখী হাঁটা
আজানুলম্বিত বাহু, দীর্ঘকায়, দৃপ্ত পদক্ষেপ, রোদমাখা ঋষি
ফুলের মশাল হাতে, বাকলে ফাটল, গায়ে কাঁটা
অথবা গাছের মতো কিছু
সুর্যের নিকটবর্তী, নক্ষত্রলোকের চেয়ে যৎসামান্য নীচু
মানুষ বা মানুষের বুকের নদীর মহোৎসব
ভালোবাসা ফুটে আছে, হাড় মাংসে আলোড়িত টব
অথবা জীবন, এই জীবনের নিশ্বাস-প্রশ্বাস রক্ত স্বেদ
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, খেদ
সাহস, সংগ্রাম,
অট্রহাসি, আর্তনাদ, গান
অনেক আগুনে পুড়ে তবুও বজ্রের ভঙ্গী যার।
অঙ্গ নয়, শুধু অঙ্গ নয়
আমার ছেণীতে নাচে চৈতন্যের প্রতি অঙ্গীকার।
একটু পাথর দাও হে কলকাতা রক্তে আকুলতা
বাতাসে উড়িয়ে দিই যুবতীর আঁচলের মতো কোনো প্রিয় সত্য কথা।

লাল নীল সবুজ

আমার অনেক বন্ধুবান্ধুব।
কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ সবুজ।
লাল বন্ধুরা দশদিগন্তের পাহাড়-পাথর ঠেলে হাঁটে
সমস্ত রক্তপাত ডিঙিয়ে আসবে এক অভ্রভেদী ভোরবেলা
তাকে স্বাগত জানাবে যে, সেই শাঁখের ঠিকানায়।
নীল বন্ধুরা নগ্ন হয়ে নেমে যায় সপ্তসিন্ধুর জলে
সমুদ্রগর্ত থেকে নক্ষত্রলোকের ঘাটে বেড়াতে যাবে মানুষ
তাকে পারাপার করবে যে, সেই অলৌকিক নৌকোর খোঁজে।
আর সবুজ বন্ধুরা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে।

শোকাভিভূত

শোকাভিভূতের ন্যায় বেলা বয়ে যায়।
বিশুদ্ধ গন্ধের মতো কোনো নারী দেখেছো কোথাও?
তার করতলে নাকি কয়ে গেছে মানুষের শোকের ওষুধ?

বাতাসকে এই কথা বলা মাত্র সমস্ত বাতাস
হো-হো হেসে লুটোপুটি খায়
বাগানবিহীন এই কলকাতার দেয়ালে-চাতালে।

ভীষণ ভ্রমের মতো কোনো স্বপ্ন দেখেছো কোথাও?
তার ছায়াতলে নাকি রয়ে গেছে মানুষের সুখের ওষুধ?

মানুষকে এই কথা বলা মাত্র সমস্ত মানুষ
টেরি কেটে ছুটে যায় যে যার নিজের গর্তে
নির্দিষ্ট শ্মশানে।
শোকাভিভূতের ন্যায় বেলা বয়ে যায়।

সিঁড়ি

কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
কদম ফুলের গন্ধা-সিঁড়ি
ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
পা পিছলোলে অধঃপতন
ভাসতে পারো মাছের মতন
ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ।
চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
পেট চিরলে আংটি কারো
কারো শুধুই আঁশ
দীর্ঘতর ফুসফুসে কার ভরাট দীর্ঘশ্বাস।
সিঁড়ির নীচ জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
মেঘও পাবে মানিক পাবে
বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
পুড়তে চাইলে রোদ
জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।

অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
ঊর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ
নিচের ঝোপটি কাঁটার।

স্থির হয়ে বসে আছি

স্থির হয়ে বসে আছি, তবু কলরোল।
মাছি জানে, ছাই-হওয়া সিগারেট জানে, কতখানি স্থির।
করতলে ভাগ্যরেখা, ইতিহাসে রাজার গৌরব, মাটিতে সমাধি
জলের ভিতরে গুড় আত্মহত্যা শুয়ে থাকে যতখানি স্থির,
মানুষের ছা-পোষা সংসারে
বদ্ধমূল নানাবিধ ভ্রানি-র মতন স্থির হয়ে বসে আছি, তবু কলরোল।
কাউকে দেখিনা, শুধু জনশূণ্য পথে একা হাওয়া হাঁটে, গাছ মাথা নাড়ে
কাউকে দেখি না, শুধু বিমানের সাদা ডানা, বিধ্বস্ত গর্জনে
লজ্জিতা নারীর মতো মেঘ সরে যায়, ঘন ছায়া নামে বনে
পৃথিবী হঠাৎ
দরিদ্রের মতো ম্লান, কাক কেঁদে ওঠে।
লিখি না, আঁকি না, কোনো ভাঙাগড়া খেলাধূলা নেই
তবু কলরোল।
ডাকাডাকি আকাশে মাটিতে, ক্রমাগত অনবরতই
সভাসমিতির খাম, আমন্ত্রন ও অভিবাদনে ক্রমাগত অনবরতই
দাঁড়ানো, দৌড়ানো, ছুটোছুটি
দোলাদুলি ঢেউয়ে লোকালয়ে।
ট্রেনের টিকিট যারা কেটে আনে কাউকে চিনি না।
রিজার্ত কামরার সুখ, অতিথিশালার চাবি, আয়না, বাথরুম
যথেচ্ছ ভ্রমণ সেরে ভোরবেলা না-ভাঙার ঘুম, দীর্ঘ স্বপ্নের তালিকা
ক্রমাগত অনবরতই কেউ ডাকে, করস্পর্শে মনে হয় আত্মীয়স্বজন
যেতে হয়, থেকে যাই, কার কাছে থাকি তা জানি না।
যে সম্রদ্রে কোনদিন ওলোট-পালোট হয়নি চুল
যে পাহাড় বহুদিন বিবাগী বন্ধুর মতো দুরদেশে ছিল
তারই কাছে স্টপেজ, স্টেশন, মেলামেশা, অঢেল আমোদ।

মধ্যরাতে ছৌ-নাচ, মানুষের ভগ্ন দেহে দেবতার মুখোশ পেখম
কাড়া-নাকড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে দশদিক, চতুর্থ প্রহর
মন্দিরে মন্ত্রের মতো ধ্বনি জাগে, যাগযজ্ঞে আছি মনে হয়
ঝর্ণা নামে রক্তস্রোতে, অব্যক্ত ও অব্যাহতিহীন কলরোল শুধু কলরোল।
আত্মপ্রকাশের এক গাঢ় ইচ্ছা
হটাৎ আকাশ ছুঁয়ে ফুটে উঠবার এক গাঢ়তর অসুখ ও জ্বর
বুকের ভিতরে এনে জড়ো করে ক্রমাগত, অনবরতই,
রাশীকৃত গাছপালা, শুকনো হাড়, শিকড়-বাকড়,
নৌকোর ভাঙা দাঁড়, অফুরন্ত কালো জল ও সুর্যকিরণ।

স্থির হয়ে বসে আছি তবু কলরোল।

 হে প্রসিদ্ধ অমরতা

হে প্রসিদ্ধ অমরতা
কী সুন্দর তোমার ভ্রুকুটি
ঘরের বাহিরে ডেকে এনে
ভাঙো ঘর, স্থিরতার খুঁটি।
ধবংসের আগুনে জলে ঝড়ে
তুমি রাখো মায়াবী দর্পণ
মহিমার স্পর্শ যারা চায়
রক্তপাতে তাদের তর্পণ
হে প্রসিদ্ধ অমরতা
কী উজ্জল তোমার পেরেক
বিদ্ধ ও নিহত হয় যারা
কেবল তাদেরই অভিষেক।

Exit mobile version